পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাংলা বছরের প্রথম দিন। তাতে কারু কিছু কি আসে যায়? সেদিন আমার জন্মদিন সেজন্যও আমার তেমন কিছু আসে যায়না। আমাকে যিনি জন্ম দিয়েছিলেন তিনি সেইদিন অনেক ব্যাথা অনুভব করেছিলেন তারপর আমাকে লালন পালন করতেও তাঁকে অনেক কস্ট ও যাতনা পোহাতে হয়েছিল। পহেলা বৈশাখে জন্ম নিয়ে বা বছরের যেকোন দিনে জন্ম নিয়ে আমি আর এমন কি করেছি? যেহেতু বাংলা বছর বা বাংলা ক্যালেন্ডার বাংলাদেশীরা অনুসরণ করেনা বাংলাদেশীদের জীবনে পহেলা বৈশাখ কোন অর্থ বহন করেনা।

তবে আমি হয়তো ভুল বল্লাম। মানুষের ক্ষুধা অনুভূত হয় শরীরের দুইটি বিশেষ অংশে। এক ক্ষুধা অনুভূত হয় উদরে অন্যটি উদরের নীচে। উভয় ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডসহ নানা ধরনের কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। আর ব্যবসার জন্য মানুষ বারো মাসে তেরো রকমের উৎসব পালন করে। পহেলা বৈশাখ তাদের মধ্য অন্যতম। অতীতে পহেলা বৈশাখে কৃষকেরা ফসল ঘরে তুলতো। নতুন ধানের পিঠা তৈরি হতো। ব্যবসায়ীরা হালখাতা খুলতো ।ব্যবসার হিসাব শুরু হতো নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে। পহেলা বৈশাখে নবান্নের হৈচৈ অনেকটা ঈদের মত ছিল। আমি দেখিনি তবে বাবামায়ের কাছে শুনেছি। আমার জন্মদিনের পহেলা বৈশাখে আমাদের ঘরে আমাদের মহল্লাতে আর আমাদের সমাজে কি কি উৎসবের আয়োজন হয়েছিল তা আমার জানার কথা না তবে আমার যখন বুদ্ধি হয় তখন শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সাথে ফারাক্কা চুক্তি করে বাংলাদেশের কৃষিকে হত্যা করে ফলে নবান্নের হৈচৈ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।

কৈশরে আমি দেখেছি ক্ষুধার্ত মানুষের মৃতদেহ। আমার কৈশরে নদীগুলোর পানি চলে গেছে ভারতে। পদ্মার পাড় মরুভূমি হয়েছে। আমার মধ্যবয়সে তিতাসের বুক দিয়ে ভারত থেকে মালবাহী ট্রাক আসে । এখন তিতাস একটি সড়কের নাম। তিস্তাতে পানি নেই। ও বাংলাদেশিরা পানিকে বুঝি জল বলে। সেই যে শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সেই মৈত্রী চুক্তি করেছিল সেদিন থেকেই বাংলাদেশের মানুষেরা পানিকে জল বলা শুরু করে দিলো। হোলির রং মাখামাখি শুরু করে দিলো । কৃষি গেল মরে। পাটের গুদামে গেল আগুন লেগে। লাখ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের লাশের মিছিলে আমার শৈশবে আমরা ছিটের কাপড় পেলাম স্কুল থেকে । সাড়া বিশ্বের সব রিলিফের পন্য ব্ল্যাকে চলে গেল ভারতে। আদমজী, ইসপাহানী, বাওয়ানীরা সব চলে গেল সেখানে আওয়ামী লুটেরা হয়ে গেল আর এক পরিবার। ঘরে ঘরে ডাকাতি, লুট, ক্ষুধা, ধর্ষন, খুন, গ্রেফতার, আর রেশনের দোকানে লাইন, কেরোসিনের জন্য সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, লোড শেডিং আর ইন্দিরা গান্ধীর অভিষেকে সোনার সূতোয় বোনা জামদানী উপহার দেওয়া হলো। সোনার মুকুট পড়ে শেখ মুজিবের ছেলেদের বিয়ে হলো তখন পথে মানুষ ফ্যান ভিক্ষা করতো ভাত গেলার ক্ষমতা ছিলনা বলে।

আমার জীবনের পহেলা বৈশাখগুলো এমনই কেটে গেছে। আর আজ বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখে আমরা কি দেখবো? বাংলাদেশের চারিদিকে ভারতের পন্যের সমারোহ। সেই ব্যবসা আর পানিকে জল আর দোয়াকে আশীর্বাদ আর সুপ্রভাতকে শুভ সকাল আর দুলাকে জিজা আর ইলিশ চলে গেছে জাদুঘরে বা ভারতের বাবুর্চির হেসেলে। ওখানে হেসেলে ইলিশ আর টেবিলে প্রতিরক্ষা চুক্তি। এই পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষা করার জন্য সামরিক চুক্তি করেছে ভারতের সাথে। চুক্তি পড়ে আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। এমনিতেই আমার ধৈর্য কম। বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতের বিএসএফ এসে প্রতিদিন বাংলাদেশী হত্যা করে। কার জন্য এই ডিফেন্স ডিল ? বাংলাদেশের খালেবিলেমাঠেঘাটে হাত পা বাঁধা নির্যাতিত মানুষের লাশ পাওয়া যায় নিত্য। কিসের ডিফেন্স ডিল? ভারত থেকে রুপি নিয়ে অস্ত্র কিনে বাংলাদেশ কোন দেশ থেকে নিজেকে প্রতিরক্ষা করবে? বাংলাদেশের তিনদিকে ভারত। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে ভারতের পন্যে ঠাসা। আলবেরা থেকে অভালটিন, গরু থেকে পেঁয়াজ, শাড়িচুরিসোনাদানাগাড়ি বিছানার চাদর আর পায়খানার বদনা সবই ভারতের তৈরি। ভারত ছাড়া বাংলাদেশীদের গতি নাই। জীবনে ভারত মরনে ভারত। ভারতের মুভি স্টাইলে বাংলাদেশীরা বিয়া করে, ভারতের মুভি স্টাইলে বাংলাদেশীরা কাপড় পড়ে, ভারতের মুভি স্টাইলে বাংলাদেশীরা কথা বলে, ভারতের মুভি স্টাইলে বাংলাদেশীরা প্রেম করে।

