উৎসর্গ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি
আপন গন্ধে মম
কস্তুরীমৃগসম।
ফাল্গুনরাতে দক্ষিণবায়ে
কোথা দিশা খুঁজে পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।
বক্ষ হইতে বাহির হইয়া
আপন বাসনা মম
ফিরে মরীচিকাসম।
বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে
বক্ষে ফিরিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।
নিজের গানেরে বাঁধিয়া ধরিতে
চাহে যেন বাঁশি মম
উতলা পাগলসম।
যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর
রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।
উৎসর্গ কবিতা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বোঝাতে চেয়েছিলেন আমার জানা নেই। তবে পাওয়ার ভাগ্য আমার ভাল না তাই বেশী আশা প্রত্যাশা করিনি কোনদিন। স্বপ্ন দেখার অভ্যাসও নেই। বছরে হয়তো একটা বা দুইটা দুঃস্বপ্ন দেখি। মাবাবাভাইবোন যারা মারা গেছেন তাদের দেখি। চাইনা তাই পাইনা। সেটাও ঠিকনা। জানি পাবোনা তাই প্রত্যাশা ছেড়ে দিয়েছি। এমনো হতে পারে আমি আশা ভঙ্গের বেদনা সইতে পারবোনা তাই স্বপ্ন দেখিনা। তবে আমি দিবাস্বপ্ন দেখি। আচ্ছা এমন যদি হতো, অনেক আগে আমি যখন কিছু চাইতাম তখন যদি সেইসব আশা পূরণ হতো তাহলে কি আমি বলতাম – “এইসব আমি চাইনি” ? ছোটবেলাতে যখন আমি অর্থনীতির টেক্সটবই পড়তাম তখন আমার খুব আনন্দ লাগতো এই কারণে যে এই বইয়ে যা যা লেখা আছে সব আসলে আমার মনের মত। যেমন চাহিদা ও যোগানের তত্ত্ব। আমি এখজন নিম্ন আয়ের মানুষ । সুতারাং আমি সব সময় কম দামী বাজারে কেনাকাটা করি। যেকোন একটি বাজারে একটি নির্দিষ্ট পন্য যদি সেই বাজারের ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেওয়া হয় তাহলে হয়তো এই একই পন্যতে ভোক্তাদের একঘেয়েমি লেগে যাবে। যোগান বৃদ্ধি পাবে, চাহিদা কমে যাবে এবং পন্যের মুল্য কমে যাবে। সেইজন্য কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। যোগান কমিয়ে দেওয়া হয়। মূল্য বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। ভোক্তারা সেই পন্য কেনার জন্য বারে বারে বাজারে আসে, লাইন দেয়, অর্ডার দিতে থাকে, তখন ব্যবসায়ীরা দ্যাখে বাহ! বেশ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এই সুযোগে পন্যের মূল্য বৃদ্ধি করলে বেশ লাভ করা যাবে। যেই মূল্য বৃদ্ধি করে অমনি ভোক্তারা বিকল্প পন্য কেনার জন্য অন্য দোকানে চলে যায়। বাজারে সেই পন্যের উৎপাদক যারা তাদের ভেতরও প্রতিযোগীতা রয়েছে। সুতারাং তারা যখন দেখছে একটি পন্য বাজারে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে তখন তারা একই পন্য ভিন্ন মোড়কে কিছুটা অন্যরকম বৈশিষ্ট রেখে চমকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাজারজাত করছে ফলে সেই ব্যাপক চাহিদার পন্যটির ক্রেতা কমে যাবে। ক্রেতারা ধীরে ধীরে এই নতুন পন্যের উপরে নির্ভরশীল হওয়া শুরু করবে। বাজারে সব পন্য কিন্তু এমনভাবে বিক্রি হয়না। অনেক ভোক্তা আছেন যারা দীর্ঘ দিন ধরে একই পন্য কিনে অভ্যস্ত। কারণ তাঁরা এই পন্যের ভাল গুনাবলী থেকে লাভবান হয়েছেন। যে ব্যবসায়ীরা এইভাবে যুগ যুগ ধরে ক্রেতা ধরে রাখে তারা বাজারে শুধু মুনাফাই করেনা বরং যুগ যুগ ধরে ব্যবসায়ে টিকে থাকে। যেসব ব্যবসায়ীরা রাতারাতি মুনাফা করে ধনী হতে চায় তাঁরা রাতারাতি আবার ফকিরও হয়ে যায়।
সংসারে আমরা কি দেখি? স্বামী স্ত্রী যখন দুইজনেই বাইরে চাকুরী করেন তখন স্বামীর কাছে সেই উপার্জনক্ষম গৃহীনি একটি মালটি টাস্কিং মেশিন (Multi-tasking machine) বা বহুবিধ কর্মক্ষমতা সম্পন্ন উৎপাদক বা যন্ত্র। যেমন স্ত্রী বাইরে দশ ঘন্টা কাজ করে ঘরে ফিরে ধোয়া মোছা রান্না বাচ্চার দেখাশোনা সব যদি করে আর স্বামী যদি কাজ করে এসে শুধু খায় আর টিভি দ্যাখে তাহলে এই গৃহীণি একটি মালটি টাস্কিং মেশিন। তারপর স্বামীর হয়তো এই গৃহীনিকে পছন্দ নাও হতে পারে। হয়তো তার ব্যস্ততার কারণে তাঁকে কাছে না পাওয়ার কারণে অথবা জৈবিক চাহিদাতে অন্য কোন প্রতিযোগীর কাছ থেকে সহজলভ্য যোগান পাবার জন্য ধীরে ধীরে এক শূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। আপন গন্ধে মম। কস্তুরীমৃগসম। যাহা আছে তাহা তো থাকবেই। পেতে পেতে একঘেয়েমি এসে যায়। নতুন কিছু চাই। যাহা চাই তাহা পাইনা।
চাহিদা আর যোগানের তত্ব তবু এক মোহনীয় যাদু সৃষ্টি করে সবার সময় বেয়ে সবার কাঁধে টোকা দিয়ে স্মিত হাস্যে কোলে এসে বসে আকাশ দ্যাখে।
টাকা এমন এক অদ্ভুত জিনিষ। যখন হাতে টাকা থাকেনা তখন মনে হয় একবার যদি টাকা হাতে পাই তাহলে আর এই টাকাকে হাত থেকে যেতে দেবোনা। আর যখন হাতে টাকা এসে যায় তখন কিভাবে এই টাকাকে হাত থেকে বিদায় করবো তার জন্য ব্যস্ত হয়ে দোকানপাটে ঘুরাঘুরি অনলাইনে কেনাকাটা শুরু করি। তারপর আবার যখন হাত খালি হয়ে যায় তখন কেনাকাটা জিনিষপত্র অসহ্য মনে হয়। মনে হয় অমুকটা কেনা উচিৎ ছিল তমূকটা কেনা উচিৎ ছিল। এইসব অমুক তমুকের কোন দরকার থাক বা না থাক, কাজে লাগুক বা না লাগুক, দোকানে আছে, বাজারে এসেছে সবাই কিনছে তাই আমিও কিনে একটু আত্মতৃপ্তিবোধ করলাম এইতো। আত্মাকে তৃপ্ত করার জন্যই তো দিনরাত এত পরিশ্রম করছি।
তারপর আছে আয়ের চাইতে বেশী করে ব্যয় করার অভ্যাস। তা হলো ঋন। ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋন করে জিনিষপত্র কেনাকাটা আর তারপর বিশাল এক ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে তা সাফ করা। কেনার সময় মনেই থাকেনা এইসব কথা। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই। যাহা পাই তাহা চাইনা।
ক্রেডিট কার্ড কোম্পানীগুলোর স্বপ্ন দ্যাখে কোটি কোটি মানুষ ক্রেডিট কার্ড নিবে। ঋনে জিনিষপত্র কিনবে তারপর পুরা বেতনের টাকা ক্রেডিটকার্ডের ঋন পরিশোধের জন্য খরচা করবে।এইভাবে ক্রেডিট কার্ড কোম্পানীগুলো মুনাফা করবে। ব্যবসায়ীদের পণ্য বিক্রি হবে। নির্বোধ স্বল্প আয়ের দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তাদের উপার্জনের সিংঘভাগ বিভিন্ন কর্পোরেশনের মুনাফার জন্য বিলিয়ে দিবে।এইসব উপার্জনকারীরা একদিন অবসর নেবে তখন অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে লাথিঝাটা খেয়ে জীবনের সব চাইতে অবহেলিত শেষ জীবন অতিবাহিত করবে।
বক্ষ হইতে বাহির হইয়া আপন বাসনা মম ফিরে মরীচিকাসম।
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা