৫ হাজার রুপির গরু সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা মাত্রই ৫০ হাজার!

সীমান্ত দিয়ে যাতে একটি গরুও পাচার না হয় তা নিশ্চিত করতে অনেক আগেই বিএসএফ’কে নির্দেশ দিয়েছে ভারতের বিজেপি সরকার। সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়িত করতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)ও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, পর্যায়ক্রমে বাধাও দিয়েছে কিন্তু পাচারকারীরাও হাল ছাড়তে নারাজ। সীমান্ত পেরিয়ে চোরাপথে বাংলাদেশে গরু ও ষাঁড় পাঠাতে পাচারকারীরা তাদের নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে ৪০৯৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে বেশির ভাগটাই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের সঙ্গে-যেখানে গরু পাচারকারীরা মূলত রাতের অন্ধকারেই তাদের অপারেশন করে থাকে।

পাচারকারীদের কাছে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যাবসায় হল এই গরু পাচার। ভারতে যে গরুটি ৫ হাজার রুপিতে মেলে, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা মাত্রই তার দাম বেড়ে হয় ৫০ হাজার রুপি। সূত্রে খবর, গরুকে কেন্দ্র করে সীমান্তে এই অবৈধ ব্যবসার পরিমাণ বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপির কাছাকাছি।

দুই দশক আগেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর জিরো পয়েন্ট থেকে ১৫০ মিটার দূরত্বে যখন পাতলা কাঁটাতারের বেড়া ছিল-সেসময় পাচারকারীরা মূলত কাঁটাতারের দুর্বলতাকেই কাজে লাগাতো। সেক্ষেত্রে গবাদি পশুর ওপর নির্যাতন করে তাকে খেপিয়ে এবং উত্তপ্ত করে সীমান্ত পার করাতো।

এই বিষয়ে ভারতের পশ্চিম অসমের ধুবরি জেলার এক পুলিশ ইনফরমার জানান ‘গরুর পাছায় পেরেকের খোঁচা মেরে তাকে খেপিয়ে দেওয়া হতো, নয়তো যৌনাঙ্গে মরিচ গুড়া বা পেট্রল ঢেলে দেওয়া হতো। এতে ব্যাথার চোটে গরু প্রচন্ড জোরে দৌড়তে শুরু করে এবং কাঁটাতারের বাধা পেরিয়ে চলে যায় বাংলাদেশে’। তবে এক্ষেত্রে কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে সীমান্তে ঢোকার সময় অনেকক্ষেত্রে গরুগুলির মৃত্যু হত নয়তো শারীরিক বিকলাঙ্গের শিকার হতো। ফলে গরু পাচারের সময় মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকলে দামের ওপর প্রভাব পড়তে বাধ্য। গরু পাচারের এই বাড়বাড়ন্তের ফলে নড়েচড়ে বসে সরকার। ২০০০ সালে পাতলা ও একস্তরীয় কাঁটাতারের বেড়াগুলিকে দ্বিস্তরীয় করার কাজ শুরু হয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের কৌশলেও পরিবর্তন আনে গরু পাচারকারীরা। যার মধ্যে অন্যতম হল ডুব সাঁতারুর নি:শ্বাস নেবার নল। এক্ষেত্রে মূলত শিশুদেরই কাজে লাগানো হতো-যারা পেপে গাছের ডগাকে নল হিসাবে ব্যবহার করে পানির নিচ থেকে নিশ্বাস নিতো এবং নদী-নালা দিয়ে গরুগুলিকে ঠিক পথ দিয়ে বাংলাদেশে পাচারের সাহায্য করতো বলে অভিযোগ।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য ২০১৯ সালের মধ্যে দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তেস নতুন কাঁটাতারের বেড়া লাগানোর কাজ শেষ করা। ইতিমধ্যেই ২৮০০ কিলোমিটার সীমান্তের কাজ শেষ। সীমান্ত দিয়ে গবাদি পশু পাচার ঠেকাতে নাইট-ভিসন ক্যামেরা ও লেসার’এর সহায়তা নিয়ে নজরদারি বাড়িয়েছে বিএসএফ’এর সশস্ত্র বাহিনী। ফলে সমস্যায় পড়েছে পাচারকারীরা।
যদিও সমস্ত বাধা বিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই ফের নতুন কৌশল নিয়েছে পাচারকারীরা। নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে খবর বাঁশের কপিকলের সাহায্যে সীমান্তের একপার থেকে আরেকদিকে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ বাংলাদেশের এজেন্টরাই এই পদ্ধতির মাধ্যমে গরুকে বেঁধে কপিকলের সাহায্যে সেদেশে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। কারণ  বাংলাদেশে গরু ব্যবসা বৈধ হলেও ভারতে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
পাচারের সর্বশেষ পদ্ধতি হল গরুকে মাঝখানে রেখে দুই পাশে কলা গাছের ভেলা দিয়ে বেঁধে তা পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে তা বাংলাদেশের উদ্যেশ্যে পাচার করা। অতি সম্প্রতি এই পদ্ধতির মাধ্যমেই অসম থেকে কালজানি নদী দিয়ে বাংলাদেশে একাধিক গরু পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ। পাচারের সেই ভিডিও সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলিতে সম্প্রচারিতও করা হয়।
অসমে পাচারের মূল চক্রী আসরাফুল আকন্দ-কে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে আটক করা হয়েছে ধুবড়ি জেলা পুলিশ সুপার লঙ্গনিট তেরাঙ্গ জানিয়েছেন।

বিএসএফ’এর এক কর্মকর্তা জানান ‘নদী দিয়ে গরু পাচার রুখতে বিএসএফ’এর তরফে বোটে করে টহলদারি বাড়ানো হয়েছে। তিনি আরও জানান পাচারের মূল সমস্যার কারণ হল ভারতে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গরু বহন করার ওপর কোন নিষিদ্ধাজ্ঞা নেই’।

ভারত থেকে গরু পাচারের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে বলে স্বীকার করেছেন বিজিবি’এর আঞ্চলিক কমান্ডার অতিরিক্ত ডিজি মহম্মদ জাহিদ হাসান। শনিবার মেঘালয়ের শিলং’এ দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বৈঠকের পর গরু পাচার প্রসঙ্গ নিয়ে বিজিবি’এর এডিজি বলেন ‘এটা ঠিক যে গরু পাচার আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। যদি এই গবাদি পশুগুলি ভারত থেকে না আসতো তবে আমাদের কৃষকরাও (গরু পালকরা) সামনের দিকে অগ্রসর হতো পারতো এবং আমরা আমাদের নিজেদের খেয়াল রাখতে পারতাম’।

তিনি আরও জানান, ‘পাচার ঠেকাতে আমরা বিএসএফ-কে অনুরোধ করেছি এবং এর ফলে অন্য অনেক সমস্যাই মিটে যেতে পারে’। হাসান জানিয়েছেন, ‘গবাদি পশুরা নিজে নিজে সীমান্ত পার হয়ে আসতে পারে না। আমরা তাদের অনুরোধ করেছি যে এই ধরনের পাচার এখনি বন্ধ করা উচিত। কারণ এই গরুগুলি পশ্চিম ভারত থেকে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.