বাংলাদেশে এককালে তাঁত ছিল এখন নেই। বাংলাদেশীরা শাড়ী পড়েনা । পাঞ্জাবের গ্রামের মানুষের মত মোটামোটা বাংলাদেশী মহিলারা সেলোয়ার কামিজ পড়ে। বাংলাদেশী মধ্য বয়সী মহিলারা মাথায় চাদর পেচিয়ে সেলোয়ার কামিজ চড়িয়ে হাটে আর সাথে ষোড়শী মেয়ে বুকের এক পাশে ওরনা ফেলে চুল খুলে হাটে। বুড়ি মায়ের মাথায় হিজাব আর ছুড়ি মেয়ের ওড়না ঢলে যায় । কারণ মেয়েকে বাজারজাত করতে হবে তাই তাকে সাজিয়ে গুজিয়ে ফেসবুকে শোভা বর্ধন করা হয়েছে ভাল একটি ছেলের কাছে গছিয়ে দেবার আশায়। বাংলাদেশ এখন এক অদ্ভুত দেশ।

বাংলাদেশ তুমি কার?
যে বিদেশী এসে প্রভু হবে – বাংলাদেশীরা তারই গোলাম!!
বাংলাদেশে বিদেশীরা দুইভাবে এসেছে । এক – সরাসরি উপনিবেশের মাধ্যমে । দুই – পরোক্ষভাবে উপনিবেশের মাধ্যমে। সরাসরি উপনিবেশের প্রভাব বাংলাদেশীদের মধ্য এত তীব্র যে এখন আর সরাসরি উপনিবেশ করার দরকার হয়না। দিল্লী থেকেই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমিকে খুব সহজেই সাড়া বাংলাদেশের জনগনের বিপুল সাড়া ও সহযোগীতার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রন করা যায়। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বিশ্বাস করে ভারত থেকে যদি হিজরত করে আসে তাহলেই ওরা সেলিব্রিটি হতে পারবে। ভারত থেকে যদি বই প্রকাশ করতে পারে, ভারত থেকে যদি গানের এলবাম প্রকাশ করতে পারে, ভারত থেকে যদি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে, ভারতের দাদা ও দিদিদের আশীর্বাদ ছাড়া নামীদামী হওয়া অসম্ভব – বাংলাদেশীদের মেধা ভারতের পদতলে দলিত মথিত এবং এভাবেই বাংলাদেশের মেধাবী প্রজন্ম ভারতের দাসত্বে নিজের করে ধন্য।

ভারতের তৈরি পন্যে সজ্বিত হয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশীরা প্রতি বছরের মত এ বছরেও বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উতযাপন করতে যাচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশীরা কাপড় খুলে বা হিজাব মাথায় দিয়ে হোলী খেলা করে।

বাংলাদেশে বাংলার ব্যবহার খুব কম। বাংলা বছরের ব্যবহারের প্রশ্নই উঠেনা। বাংলাদেশে শিক্ষার মান খুবই নিম্নমানের। বাংলাদেশীরা অনুকরণ প্রিয় । নিজস্ব কোন সাংস্কৃতি নাই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপনিবেশিক শাসকেরা যা নিয়ে এসেছে বাংলাদেশীরা তাই আবগাহন করেছে। ফলে নিজেদের জন্য কিছু নেই। নিজের জন্য আছে। বাংলাদেশীরা যখন বিদেশে আসে তখন সেলোয়ার কামিজ হিজাব পড়ে একাকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ না খেয়ে থাকে। নীচে বাংলাদেশের অর্থণীতির একটি ছোট্ট চিত্রঃ

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যংকের সমীক্ষা অনুযায়ী
বাংলাদেশে দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে ৩২% মানুষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার (১৫০,০০০,০০০)আনুমানিক ৪৮,০০০,০০০ জন মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। যদি সঠিকভাবে সমীক্ষা করা যেতো তাহলে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেতো। এর পরেই আসে মধ্যবিত্ত যারা থাকে শাঁখের করাতের উপরে। না খেয়ে থাকে কিন্তু সবাইকে বলে বিরিয়ানি খেয়ে আছে। বেকার থাকে, কিন্তু ভিডিও গেম খেলা করে, বেকার, কাজ নাই কিন্তু হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন আছে। কিভাবে সম্ভব? আমি জানিনা।
বাংলাদেশ একটি আমদানী নির্ভর দেশ। বেশীরভাগ পন্য আসে ভারত থেকে। ভারতের বেকার সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ন। বাংলাদেশে কিছু উৎপাদন না করে এবং বিদেশী পন্য বিশেষ করে ভারতের পন্যে বিক্রি করে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ভারতের পুঁজিপতিদের মুনাফা বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে যা সহজলভ্য তা হলো মিথ্যা, মৃত্যু, মাদক ও মদিরা।

শুভ নববর্ষ।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *