ছোট বেলা থেকেই একটা ইচ্ছে ছিলো, পৃথিবী ঘুরে দেখবো। সেই ইচ্ছার কারনেই হোক বা অন্য যে কারনেই হোক, নিজের মাতৃভূমি কে ছেরে একটা সময় পাড়ি জমালাম অনেক দূরের একটা দেশে। শহরে। পৃথিবীর ছোট্ট একটা দেশ। ছোট্ট একটা শহর।
এই শহরের নাম মন্ট্রিল! নাম টা যতটা একটা বিল্লি বিল্লি নামের মত লাগে, শহর টা ঠিক ততটাই একটা বিল্লির মতই কিউট, শান্ত ছিমছাম। এখানে আসার আগে বুঝতেই পারতাম না একটা শহর কতটা শান্ত হতে পারে।
প্রবাস জীবন মানে নিষ্ঠুর, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্য থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে দেয়াল বিহীন কারাগারে এতিমের মত বসবাস করা । প্রবাস জীবনে যারা পদার্পণ করেছেন একমাত্র তারাই প্রবাস জীবন যে কেমন নির্দয় এবং নির্মম তার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। শস্য-শ্যামলা সবুজেঘেরা সোনার বাংলাদেশ এবং মা-বাবা ভাই- বোন আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের স্বাদের স্ত্রীর মায়া-মমতা ভালবাসা ত্যাগ করে, সংসারের সবার মুখে হাসি ফুটাবার জন্য , আর্থিক উন্নতির জন্যই প্রবাসের মাটিতে পা রাখতে হয় ।বিদেশ এসে চাকুরী করে অনেক টাকা পয়সা বড়ীতে পাঠাবে, সংসারে দুঃখের ছায়ার পরিবর্তে সুখের আলতে সংসার উজ্জ্বল হবে— এ প্রত্যাশা বুকে নিয়ে আমরা প্রবাসে এসেছি কিন্তু আমাদের সেই সুখ, সেই সুখের স্বপ্ন সবাই কি পূরণ করতে পেরেছি? হয়তো না।
পরিবারের মানুষ যখন কথা বলে বা চিঠি লেখে তখন কেমন আছিস, কোন চিন্তা করিস না, আমরা ভালো আছি, বাড়ির কোন সমস্যা অথবা সমস্যার সমাধান, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত হচ্ছে কিনা এই বিষয়গুলই বলে। কেউ কেউ অনেক সময় ঝগড়া করে, তর্ক করে, নালিস করে। আমার মনে হয় কোন প্রবাসীকে দেশ থেকে (অন্তত যাদের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা নাই) একজন প্রবাসীর মনের অবস্থা, তার একাকিত্ত্ব, তার আবেগ, তার কষ্ট, তার উদাসীনতা, তার নিরব কান্না এগুলো বুঝতে পারে না। এটা সত্য যে এই অনুভূতি গুলো অনুভব করাও তাদের পক্ষে সম্ভব না। প্রবাসী জীবনে প্রবাসীরাই এই গুলো বেশি অনুভব করেন।
প্রবাস জীবনে কেউ দুঃখ পায় না, কারন দুঃখ পেতে আপনজন প্রয়োজন হয়। আপনজন ব্যতীত অন্য কেউ দুঃখ দিতে পারে না। প্রবাস জীবন এমনই যে এই জীবনে দুঃখ পাওয়া যায় না। তবে প্রবাস জীবনের সঙ্গী হয় কষ্ট এবং এমন ভাবে লেগে থাকে যে পিছুই ছাড়তে চায় না। দুঃখ এবং কষ্টের মাঝে যে বিশাল ব্যবধান তা প্রবাসীদের মতো অন্য কেউ অনুভব করতে পারে না। প্রবাসে প্রবাসীরা যা অর্জন করেন সেটা অর্থ কিংবা শিক্ষা যায় হোক না কেন সেটা তার অতুলনীয় কষ্টের ফসল ছাড়া কিছুই না।
শহর থেকে বেশ দূরে সমুদ্রের পাশে আমার কর্মস্থল। প্রতিদিন সকাল বেলা নিজে নাস্তা করে খেয়ে বাসে চেপে শহরের কোন এক টানেলের ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয় কর্মস্থলে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনীর পর যখন রাতে নিজের ঘরে ফিরি, ফিরে এসে আবার সেই রান্না এরপর ক্লান্ত মুখে চুপচাপ শুয়ে পরা। এভাবেই কেটে যাচ্ছে প্রতিটা দিন! প্রতিটাক্ষন। প্রতি রাতেই একটা গান শুনি। সেই গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর চেষ্টা করি।