রাগ – উপায়হীনতার প্রকাশ

আমি প্রায়ই রাগ করি। আমি আমার রাগের কারণগুলো জানি। বলতে পারি। আমি কখন রাগ করি। কেনইবা রাগ করি। রাগ শরীরের ক্ষতি করে এটা আমি জানি। কিন্তু যখন রাগ করি তখন সেটা আমার মনে থাকেনা। কারণ রাগ অগ্রিম নোটিশ দিয়ে আসেনা। সংসারে সবার ছোট হবার ফলে আমার ভেতর এক ধরণের ধারণা জন্মেছিল যে সবাই আমাকে অবহেলা করছে। ধারণাটি নিছক অমূলক ছিলনা। একটি সাত আট সন্তানের পরিবারে প্রথম সন্তান সব চাইতে বেশী আদোর পায়। তারপর যারা জন্মে তাদের আদোর ক্রমশঃ কমতে থাকে। আর যে সব চাইতে ছোট আর বেজোড় সে হয়ে যায় সব চাইতে অবহেলিত অথচ অফিশিয়ালী সে হয় সব চাইতে আদোরের। এটা লোক শোনানো কথা। সব চাইতে ছোট যে সে কবে বড় হবে এইটা ভেবে মাবাবা অনেক বিরক্ত হন। সেজন্য আমি সব ভাইবোনদের টপকে বড় হয়ে গেছিলাম। বড় বড় ভাইবোনদের আগে আগে বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে চাকুরী করে, ডিগ্রী অর্জন করে একেবারে সোজা বাসা থেকে বের হয়ে যেয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম আসলে সবার ছোটরা সব চাইতে আগে সব চাইতে বড় সন্তানের ভূমিকা পালন করতে পারে। ছোট বেলাতে আমি অনেক রাগ করতাম। এইভাবে আমি বুঝতে পারি – ভালবাসা না পেলে আমি রাগ করি। কেউ আমাকে ভাল না বাসলে আমি খুব সহজেই বুঝতে পারি। কেউ যদি আমাকে করুনা করে সেটাও আমার রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই আমা্র সাথে ভালবাসার অভিনয় করে সেটাও আমি সহ্য করতে পারিনা। তবে আমি যাদের ভালবাসি তারা যখন আমাকে অবহেলা করে বা এড়িয়ে যায় তখন আমি খুব রেগে যাই। তখন আমার মনে হয় তাদের জন্য আমার সব ভাল চাওয়া সব ভালবাসা সব দুশ্চিন্তা সব ভাবনা সব কিছু সব সময় সব মুহুর্ত আমি পুনঃরায় ফিরিয়ে বা ছিনিয়ে নিয়ে এসে সেই আগের জাগাতে নিয়ে যাবো যখন আমি তাদের কারুকে চিনতাম না জানতাম না। আমি সেটা পারিনা। ফলে আমি রেগে যাই। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ভালবাসা এক দুর্লভ অনুভূতি। কানের কাছে বন্দুক রেখে কেউ ভালবাসা আদায় করতে পারেনা। হৃদয়ে ভালবাসা নিয়ে সবাই জন্মগ্রহন করেনা যদি করতো তাহলে কেউ কসাই পেশাতে যেতে পারতোনা এবং দুনিয়ার মানুষেরা সব নিরীহ পশু না খেয়েই জীবনযাপন করতো।

কোন কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা আর সেইসব কিছু কিভাবে পাওয়া যাবে, সেইসব কিছু কোথায় পাওয়া যাবে, বা সেইসব কিছু পাবার যোগ্যতা নিজের আছে কিনা তা অজানা থাকে অজ্ঞতার কারনে অথবা অহংকারের কারনে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেকে সচেতন করার অক্ষমতা থাকতে পারে। মেঘ যেমন রোদ ঢেকে রাখে তেমনি অজ্ঞতা ও অহংকার মগজের অর্ধেকটা ঢেকে রাখে । শুধু জেগে থাকে সেইসব কিছু প্রাপ্তির আকাংক্ষা। একজন সফল মানুষ সব চাইতে প্রথমে যা করে তা হলো নিজের মূল্যায়ন।কোন একটা ভাল রান্না রাধতে গেলে একজন ভাল রাধুনী দেখে নেন সেই রান্নাটি করার জন্য যেসব রসদ দরকার হেসেলে সেইসব রসদ আছে কিনা। নাহলে রান্না শুরু করে যখন দুই একটা কাচামাল পাওয়া যাবেনা তখন হয় সেই রান্না মনমত হবেনা বা অর্ধেক রান্না বসিয়ে দিয়ে রাধুনীর মন খারাপ হবে আর যা কিছু দিয়ে রান্না শুরু করেছিলেন সবই নষ্ট হবে। এমনও হতে পারে অন্য একজন রাধুনী যা কিছু হাতের কাছে আছে তা দিয়ে পরিকল্পিত রান্নাটির চাইতেও ভাল অন্য একটি রান্না উদ্ভাবন করতে পারেন। আর এই উদ্ভাবনী শক্তির জন্য সৃজনশীলতার দরকার। নিয়মের বাইরে চিন্তা করতে হবে। গত বাধা শৃংখল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগের মানুষজন যা কিছু আমাদের দিয়ে গেছেন তা নিয়েই যদি আমরা পড়ে থাকি তাহলে আগামীতে যারা আসছেন তাদের জন্য আমরা কি রেখে যাবো ?এই আকাঙ্ক্ষিত জিনিষটি না পাওয়া গেলে অনেকেই রাগ করেন । এই জিনিষটি না পেলে যত ক্ষতি হয়েছে তার চাইতে বেশী ক্ষতি হয় এই “রাগের” কারনে। তাই প্রথমে নিজের যোগ্যতাকে জানতে হবে। নিজেই নিজের মূল্যায়ন করতে হবে। ছোটবেলায় আমরা শিখেছিলাম “সমালোচনা আত্মসমালোচনা”। এইটা শেখানো হয়েছিল এই কারনে যাতে আমরা নিজেদের দোষগুলো ঢেকে না রেখে খুলে দেখি আর সেগুলোর কারনে নিজেদের কি কি ক্ষতি করছি তার একটি তালিকা প্রস্তুত করি আর সেইগুলো শুদ্ধ করতে থাকি নিয়মিতভাবে যাতে নিজের কারনে নিজে ও অন্যান্যদের ভুগতে না হয়।  নিজের যদি যোগ্যতা না থাকে তাহলে নিজেকে যোগ্য করার জন্য সময় নিতে হবে। সেজন্য রাগ নয় ধৈর্য দরকার। অনুশীলন দরকার। শান্তি দরকার।  শৃংখলা দরকার। যদি শৃংখলা না থাকে তাহলে নিজেকে যোগ্য করার লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবেনা। মাঝপথে রাগ এসে সব ধ্বংস করে দেবে। নিজের পরিকল্পনা নিজের রাগ দিয়ে তছনছ হয়ে যাবে। একজন বুদ্ধিমান মানুষ কখনো অন্যকে নির্বোধ ভাবেনা। কারন কোন মানুষই নির্বোধ নন। সবার সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান থাকেনা। প্রতিটি মানুষই তাই অসম্পুর্ন জ্ঞানের অধিকারী আর সেই অসম্পুর্নতার অর্থ নির্বুদ্ধিতা নয়। আমি একজন রাগী মানুষ। আমার আকাংক্ষা সীমাবদ্ধ। আমি যখনই আকাশ স্পর্শ করতে যাই, পারিনা যেহেতু আমি আকাশের ঠিকানা জানিনা। কোন ট্রেনে যেতে হবে জানিনা। তখন আমি হতাশ হয়ে যাই। চীৎকার করি। গালি দেই। নিজের এই ব্যর্থতার জন্য দোষারোপ করতে আমি একজন মানুষ খুঁজি। যার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সমাজ যাকে সহজেই গ্রহন করেনা। সেই মানুষকে আমার দরকার যাকে আমি ব্যবহার করতে পারবো আমার সব ব্যর্থতার জন্য দোষারোপ করবো বলে। আমার সব ব্যর্থতার জন্য আমি নিজেকে ছাড়া অনেককেই দোষারোপ করেছি। শুধু নিজেকে করিনি। কারন আমি নিজেকে অনেক ভাল মনে করি। আমি মনে করি আমার উপরে সবাই অত্যাচার করছে। আমার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছেনা। আমি অনেক বড় কিন্তু সেটা কেউ বুঝতে পারেনা।  আর সেকারনেও আমার অনেক রাগ হয়। এখানে আমি আত্মসমালোচনা করছি।  আসলে আকাশ স্পর্শ করার আমার কোন ক্ষমতা নাই। তাই তা না করতে পারলে হতাশ হবার কোন কারন থাকতে পারেনা। অনেক কিছুই আমি করতে পারিনা। আমার যোগ্যতা নাই বা ক্ষমতা নাই। কারুকে দোষারোপ করার জন্য ব্যবহার করার অধিকার আমার নাই। তাই এইসব  কিছু না করতে পারলে হতাশ হবারও কোন কারন নাই। আশা করবোনা তাহলে না পাবার বেদনা থাকবেনা । হতাশ না হলে রাগও হবেনা। আর রাগ না হলেই আমি সুখী হবো । আমি তো বেশীদিন বাঁচবোনা। জীবনের এই স্বপ্ল সময়ে রাগ করে কি লাভ ? সময় নষ্ট। মগজের অর্ধেকটা রাগ দিয়ে ঢেকে রাখলে আমার চেহারা অনেক কুৎসিত দেখায়। এই সব আকাঙ্ক্ষার জন্য বা পাবার ইচ্ছার জন্য আমি অনেক মিথ্যা বলি। আর এইসব মিথ্যাগুলো অন্য কোন মানুষের ক্ষতি করতে পারে। আমি সেটা ভাবিনা। ছলে বলে কৌশলে আমি আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যস্ত থাকার ফলে অনেক মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয় সেটাকেও আমি নানা অজুহাতে ঢেকে রাখি। আমার কাছে অনেক অজুহাত আছে। আমার পরিকল্পনাগুলোকে সঠিক হিসাবে প্রতিষ্টিত করার জন্য আমি অনেককে আঘাত করি । কিন্তু কেউ সেটা বুঝতে পারলে আমি প্রতিরক্ষা কৌশল অবলম্বন করে নিজেকে একটি “অবস্থার শিকার” হিসাবে প্রতিষ্টিত করতে চেষ্টা করি। এইসব কিছুর জন্য দোষারোপ করব বলে যে ডিফেক্টিভ ও সমাজ থেকে বিতারিত মানুষটিকে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলা আমি খুজছি তাঁকেই আমি দোষারোপ করবো পরিশেষে। সে যদি প্রতিবাদ করে তাহলে তাকে রাগ দেখিয়ে চীৎকার করবো তখন সে ভয় পেয়ে যাবে আর কোনদিন প্রতিবাদ করবেনা। তার উচিৎ সব কিছু চুপচাপ সহ্য করা ।

যাক রাগের কারনে আমার যেসব ক্ষতি হচ্ছে সেগুলোর একটা তালিকা প্রস্তুত করা যাক। এই তালিকা থেকে আমি কিছুই শিখবোনা। কারন আমি রাগ করতে ভালবাসি। আমি মনে করি আমার রাগের কারনে আমার কোন ক্ষতি হবেনা। আমি একদিন সফল হবো এবং আমার যারা শত্রু তাঁদের আমি ধ্বংস করে দেবো । আমি নিজে ধ্বংস হয়ে যেতে পারি আর সেটা রাগ না করলেও হতে পারে । রাগ হলে নিম্ন বা উচ্চ রক্তচাপের মানুষের কপালের শিরা ছিড়ে যেতে পারে বিশেষ করে রাগ হয়ে চীৎকার করলে। স্ট্রোক হতে পারে। নিম্ন ও উচ্চ রক্তচাপের মানুষের স্ট্রোক হবার সম্ভাবন বেশী তাই এই দুই ধরনের মানুষেরই রাগ ও চীৎকার সম্পুর্নভাবে পরিহার করা উচিৎ। রাগের ফলে মাথা ব্যাথা করে আর সেটা মাইগ্রেইনে রুপ নিলে মাথা ব্যাথা এক নাগাড়ে বাহাত্তর ঘন্টা থেকে এক সপ্তাহ থাকতে পারে। রোদে গেলে যেমন  মাথা গরম হয়ে যায় তেমনি রাগ করলে মাথা গরম হয়ে যায় আর তা থেকে এই মাথা ব্যাথার কারন হতে পারে। রাগী মানুষদের ব্রেইন টিউমার হয় বা যাদের ব্রেইন টিউমার হয় তারা রাগ করে । ব্রেইন টিউমার মাথার ভেতরে অনেক অনেক বছর থাকতে পারে। আর সেই টিউমার বড় হয়ে একটিভ হতে দশ থেকে ত্রিশ বছর লাগতে পারে। যারা রাগ করে তারা অনেক কথা মনে রাখতে পারেনা। কারন রাগ করলে স্বরনশক্তির ক্ষতি হয়। রাগী মানুষের সাথে অনেকেই বসবাস করতে চায়না। এড়িয়ে চলে। রাগী মানুষদের কেউ বিশ্বাস করতে চায়না। সবাই ভয় পায়। রাগ শান্তি ও পরিবেশ দূষিত করে তাই এই থেকে দূরে থাকা ভাল। আমি সব সময় একা একা থাকি কারন কোন কারনে আমি যদি রেগে যাই তাহলে চীৎকার করি । কেউ না থাকলে আমি চীৎকার করতে পারিনা। একা একা আমি চীৎকার করিনা বরং রাগ সম্পর্কে রচনা লিখি।রাগ পরিহার করুন। আমি চেষ্টা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.