ঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেনীতে শ্রেনীতে পার্থক্য সব সমাজেই পরিলক্ষিত হয় । বর্ণবাদিতা, বৈষম্য প্রতিটি মানুষের বুকের ভেতর সুপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। কেউ তা জাগিয়ে দিলেই, সেই ঘৃনাতে একটু ঘি ছিটিয়ে দিলেই, সেই ঘৃনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।

আমি খুব ছেলেবেলা থেকেই আমাদের প্রতিবেশিদের বাসায়, আমাদের সমাজে ঘৃণা অপরাধ দেখেছি । আপনারা কেউ নিশ্চয় গৃহকর্মীর সাথে এক টেবিলে বসে এক সাথে খাবার খাবেন না, তাইনা? আমার বাসাতে কোনদিন কোন গৃহকর্মী ছিলনা যে নাকি আমাকে রান্না করে খাওয়াবে বা আমার কাপড় ধুবে বা আমার মেঝে পরিস্কার করবে। আমি নিজের কাজ নিজেই করি। আমি বিশ্বাস করি আমার ঘরের মেঝে সাফ করতে, আমার রান্না করতে আমার কাপড় ধুইতে আমি গৃহকর্মীকে যে টাকা দেবো আমি যদি নিজে কারু ঘরের মেঝে সাফ করতাম, কাপড় ধুইতাম, মশলা পিষতাম, রান্না করতাম তাহলে এত কম টাকাতে কাজ করতাম না। আমি নিজে যা করতে রাজী না সেই একই কাজ আমি অন্যকে দিয়ে করাতে যাবো এই কারণে যেহেতু ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নেই। চারিদিকে দরিদ্র মানুষ একটু কাজের জন্য ব্যাকুল। অনেকেই ভিক্ষা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। যেমন তেমন একটা কাজ পেলেই সেটা করে জীবিকা নির্বাহ করতে চান আর তাদের এই অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমরা যারা “ঘৃণা” বুকে ঘুমিয়ে রাখি তারা সুযোগ পেলেই এই “ঘৃনা”কে জাগ্রত করি।

একজন গৃহকর্মীকে আপনি কি সন্মান করেন? করেন না। তার জন্য বাসন আলাদা, থাকার জাগা আলাদা, বসার জন্য মেঝে বা পেছনের বারান্দা, তার পোষাকও আপনার মত না। আপনার বাসাতে গেলেই যেকেউ বুঝবে যে মেয়েটি শুখনো মুখে খালি পায়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সেই মেয়েটি বা মহিলাটি আপনার বাসাতে ঝিয়ের বা বুয়ার কাজ করে। আপনার ছেলেমেয়েবউস্বামীর পোষাকের চাইতে সে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পোষাক পরিধান করে। এইখান থেকে শুরু হয় বৈষম্য । ঘর থেকেই শুরু হয় বৈষম্য। একজন মানুষের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিয়ে আপনি তাকে যে মজুরী দিচ্ছেন সেই একই মজুরী আপনাকে দিলে সেই একই কাজ আপনি করতেন না।

আপনি নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করেন। অথচ ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাঃ নিজে একজন এতিম ছিলেন, দরিদ্র ছিলেন, অন্যের ব্যবসাতে কর্মচারী ছিলেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়ে গেছেন সাম্যের, ভাতৃত্বের, শ্রমিকের ঘাম মাটি স্পর্শ করার আগেই তার মজুরি পরিশোধ করার। তার সাথে খাবার ভাগ করে খেতে ও তাকে ঠিক একইভাবে রাখতে যেভাবে আপনি নিজে থাকেন। হজরত ইব্রাহীম আঃ এর স্ত্রী ও সন্তানের মা একজন দাসী ছিলেন। আপনি নিজেকে মুসলমান দাবী করে অনেক কিছুই করতে পারেন না। আপনার বাসাতে যে আপনার ঘরের কাজ করতে আপনার স্ত্রী বা মাকে সাহায্য করে তাকেও আপনি সেইভাবে রাখবেন যেভাবে আপনার মা বোনেরা থাকে। কারণ সে যে ধর্মেই বিশ্বাসী হোক না কেনো আপনি যেহেতু নিজে একজন মুসলমান তাই তার প্রতি আপনার আচরণ একজন মুসলমানের মত হতে হবে। আপনি আল্লাহ্‌ ও রাসুলের নির্দেশ পালন করবেন। আর যদি তা না করেন তাহলে আপনি মুসলমান না। নাম বদলে ফেলুন । খামাখা নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করবেন না।

আপনার বাসাতে যদি চতুর্থ শ্রেনীর বাংলাদেশী আইডলের একজন বিচারক চতুর্থ শ্রেনীর হেরেগলা গায়িকা রুনিমেহ যদি বেড়াতে আসে আপনি তাকে ঘরের কোথায় বসাবেন বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে যাবেন অন্যদিকে একজন মানুষ যদি আপনার বাসাতে ঝিয়ের কাজ করে আপনি অনেক আগেই জানেন সে আপনার বাসাতে কোথায় কোথায় প্রবেশ করতে পারবে, কোথায় বসতে পারবে আর কোথায় বসতে পারবেনা। রুনিমেহর সাথে আপনার বাসার কাজে বুয়ার কি কোন পার্থক্য আছে? নেই। আপনি যদি একটু ভালভাবে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন আপনার কাজের বুয়ার চেহারাতে রুনিমেহর চেহারার চাইতে অনেক বেশী গ্লামার আছে। রুনিমেহ যদি আপনাকে না জানিয়ে আপনার বাসার দরজাতে এসে নক করতো তাহলে আপনি হয়তো তাকে কাজের বুয়া ভেবে ভুল করতেন। সেজন্য চেহারা দেখে নয় অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারনেই সমাজে মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। যার টাকা আছে তাকে সবাই আদোর করে । যার টাকা নাই, টাকার জন্য যে আপনার মেঝে সাফ করে তাকে আপনি বুকে টেনে রাখেন না, মাথায় তুলে রাখেন না, মেঝেতে এক কোনে ফেলে রাখেন। রুনিমেহরের গানের রেকর্ড বাজিয়ে শুনেন যদিও শ্রুতিকটু তবুও অনেকেই হেরে গলার গান ভালবাসে।

কোন মানুষকে তার পেশার কারণে ঘৃণা করাও সাম্প্রদায়িকতা বা ঘৃণা অপরাধ। কোন মানুষকে তার পেশাগত উঁচুনিচুর কারণে আপনি যদি তাকে দূরে রাখেন তাহলে আপনি বৈষম্য সৃষ্টিকারী। তবে এই বৈষম্য সমাজে স্বীকৃত। আপনি একজন বিশাল চোরের ছেলে, আপনার বাপে ঘুষ খেয়ে বিশাল বিশাল দালান,সপিংমল ইত্যাদি দিয়েছে, আপনাকে প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ইঞ্জিয়ার বানিয়ে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে পাঠিয়েছে কাজ করার জন্য আপনি সেখানে বিশাল সফটওয়ার ইঞ্জিয়ার, অনেক ডলার বেতন পান কিন্তু আপনার চামড়ার রং ঠিক পেছনে দেশে ফেলে আসা গৃহকর্মীর মত বা আপনার বাসার ড্রাইভারের মত কালো । আপনি মদের দোকানে বসে মদ পানে ব্যস্ত । সেই মদের দোকানে অনেক সাদারা এসেছে। সবাই মদ পানে ব্যস্ত হঠাৎ এক সাদা এলো এক বন্দুক নিয়ে। আপনাকে তাক করে গুলি ছুঁড়ে বললো – আমাদের দেশ থেকে বেড় হয়ে যাও। আপনি ঠিক যেভাবে আপনার বাসার গৃহকর্মীকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন বা নির্যাতন করেছেন বা খারাপ ব্যবহার করেছেন ঠিক একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ডে আপনাকে আপনার কালো রং দেখে স্বেতাঙ্গরা আপনাকে ঘৃণা করে।

সেদিন মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে একজন ভারতীয় ইঞ্জিয়ারকে একজন মার্কিন শ্বেতাঙ্গ গুলি করে হত্যা করে সগর্বে “মুসলমান হত্যা” করেছে বলে উল্লাস করে। সেই ভারতীয় ইঞ্জিয়ার মুসলমান ছিলনা। হিন্দু ছিল। এই ঘৃণা এই শ্বেতাঙ্গের বুকে সুপ্ত ছিল । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাতটি মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকদের মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করার পরে মার্কিন নাগরিকেরা যাদের বুকের ভেতর ঘৃণা ঘুমিয়ে ছিল সেইসব ঘৃনারা এখন জেগে উঠেছে।। পথে, বাসে, ট্রাফিক লাইটে এরা কালোদের প্রতি “ঘৃণা” প্রকাশ করছে। পুলিশি নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। যে যেমনভাবে পারছে, যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই তাদের জাগ্রত ঘৃনার প্রকাশ করে রাস্ট্রিয় অনুমতিতে ঘৃণা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের অনেক অনেক অনেক বাসাতে গৃহকর্মীর উপরে নির্যাতন করা হয়। একবার শেখ মুজিবের এক সময়ের আইনি উপদেষ্টা ডঃ কামাল হোসেনের বাসাতে গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হলে কারু বিচার হয়না। কারণ ডঃ কামাল হোসেন শেখ মুজিবের জন্য ভারতের মনের মাধুরী মিশিয়ে বৃটিশ আমলের আইনের ফ্লেভারে বাংলাদেশের সংবিধানের রচনা করেন। একজন সংবিধান লেখকের বা আইনজীবির স্ত্রী বা পরিবারের সদস্য যদি একজন গৃহকর্মীকে হত্যা করে তাহলে শেখ মুজিবের আমলের মত সময়ে যখন যেখানে সেখানে মানুষকে পিটিয়ে মারা, বা ধর্ষন করে হত্যা করা বা ডাকাতি করতে যেয়ে হত্যা করা বা গুলি করে হত্যা করা বা কান কেটে ফেলা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যাচ্ছিল তখন ডঃ কামাল হোসেনের বাসার গৃহকর্মিকে হত্যার ব্যাপারটাকে সহজেই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। সেটা ঘৃণা অপরাধ বা কোন অপরাধ হিসাবেই আদালতে পৌছেনি।

ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে দেখা যায় হিন্দুদের সম্পর্কে বিষাদাগার। অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা, ঘৃণা প্রদর্শন, সমালোচনা করা, বা অন্য ধর্মে বিশ্বাস করার জন্য কোন মানুষকে অশ্রদ্ধা করা ইসলাম ধর্মে সম্পুর্নভাব নিষিদ্ধ।

সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণা অপরাধ দেখার জন্য সাউথ আফ্রিকাতে যাবার দরকার নেই, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে যাবার দরকার নেই এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও যাবার দরকার নেই। গণজাগরণ মঞ্চের কথা স্বরণ করে আপনার নিজের বুকে তাকিয়ে দেখুন – সেখানেই ঘুমিয়ে আছে “ঘৃণা অপরাধ ও সাম্প্রদায়িকতা”। আপনার ঘরের আশেপাশে আপনার ফেসবুক স্টাটাস আর ট্যাগ করা বা আপনার বন্ধুর ট্যাগ করা গ্রাফিক ছবি ও ভিডিওগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন । আপনি সাম্প্রদায়িকতা উপভোগ করেন। মানুষের উপরে মানুষ নির্যাতন করছে এইসব ছবি, এইসব ভিডিও দেখতে ও ট্যাগ দিতে আপনি পছন্দ করেন। যখন একজন মানুষকে বেশ কিছু মানুষ রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করে তখন আপনি আপনার মোবাইলে সেটা রেকর্ড করে ফেসবুকে পোষ্ট করেন । চারিদিকে দাঁড়িয়ে যারা মোবাইলে এই ঘটনা রেকর্ড করে তারা সবাই যদি রেকর্ড না করে এই খুনীদের বাঁধা দিতো তাহলে এই হত্যার দৃশ্য রেকর্ড করার দরকার হতোনা, এই মানুষটি জীবিত থাকতো। এই দৃশ্য রেকর্ড করার মন মানসিকতা যাদের আছে তাদের ভেতর লুকিয়ে আছে একটি নিষ্টুর মানুষ, একজন খুনী, একজন কাপুরুষ।

বাংলাদেশীরা সবাই বাংলাদেশী। কেউ চীন থেকে এসে বা কানাডা থেকে এসে বা ইউরোপ থেকে এসে বাংলাদেশে বসবাস করেনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের হত্যা করছেনা। যারা কালো তাদের হত্যা করছে। তাদের প্রতি ঘৃনার আগুন ছুঁড়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশীরা সবাই বাংলাদেশী হওয়া সত্বেও এঁকে অন্যকে ঘৃণা করে এবং ক্ষতি করার চেষ্টা করে। ঘৃনা ও বৈষম্য বাংলাদেশের সমাজের একটি স্বাভাবিক চিত্র । ঘৃনা অপরাধ বাংলাদেশীদের জাতীয় চরিত্র।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *