নতুন বছরে এখনো সেই পুরাতন পৃথিবীতেই আছি। পৃথিবী বদল হয়নি। আমরাও কেউ রাতারাতি বদলে যাবোনা যদি ইচ্ছা না করি যদি বদলে যাবার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি। নতুন বছরে শুভেচ্ছা বিনিময়ে কোন লাভ নেই। বর্তমান অবস্থা যদি অপ্রত্যাশিত হয় যদি এই অবস্থায় আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না ঘটে তাহলে এই অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য চিন্তাভাবনা করতে হবে আর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জীবন সংক্ষিপ্ত। নতুন বছর সংক্ষিপ্ত জীবনকে আরো সংক্ষিপ্ত করছে। কালকে যা আশা করা গেছিল, কাল যে স্বপ্ন ছিল, কালকে সেই স্বপ্ন পূরণ করার যে সুযোগ ছিল আজ সে সুযোগ হয়তো তেমনভাবে নেই। সেই সুযোগ হয়তো হাত ছাড়া হয়ে গেছে তাই সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে বা স্বপ্নকে পরিবর্তন করতে হবে। সেই স্বপ্ন দেখতে হবে যা সুন্দর জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়। সেই স্বপ্ন যা পূরণে অন্য কারু চোখ থেকে স্বপ্ন ছিনিয়ে নেবেনা। সকলের স্বপ্ন পূরণে একে অন্যকে সহযোগীতা করতে হবে। এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছুরই প্রয়োজন আছে বলেই আছে। সবার অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে, আর সেই শ্রদ্ধা করতে হবে কাজের মাধ্যমে। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে।
মানুষ হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হলো প্রকৃতিকে রক্ষা করা, প্রানীকে রক্ষা করা, পরিবেশকে সুন্দর রাখা, আইন মেনে চলা আর আইন যদি আপামর জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ না করে তাহলে সেই আইন ভেঙ্গে ফেলে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষন করবে এমন আইনের প্রতিষ্টা করা। সবচাইতে আগে যা দরকার তা হলো নিজের যত্ন নেওয়া আর নিজেদের রক্ষা করতে যেয়ে অন্যকে ধ্বংস না করা।
আজকে আমরা পুরানা বছরে দাঁড়িয়ে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করি যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার পুনঃগঠন দরকার। বিচার ব্যবস্থায় যারা অপরাধী আছে সবাইকে আইনের আওতায় এনে ন্যায় বিচারের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর সকল অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ফলে বিচার বিভাগ ও আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর কেউ আর কোন দিন অপরাধ করার স্পর্ধা দেখাতে না পারে।
বাংলাদেশে সব চাইতে আগে যা দরকার তা হলো “মানবাধিকার ও স্বাধীনতা” । মানবাধিকার ও স্বাধীনতা কেউ হাত তুলে দেয়না, আদায় করতে হয়। বাংলাদেশীরা বাংলাদেশীদের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা আদায় করার মত যোদ্ধা হয়ে উঠেনি। পিঠ দেওয়ালে লেগে গেছে তবুও সবাই অপেক্ষায় আছে সেই হেলিকপ্টারের যা দড়ি ফেলে দেবে সেই দড়ি ধরে উঠে ওরা সবাই নিরাপদ স্থানে পৌছে যাবে।
বাংলাদেশসহ সাড়া বিশ্বে বাংলাদেশী নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশের সীমান্তে বিদেশীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হওয়া দরকার, বাংলাদেশে যেসব বিদেশী পণ্য বিক্রি হয় তার উপরে উচ্চ হারে শুল্ক আদায় করা দরকার। সেই শুল্কের টাকা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋন দেবার কাজে ব্যবহার করা দরকার যাতে ব্যবসায়ীরা দেশের চাহিদা অনুপাতে উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। বিদেশী পন্য বিক্রির দালাল হবার চাইতে নিজেই উতপাদক হতে পারে। বিদেশে যেয়ে শ্রমিক না হয়ে দেশের উৎপাদনের শ্রমিক হয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে যাতে বিদেশীরা দেশে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে আসে।
খুব অবাস্তব স্বপ্ন দেখে ফেললাম। স্বপ্নই তো!! দেখতে দোষ কি! যদি স্বপ্নই দেখবো ভাল স্বপ্নই দেখি। দুঃস্বপ্ন কেনো দেখবো? ২০১৬ সালে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি বাংলাদেশে তাই ২০১৭ সালেও তেমন কোন পরিবর্তন আসবেনা। শুধু কিছু মানুষের মৃত্যু ছাড়া। কিছু নিরীহ মানুষের জেল, জরিমানা, নির্যাতিত হওয়া ছাড়া। কিছু মানুষে বসত হারিয়েছে, কিছু মানুষে বিধবা হয়েছে, কিছু ছেলেমেয়ে এতিম হয়েছে, কিছু নারী দেহ বিক্রিতে নেমেছে, কিছু নতুন শিশুর জন্ম হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে । এভাবেই কেটে গেল ২০১৬ এভাবেই কেটে যাবে ২০১৭। আমি আশাবাদী এবং বাস্তববাদী। যদি বাস্তববাদী হই তাহলে আমাকে বাস্তব অবস্থাকে স্বীকার করতে হবে। যে অবস্থার উপরে দাঁড়িয়ে আছি সেই অবস্থাকে “উপায় নেই” বলে বসে থাকলে হাজার বছর কেটে যাবে কোন পরিবর্তন আসবেনা। শুধু ফেসবুকের দেওয়ালে শুভেচ্ছা বিনিময় করা ছাড়া।
সেদিন একটা পোস্টে দেখলাম বাংলাদেশের কারাগারের একটি খন্ড চিত্র। এখানে তুলে ধরছিঃ
এক নজরে বাংলাদেশ কারাগারে শিশুর সংখ্যা (কারাগারে শিশু????)
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে – ছেলেশিশু ১৩৪জন ও মেয়েশিশু ১১৭জন।
ব্রাম্ভনবাড়িয়া জেলা কারাগারে – ছেলেশিশু ৪৮জন ও মেয়েশিশু ৭১জন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে – ছেলেশিশু ৮৪জন ও মেয়েশিশু ১০৯জন।
বগুড়া জেলা কারাগারে –ছেলেশিশু ৬৬জন ও মেয়েশিশু ৪৬জন
চট্রগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে – ছেলেশিশু ২১৯জন ও মেয়েশিশু ২২১জন
কক্সবাজার জেলা কারাগারে – ছেলেশিশু ৯৫জন ও মেয়েশিশু ৮৪জন।
খুলনা কেন্দ্রীয় কারাগারে – ছেলেশিশু ৫১জন ও মেয়েশিশু ৫১জন।
শিশুরা জেলে কেনো থাকবে? চোরেরা তো সব বাইরে। চোরেরা তো সব প্রাপ্তবয়স্ক। সাড়া বাংলাদেশে চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজেরা লুন্ঠন করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে আর দেশের শিশুরা সব কারাগারে! এর চাইতে লজ্বাজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে??? ধিক্কারের সাথে শেষ আরো একটি বছর।
৭০% মানুষ যারা বিনা বিচারে বাংলাদেশের কারাগারে বন্দী আছেন তারা নির্দোষ যেহেতু সাক্ষ্য প্রমানের দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে কোন দোষ প্রমানিত হয়নি। অনেক সময় দেখা গেছে একটি অপরাধের শাস্তি যদি চার বছর হয় আর পাঁচ বছর ধরে কোন বিচারই না হয় তাহলে সেই কয়েদী তার অপরাধের জন্য প্রাপ্ত শাস্তির মেয়াদের এক বছর বেশী কারাগারে অবস্থান করছে। তার এই এক বছর কে ফিরিয়ে দেবে? সমাজ থেকে অপরাধীদের দূরে রাখার জন্য কারাগারে বন্দী করা হয় সেটাও অপরাধীর অপরাধ প্রমানের পরে আগে নয়।
এমন অনেক কয়েদী আছেন যারা বিনা বিচারে ২০-৩০ বছর কারাগারে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে অনেক সদস্য একজন উপার্জনক্ষম সদস্যের উপরে নির্ভরশীল। সেই উপার্জনক্ষম মানুষটিকে যখন পুলিশ রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে তখন তার পরিবারের সেসব সদস্য তার উপরে নির্ভর করে তাঁরা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায়। কারাগারে অবস্থান করছেন এমন অনেকেই আছেন যারা কিছু টাকার বিনিময়ে কোন রাজনৈতিক দলের মিছিল থেকে বা সভাতে যাবার পথে বা হরতালের সময় পিকেটিং করা অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন। টাকার অভাবে এরা আইনজীবি নিয়োগ করতে পারেনা। পরিবারের কেউ হয়তো জানেই না যে এরা কারাগারে অবস্থান করছে।এদের পরিবারের অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছে এরা মরে গেছে বা হারিয়ে গেছে।মানবাধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘনের একটি প্রামান্য চিত্র কারাগার, বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ বিচার বিভাগ ও বাংলাদেশের সবগুলো আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী এক একটি অবিচারের প্রতীক হয়ে অপরাধ বানিজ্যে লিপ্ত রয়েছে। দুর্নীতিই বাংলাদেশের জাতীয় নীতি।
এক নজরে বাংলাদেশ কারাগারগুলোতে কয়েদীর সংখ্যা । ধারণক্ষমতার চাইতে ২০০% বেশী কয়েদীকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। এক তো বিনা বিচারে আটকে আছে শতকরা ৭০ভাগ মানুষ। মিথ্যা মামলা, পুলিশ-বানিজ্য, আইনজীবি-বাণিজ্য, ইত্যাদি নানা বাণিজ্যের ফাঁদে অসহায় মানুষেরা বছরের পর বছর অমানবিক পরিবেশে অকারণে আটকে আছে। বিনা বিচারে একজন মানুষকে কারাগারে আটকে রাখা অপরাধ।
এইভাবেই অপরাধ দমনের নামে অপরাধ প্রমোট করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ৮০টি কারাগার রয়েছে । ৯টি কেন্দ্রীয় কারাগার। ৫৫টি জেলা কারাগার। ১৬টি থানা কারাগার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার প্রতিষ্টিত হয় ১৭৮৮ সালে। ধারন ক্ষমতা ২৫০০ জন কয়েদী কিন্তু ১২০০০ হাজারের বেশী এখানে আটক থাকে।
বছর কয়েদীর সংখ্যা
২০০০ ৬২,৬৬৯
২০০১ ৬০,৮৮৭
২০০২ ৬৮,১৭৮
২০০৩ ৭৫,১৩৫
২০০৪ ৭৪,১৭০
২০০৫ ৭৪,৭১০
২০০৬ ৭১,১১৪
২০০৭ ৮৫,৯৪১
২০০৮ ৮৬,৮৩৮
২০১০ ৬৯,৬৫০
২০১২ ৬৮,৭০০
২০১৩ ৭২,১০৪
২০১৪ ৭৪,১৭০
২০১৫ ৬৯,৭২৯
পুরাতন বছরের মতই নতুন বছরে বিষন্ন বদনে অনেক মা বসে আছেন ছেলের পথ চেয়ে। ছেলের অপরাধ ছিল একটাই আওয়ামীলীগ বাদে অন্য কোন দল করা বা অপরাধ ছিল ভুল সময়ে ভুল জাগাতে যেয়ে ভুল মানুষের মুখোমুখি হয়ে যাওয়া। সেই ভুল কার ভুল ছিল? সেই ছেলের নাকি গোটা সমাজের সবার? কার ভুলের মাশুল কে দিচ্ছে?
জনগনের প্রতিনিধিত্ব করার মত বাংলাদেশে কোন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল নেই। যারা আছে তা্রা সবাই বিদেশীদের দালালী করার জন্য প্রস্তুত। জনগনের প্রতিনিধিত্ব করার মত যোগ্যতা তাদের নেই। বাংলাদেশের সম্পদ সব পাচার হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। অচিরেই বাংলাদেশ হবে সম্পদহীন আর একটি মরুভূমি।
নতুন বছরে শুভেচ্ছা জানাতে পারছিনা। আমি দুঃখিত।
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা।