ছেলে সন্তান বেশী মূল্যবান নাকি মেয়ে সন্তান বেশী মূল্যবান সেই বস্তাপচা আলোচনাতে আমি যাবোনা। আজ আমি অন্য কথা বলি। একজন মা হিসাবে একাকী মা ও বাবার ভূমিকা পালন করে সন্তান গর্ভে ধারণ, বহন, লালনপালন ও আজীবন ভালবাসার যে বিশাল ও মহান দায়িত্ব একদা এক কিশোরী মায়ের ঘাড়ে এসে ভর করেছিল ঠিক একই দায় বাবার ঘাড়ে এসে ভর করেছিল কিনা আমার জানা নাই। আমি আদৌ জানিনা। এই প্রশ্নের জবাব একদা খুঁজতাম। এখন আর খুঁজিনা। আমি ক্লান্ত। এখন দেখি এই সংক্ষিপ্ত বর্ণাঢ্য জীবনে বিশাল পথ অতিক্রম করতে কত কত রাত বিনিদ্র কেটেছে, কত টন অশ্রু কপোলে শুখিয়েছে, কত দুশ্চিন্তা, কত হতাশা, কত আশা, কত কত বাঁধা বিপত্তি পেড়ুতে হয়েছে, কত কটু কথা বলতে বা শুনতে হয়েছে, কত ভালবাসতে হয়েছে, কত ঘৃণা করতে হয়েছে, কত ক্ষোভ, কত হিংসায় জ্বলতে হয়েছে, কত ব্যাথা, বেদনা সইতে হয়েছে। এখন দেখি এইসব কিছু সহ্য করে যখন সন্তান বড় হয়ে একজন পরিপূর্ন মানুষ হয়েছে তখন সে পেছনে ফিরে তাকিয়েছে কিনা? যদি না তাকায়, তাহলে মা বা বাবার আদৌ কিছু করনীয় থাকে কিনা?
কিছু করার থাকেনা। ছেলেরা যদি যার যার নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে যায় তাহলে আমি তাদের বলতে যাবোনা – ওগো তোমার জন্য আমি অমূক করেছি তমূক করেছি তুমি কেন এখন আমাকে দেখছোনা। অনেক ব্যাথা আছে যা সন্তানকে বলা যায়না। আমার একাকীত্বের জন্য আমার ছেলে দায়ী নয়। আমি তাদের দুনিয়াতে আসতে সাহায্য করেছি বলে তাদের কোন বাধ্য বাধকতা নেই আমার দুর্দিনে আমাকে দেখার। সন্তানের জন্মদান একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এখানে কেউ কারু কাছে দায়বদ্ধ নয়। সন্তান যদি ইচ্ছা করে তাহলে আমার দেখাশোনা করতে পারে। সে স্বাধীন। দায়িত্ব পালন করা বা না করা তার মর্জি। এখানে কোন বাধ্যবাধকতা নেই । আমি আমার সন্তানকে সেজন্য দোষারোপ করবোনা। সবাই ভালবাসেনা। সবাই ভালবাসতে জানেনা। আমি যেহেতু স্বাধীন, নিজে নিজেকে তৈরি করেছি ঠিক একইভাবে আমার সন্তানেরাও স্বাধীন। স্বনির্ভর। তার অর্থ এই নয় যে তারা আমাকে ভালবাসেনা। তার অর্থ এই নয় যে তারা আমার কথা স্বরণ করেনা। তার অর্থ এই যে আমি যেমন কারু বোঝা হতে চাইনা তেমনি তারাও কারু বোঝা বইতে চায়না। সংক্ষিপ্ত জীবনের বিশাল পরিক্রমাতে কারু সময় নেই অকেজো বোঝা বইবার।
মায়ের কাছে সন্তান কখনও বোঝা হয়না। সন্তান আমার বোঝা ছিলনা। সন্তানকে লালন পালন করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। টেকনিক্যালি বাবামাকে দেখা সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য নয়। যদি দ্যাখে ভাল যদি না দ্যাখে কিছু করার নেই।
ধর্মীয় অনুশাসন যখন আমরা অন্য ব্যাপারে মানিনা তখন মাবাবার দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে শুধু মানবো সেটা প্রত্যাশা করা অনুচিত। ছেলের বিয়ে হয়ে গেলে সে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। বউ যদি উপার্জনক্ষম হয় তাহলে সে শাশুড়িকে টানতে চায়না। বউ যদি উপার্জনক্ষম নাও হয় তবুও বেশীভাগ ছেলের বউ শাশুড়িকে টানতে চায়না। আর শাশুড়ি যদি উপার্জনক্ষম হয় তাহলে ছেলের বউয়েরা শাশুড়ির জন্য উপহার নিয়ে আসে। বিভিন্ন উৎসবে শশুর শাশুড়িকে দেখতে আসে। আসাযাওয়া আদোর ভালবাসা শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় কেক কাটাকাটি ইত্যাদি সব লোক দেখানো কর্মকান্ড চলতে থাকে। এখানে দেখা যায় অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাই সবাইকে কাছে টেনে রাখে আর কেউ যখন অর্থনৈতিকভাবে অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে যায় তখন সে বোঝা হয়ে যায়।
অতীতে মায়েরা উপার্জন করতেন না। মায়েরা ছেলেদের বেশী আদোর করে লালনপালন করতেন। ছেলেরা ছিল মাবাবার বিনিয়োগ। ছেলেকে আদর করে লালন পালন করলে ছেলে বড় হয়ে মাবাবাকে আদোর করবে । দেখাশোনা করবে। ছেলে সন্তান উপার্জন করে বুড়া বয়সে মাবাবাকে খাওয়াবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক নিয়ম। ছেলের বউরা মাঝে মাঝে একা খেতে চায়। নিজের মাবাবাকে নিয়ে থাকতে চায়। স্বামীর মাবাবার প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবহেলা দেখায়। তখন মা কষ্ট পান। বাবা দুঃখ পান। বাবার অবর্তমানে ছেলেই মাকে দেখাশোনা করবে এটাই ধারণা করা হয়। ছেলে বিয়ে করবে, সংসার করবে, সন্তান হবে, সেই সন্তান বড় হবে তারপর সেই সন্তান একইভাবে মাবাবাকে আদোর করবে যেভাবে তার দাদাদাদীকে তার বাবা আদোর করেছে।
অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হলেও একজন খুব একাকী জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষও চাইবে আপন কারু সাথে থাকতে। সাড়া বিশ্বে মিলিয়ন মিলিয়ন মাবাবা আছেন যাদের সাথে তাদের ছেলেমেয়েরা দেখা করতে আসেনা। তাঁরা একাকী বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। সেখানেই স্মৃতিচারন করতে করতে মারা যান। একাকী ছেলেমেয়েকে লালন পালন করার পরেও মাবাবা বৃদ্ধাশ্রমে একাকী জীবনযাপন করে সবার অলক্ষ্যে মারা যান।
তাহলে সন্তানের জন্ম দিয়ে কি লাভ? সন্তানের মুখ দেখে কেনো এত সুখ? বিয়ে আর ঘর সংসার আর সন্তানের জন্য কেনো এত স্বপ্ন দেখা? বিয়ে করার জন্য মানুষ কেনো এত পাগল? সন্তানের জন্য কেনো এত অপেক্ষা? কি হয় সন্তান জন্ম দিয়ে? কি হয় ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়ে? শেষ বয়সে তো আমাকে বৃদ্ধাশ্রমেই একাকী সিলিং এর সাথে কথা বলতে বলতে মৃত্যুকে আলিংগন করতে হবে। তাহলে কেনো আমি কস্ট করে সন্তানের জন্ম দিতে যাবো? সারারাত জেগে সন্তানকে বুকে করে ধরে চব্বিশ ঘন্টা নির্ঘুম সারাদিন অফিস করে আবার দৌড়ে যাবো তাকে বুকে টেনে নিতে, কেনো? বুড়োবয়সে বৃদ্ধাশ্রমে যাবার জন্য?
যদি আমি আমার সন্তানকে এত ভাল না বাসতাম। যদি আমি আমার সন্তানের জন্ম না দিতাম তাহলে কি হতো? বৃদ্ধাশ্রমে বসে ভাবতাম – আহা কেনো দশ পাঁচটা ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে রাখলাম না। তাহলে হয়তো ওরা আমাকে দেখতে এসে ধন্য করে ফেলতো!!!
আজ একটা খবর পড়লাম একজন বাবা তার শিশু কন্যাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। শিশুকন্যার বয়স মাত্র তিন বছর। শিশু কন্যাকে প্রায়ই নির্যাতন করতো তার বাবা। তার বাবার আক্ষেপ ছিল যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো তাহলে অভাবের সংসারে ছেলে উপার্জন করে বাবাকে সংসারে সাহায্য করতো। ছেলে সন্তান জন্ম নেবার সাথে সাথে রিকশা চালাতে পারেনা বা কাজে লেগে যেতে পারেনা। ছেলে সন্তান ও মেয়ে সন্তানের মোটামুটি কাজ করার মত অবস্থা হতে একই সময় লাগে। যাই হোক ছেলে হয়নি সেজন্য শিশু মৌসুমীর বাবা রঘুনাথের আক্ষেপ ছিল । মাছির মত গলা টিপে মেয়েকে হত্যা করেছে বাবা রঘুনাথ।
রঘুনাথ ভালই করেছে। শিশু হত্যার জন্য যদি রঘুনাথের ফাঁসি হয় তাহলে তাকে আর সংসার চালানোর জন্য একেবারেই কস্ট করতে হবেনা। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া সত্বেও শিশু মৌসুমী বাবাকে অন্তত একটা উপকার করতে পেরেছে । বাবা তুমি তো আমাকে বেঁচে থাকতে দিলেনা আমি তোমাকে চিরদিনের জন্য অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দিয়ে গেলাম। ছেলে সন্তান হলে তাকে মানুষ করতে অনেক খরচা হতো সেই খরচা থেকেও মৌসুমী তার বাবাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়ে এমনই হয়। মরে যেয়েও বাবার উপকার করে যায়। ছেলে বড় হলে হয়তো মাবাবাকে ফেলে চলে যেতো বউ নিয়ে অন্য কোথাও। মেয়ের বিয়ে দিতে টাকা খরচা হবে সেজন্য রঘুনাথ মেয়েকে হত্যা করলেও মেয়ে মৌসুমী বাবা রঘুনাথকে জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে।
ফিরে যায় সংসার করার অতীত ইতিহাসে।
মানুষ একা থাকতে পারেনা তাই সংসার করে। জৈবিক চাহিদা মেটাতে সাথী খোঁজে আর সেভাবেই আরো মানুষ এসে হাজির হয়ে সংসারের সদস্য বৃদ্ধি হয় তখন পরিবার হয়। পরিবারে একে অন্যকে দেখাশোনা করে। পুরানা ইতিহাস।
পরিবারের মেয়েরা বিয়ে করে অন্যের সংসার সাজাতে অন্য পরিবারের সদস্য হয়ে যায় আর পরিবারের ছেলেরা অন্যের পরিবার থেকে মেয়ে এনে সংসার সাজায়। এইভাবে পরিবার গঠিত হয়। আদি ইতিহাসের উত্তরণ ঘটেছে। অভাবের সংসারে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ভাতের জন্য পেটের মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে মা। বিয়ে দিতে খরচা হবে বলে তিন বছরের শিশু কন্যাকে গলা টিপে হত্যা করেছে বাবা। সবাই যার যার জাগাতে যার যার অনুভূতি বিচার বুদ্ধিতে তার তার মত অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বর্ধিত করেছে বা কমিয়েছে – শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। ভ্রুনের প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। একজন নারীর প্রতিরোধ ক্ষমতা সীমিত। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীপুরুষ সবাই ক্ষমতাবান ও সম্পদশালীদের হাতের পুতুল। অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে তাই যার প্রতিরোধ করার ক্ষমতা সব চাইতে কম তাকেই হেরে যেতে হয়।
ভালবাসা পরাজিত। মাতৃত্ব, স্নেহ, মায়া মমতা বিলুপ্ত। ধীরে ধীরে আমার প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ের একক সৈনিক আমি প্রতিদিন এগিয়ে যাচ্ছি পরাজয়ের মুখে।
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা ।