যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা – এই কথাটি একটি অভিশাপের মত। এই কথার চাইতে অযৌক্তিক কথা আর কিছু নেই। যুগ পরিবর্তিত হয়নি। বরং পিছিয়ে গেছে। নোংরা হয়েছে। মানুষগুলো অমানুষ হয়েছে। অপরাধ কার? আমাদের সকলের। ইংরেজীতে একটা কথা আছে কাট ইউর কোট একর্ডিং ট্যু ক্লদ (cut your coat according to cloth) । প্রসঙ্গ ঈদ। এই প্রসঙ্গে লিখবো ভেবেছিলাম কিন্তু নিজের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য যোগাড় করার জন্য শ্রম বিক্রি করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই লেখা হয়নি। মাথার ভেতরে কথারা ঘুর ঘুর করে কিন্তু শ্রম বিক্রি করতে করতে আর সময় হয়না আর লেখা হয়না। মাথার ভেতর কথারা ক্লান্ত হয়ে যায়। দেহ ক্লান্ত হয়। এই ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্নহীন ঘুম।

বাস্তব কঠিন। মানুষগুলো স্বার্থপর। এই কঠিন বাস্তবের চারিপাশে অগুনিত স্বার্থপর মানুষের বেষ্টনীতে বেঁচে থাকা হয়ে পড়ে তীব্র প্রতিযোগীতামূলক। ঈদের সময় কেনো সেমাই খাওয়া লাগবে ? পোলাও কোর্মা কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়া লাগবে? গরুর মাংস খেলে ক্যানসার হয় আর পোলাও খেলে কোষ্টকাটিণ্য হয়। এইসব মুঘল খাদ্য বাঙ্গালীর পেটে ঢুকে মেদ বৃদ্ধি করে। মল পেটে জমে পেট ফুলে ফেফে নিজেকেই বিশাল হাতীর মত লাগে। হাটতে চলতে কষ্ট হয় ফলে রক্তের উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়, হাফানী হয়। শরীরে এক থেকে আর এক রোগ দেখা দেয়। ঈদ অর্থ খুশী। খুশী কি কিনতে পাওয়া যায়? সেমাইয়ের বিনিময়ে খুশী? পোলাও কোর্মা রেজালার বিনিময়ে খুশী? নতুন কাপড়ের বিনিময়ে খুশী?

এইসব খুশী কিনতে যে টাকার দরকার সেই টাকা কি আপনার কাছে আছে? আমার কাছে নেই। ঈদের দিনে পোলাও কোর্মা রেজালা আর নতুন কাপড় কিনতে যে টাকা ব্যয় হবে তা হতে পারে আমার দুইমাসের বেতন। দুই মাসের বেতন যদি এক দিনের জন্য ব্যয় হয়ে যায়, তাহলে আমি দুই মাস কি খেয়ে বাঁচবো ?

নিজের আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে। বিজ্ঞাপণ দেখে ব্যয় করা বা পরিবারের যেসব সদস্য অর্থ উপার্জনে সাহায্য করেনা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের খুশীর জন্য নিজের সামর্থ্যের বাইরে ব্যয় করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা আর পরিবারের সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠার জন্য  নিজেই নিজের উপরে মানসিক চাপ সৃষ্টি করি। এই মানসিক চাপ এই অর্থনৈতিক চাপ ধীরে ধীরে নিজেকে অসুস্থ করবে। আমি যখন অসুস্থ হবো তখন আমি কিভাবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলবো? আমি যদি আজ পক্ষাঘাতে বিছানায় শয্যাশায়ী হই তাহলে যুগ এসে আমার সেবা করবেনা। আমার পরিবারের স্বার্থপর সদস্যরা মুখে ভাঁড় করে নিজেদের সুখ আহ্লাদের জন্য অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করবে। একদিন আমি অবহেলিত, অসুস্থ, একাকী মরে যাবো কেউ থাকবেনা আমার পাশে। না যুগ না সেইসব মানুষ যাদের জন্য একদিন আমি আমার কস্টগুলোকে নানা রকম রংগীন আবরণে ঢেকে লুকিয়ে রেখে হেসে হেসে পথ চলেছিলাম।

আমি আমার নিজের জীবন দিয়ে দেখছি। আজ যে আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে সেই হাসি আর সেই সময়ের পেছনে তার একটা স্বার্থ আছে। অথচ আমি দেখছি আহা সে আমার কত ভাল বন্ধু – আহা আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে নিজের সময় নষ্ট করে। এমন একটি নিঃস্বার্থ বন্ধু আমি কোথায় পাবো!!! এই বন্ধুটি যে কাজের জন্য হেসেছিল, কিছুক্ষণ সময় সাথে ছিল সেই বন্ধুটি মৌসুমী পাখির মত ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে কাজ ফুঁড়িয়ে গেলে। তখন আমি অবাক হবো। তখন আমি দুঃখ পাবো। তখন আমি তাঁকে খুঁজবো। খুঁজে পেতে ডেকে ডেকে একদিন হয়তো তাঁকে পাবো ঠিকই কিন্তু আগের মত না। তখন সে ব্যস্ত থাকবে, ছটফট করবে আমার থেকে পরিত্রাণের জন্য। তখন তার চারিপাশে আরো অনেক রঙবেরঙের স্বার্থপর বন্ধুদের বেষ্টনী। সেখানে খেলা হচ্ছে স্বার্থের টানাটানির খেলা। সেই খেলাতে যে জিতবে সেই হবে যুগের সেরা মানুষ। সবাই তাঁকে সালাম করবে সন্মান করবে, সেই পরিবারের নাম হবে অমুক পরিবার।

যারা প্রতিদিন একবেলা বা দুইবেলা বা সারাদিন না খেয়ে থাকে রোজা তাদের জন্য ফরয নয়। যাদের আয় নেই তাদের ব্যয় করার উপায় নেই। যারা তিনবেলা খেয়ে, উদ্বৃত্ত সঞ্চয় ও অপচয় করে, বিশাল দেহ বানিয়ে সমাজের হাসপাতালগুলোর মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে রোজা তাদের জন্য ফরয। তাদের ঈদ তো প্রতিদিন। তাদের আর ঈদের জন্য সেমাই, কোর্মা, পোলাও, রেজালা খাওয়া লাগেনা সেজন্য যাদের নেই যাদের রক্ত চুষে এইসব মানুষগুলো বিশাল দেহ বানিয়েছে ঈদে পোলাও কোর্মা তারাই রান্না করে। একদিনের পোলাও কোর্মা খাওয়ার জন্য বাকী পচিশ দিন না খেয়ে থাকে।

এতে করে বাজারের ব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধি হয়। দরিদ্র আরো দরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত হয় আর মানসিক চাপ বুকে নিয়ে মুখে হেসে হেসে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে হাফাতে থাকে, খোঁড়াতে থাকে, ক্লান্ত হয়ে অনেক বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে যায়। আর ঘুমের মাঝে ঐসব চাপ মগজের মধ্য জাগা না পেয়ে ফেটে বেরুতে চায় এক্সপ্লোসিভের মত। তখন সে চিৎকার করে জেগে উঠে। দেহ কাঁপে। শরীর অবশ লাগে। তারপর আবার সেই আগের মত।
ভোর হয়। বুকের ভেতরের কস্টগুলো বেশ ঢেকেঢুকে মুখে হাসির আবরণ রেখে সে বেড়িয়ে পড়ে স্বার্থপর মানুষগুলোর সাথে পাল্লা দিতে ঘোড়দৌড়ের মাঠে।

কানাডাতে আজ ঈদ। আমি ঘুম থেকে উঠেছি বারোটাতে । বাসি ভাত খেলাম একটার সময়। আমি আমার বুকের ভেতরে কথা জমিয়ে রাখিনা। লিখে লিখে সবাইকে জানিয়ে দেই। আমিও ঋন করে খাই তবে সাড়া মাস। ঈদের জন্য আমি কিছু কিনিনি। কিছু রাধিনি। পোলাও খেলে আমার কষা হয়। কষা হলে আমার হাফানী হয়। আমি প্রচুর পরিমানে সব্জী খাই ও পানি পান করি। নিয়মিত ব্যায়াম করি এবং শরীরে রোগ যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সব সময় সতর্ক থাকি। কম দামী পুষ্টিগুন খাবারের দাম কম থাকে যেহেতু কেউ কিনেনা চাহিদাও কম থাকে যেহেতু কেউ পুষ্টিগুণ না দেখে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে খাবার খায়। বিভিন্ন রোগ হবার উৎস যেসব খাবার সেসব খাবারের মূল্য বেশী যেহেতু সবাই সেগুলা কিনে, এবং চাহিদা আছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যারা উৎসাহিত করে তারা হলো ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য বিক্রি বৃদ্ধি করার জন্য তাদের মুনাফা বৃদ্ধি করার জন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার বিজ্ঞাপণ দেয়। আমি নির্বোধ। পেটে ভাত না থাকলে হাসিনা । বলি যে – এখন আমার পেটে ভাত নাই, আমার কাজ নাই, আমার হাসি আসছেনা। পরিবারের সদস্যদের বলি – আমার টাকা নাই, সুতারাং আমার কাছ থেকে পোলাও কোর্মা আশা করবেনা। পোলাও কোর্মা কেনার জন্য শ্রম বিক্রি করো আর নিজেরা নিজেদের পেট ভরো।

দুনিয়াতে কেউ কারু নয়। কাজের সময় কাজী আর কাজ ফুরালেই পাজী।

পোষাকে নয়, খাবারে নয়, সম্পদে নয় – মনের মাঝে খুশী থাকে।
সে খুশী কেনা যায়না। সে খুশী ধরা যায়না। সে খুশী ছোঁয়া যায়না।
স্বার্থপর মানুষের স্বার্থের টানাহ্যাঁচড়াতে সে খুশী হারিয়ে যায়।

খুশী একটি প্রাকৃতিক অনুভূতি। অনেক সময় আমি খালি পেটেও হাসিখুশী থাকি যখন কোন ভাল গান শুনি বা পথের পাশে সদ্যফোটা ফুল দেখি অথবা কারু মুখে হাসি দেখি অথবা যখন দেখি অনেক অমানুষের ভীরে একজন মানুষ পাগলের মত চেষ্টা করছে মানুষ থাকার তখন আমার মন খুশীতে ভরে উঠে। সে খুশী বছরের যেকোন দিন হতে পারে, যেকোন সময়ে হতে পারে।

খুশী ক্রয়বিক্রয় করা যায়না। খুশীর কোন বিনিময় মূল্য নাই। কাগজ বা প্লাস্টিক দিয়ে খুশী কিনতে পাওয়া যায়না।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *