শ্রমিকের আত্মহত্যায় কার ঘুম ভেঙ্গেছে ?

সব চাইতে বেশী মন খারাপ হয়ে যায় তখন যখন ফেসবুকে দেখি গলায় দড়ি লাগানো শ্রমিকের লাশ ঝুলছে। মনে আসে সেইসব দিনের কথা যখন ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতে ব্যাঙ্গের ছাতার মত আদম ব্যবসায়ীরা অফিস খুলে বসেছিল। সেইসব অফিসের সামনে সারাদিন প্রচুর মানুষের ভীর লেগে থাকতো। সবাই বিদেশে যেতে চায়। আদম ব্যবসায়ীরা মানুষের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকা নিয়ে অমুক তারিখে ফ্লাইট, বা পাসপোর্ট আসবে, তমূক তারিখে মেডিক্যাল, হেন ত্যান বলে একদিন অফিস বন্ধ করে দিতো। হাজার হাজার মানুষ সেইসব ব্যবসা প্রতিষ্টানের সামনে এসে হায় হায় করে বুক চাপড়াতো। সাড়া বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের টাকা মেরে দিয়ে এইভাবেই বাংলাদেশের অনেক মানুষ সম্পদশালী হয়েছে। এখন হয়তো তাদের ছেলেমেয়েরা অন্য ধরনের মানুষ ঠকানের ধান্ধা করে। ধান্ধার শেষ নাই। প্রতারণার স্বর্গ বাংলাদেশে শিকারের অভাব নাই।

বিদেশে যেতে প্রচুর টাকা লাগতো সেসময়। এইসব টাকা যোগাড় করার জন্য অনেকেই জমি বিক্রি করেছেন। আমি জানিনা কতজন মানুষ বিদেশে এসে টাকা উপার্জন করে পুনঃরায় সেই জমি ক্রয় করতে পেরেছেন। জমির দাম কমে না। বৃদ্ধি পেতে থাকে। শ্রমের দাম সেই তুলনায় বৃদ্ধি পায়না। শ্রমিক বৃদ্ধি পায় শুধু। আর মজুরী কমতে থাকে। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নেই। তারপর আরো কিছু সামাজিক ব্যাপার স্যাপার আছে যেমন পরিবারের একজন সদস্য বিদেশে গেলেই রাতারাতি পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা রক্তচোষা কাঁকলাস হয়ে যায়। ওদের সবার চাহিদাও রাতারাতি বৃদ্ধি পায় । পরিবারের যে সদস্যটি বিদেশে গেছে সে কিভাবে আছে, কি করে টাকা উপার্জন করছে, কি খাচ্ছে এইসব খবর কেউ রাখেনা। সবাই টাকার অপেক্ষা করে। হাতে তালিকা নিয়ে বসে থাকে। টাকা এলেই অমুক কিনবে তমূক কিনবে। জীবনের কোন সাধ আহ্লাদ আর বাকী রাখবেনা। যারা এই সাধ আহ্লাদ পূরণের তালিকা হাতে বসে থাকে তারা হয়তো পরিবারের এই সদস্যকে বিদেশে যাবার জন্য কোন রকম সাহায্য করেনি। যে জমি বিক্রি করে সে বিদেশে গেছে সেই জমি কেনার জন্য টাকা সঞ্চয় করার কথা কেউ ভাবেনা। কেউ ভাবেনা এই শ্রমিকটি যদি কাজ হারায়, যদি দেশে ফিরে আসে তাহলে তার কি উপায় হবে অথবা এই শ্রমিকটি যদি মারা যায় তাহলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাধ আহ্লাদ কেমনে পূরণ হবে?

মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের জেলে এখন অনেক বাংলাদেশী আছে যারা আদমকে টাকা দিয়ে এইসব দেশে এসে জেনেছে তাঁরা অবৈধ ফলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জেলে আছে। তাদের পরিবারের হাতে এখনো তালিকা প্রস্তুত হয়নি। অনেকেই খবর রাখেনা।

ভিসার মেয়াদ শেষ হবার পরে যদি কাজের অনুমতি না থাকে তখন শ্রমিকদের অবৈধ বলা হয় এবং গ্রেফতার করা হয়। এই একই ঘটনা সাড়া বিশ্বের যেকোন দেশেই হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারেঃ বাংলাদেশীরা বিদেশে কেনো?

বিদেশে যেতে মোট যে খরচা হয়েছে সেই টাকা ওরা কোথায় পেয়েছে? স্ত্রীর উপর চাপ দিয়ে শশূরের কাছ থেকে নিয়েছে? জমি বিক্রি করে পেয়েছে? ঋন করেছে? টাকা যেভাবেই যোগাড় করুক, বিদেশে এসে কাজ পাবার পরে সে কি ভেবেছ সেইসব দিনের কথা ? বিদেশে আসার জন্য টাকা যোগাড়ের জন্য যেদিন গেছে, যে কস্ট গেছে সেইসব দিনের কথা ভেবে কি এই শ্রমিক সঞ্চয়ী হবার চেষ্টা করেছে? পরিবারের সদস্যদের কি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সেই দিনের কথা? নাকি হাতে টাকা পেয়ে আর মনে নেই এই টাকা কিভাবে হাতে এলো । হাতে টাকা পাবার সাথে সাথে টাকা চলে গেছে বাজারে। ঘরে এসেছ নানা ধরনের পন্য । সেসব পন্য ছাড়াও জীবনের অর্ধেক বেশ কেটে গেছে।

সবার হাতে হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভিতে একশত চ্যানেল, এইসব কি জরুরী? মোবাইলে কি কথা হয়? কার সাথে কথা হয়? সেই কথা বলে কি টাকা উপার্জন হয়? নাকি ফালতু টাকা খরচা হয় যে টাকা উপার্জন করতে একজনকে রাস্তা সাফ করতে হচ্ছে। সেই টাকা উপার্জন করতে একজন শ্রমিক আরো পাঁচ বা দশজন মানুষের সাথে এক ঘরে একটি চৌকীতে ঘুমায়। আর স্বপ্ন দ্যাখে তার বোন বা ভাই বা স্ত্রী আইফোনে বন্ধুদের সাথে ফালতু কথা বলছে। আয় বুঝে ব্যয় করার কথা এখন আর কেউ চিন্তা করেনা।

যেসব শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন তাদের সবার আয় বুঝে ব্যয় করা উচিৎ।  দেশে কিছু সঞ্চয় করা উচিৎ যাতে করে তারা ফিরে এলে কোন একটা ব্যবসা করে বা কোনভাবে চলতে পারে। নীচের পোষ্টটি ফেসবুক থেকে নেওয়া। হুবহু তুলে ধরা হলো।
Quote
পড়ুন এক টাকার মেশিনের গল্প। যিনি আত্মহত্যার আগে লিখে গেলেন নিজের জীবনের কাহিনী।শেয়ার অবশ্যই অবশ্যই করবেন? যাদের সন্তান বা স্বামী বিদেশে থাকেন তারা অবশ্যই দেখবেন কত কষ্ট করে আপনাদের জন্য। ছবিতে ঝুলে থাকা লোকটা কে দেখছেন, উনি ছিলো আপনাদের সোনার বাংলার রেমিটেন্স যোদ্ধা, একটি পরিবারের টাকার মেশিন। কাতার প্রবাসী হিসাবে প্রবাসীদের সহযোদ্ধা, জীবন যুদ্ধে হার মেনেই ফাঁসিতে ঝুলে আছেন। .

মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান কে একটু ভাল ভাবে রাখার জন্য, ফ্যামিলি মানুষ গুলোর একটু সুখের জন্য সব মায়া ত্যাগ করে প্রবাসে আসছিল। জানিনা এবার কার সুখের আসায় দুনিয়ার মায়া ও ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। বাড়ি ছিলো রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জে। উনার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, মানুষ টা অনেক সহজ-সরল টাইপের ছিলেন, সবসময়ই সোজা সাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করতেন। নিজের মনের কথাটা ঠিকমতো প্রকাশ করতেও পারতেন না, সিগারেট কিংবা কোন বাজে অভ্যাসও ছিলোনা। নয় মাস আগেই ছুটিতে দেশে গিয়ে বিয়ে করে এসেছিলেন। বাড়িতে মা-বাবা, ছোট ভাই-বোন, স্ত্রী নিয়েই উনার যৌথ ফ্যামিলি ছিলো।

.উনার রুমমেটদের মাধ্যমে জানা গেছে, কিছুদিন থেকেই নাকি উনি বেশ উদাস আর মন খারাপ করে থাকত। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করত না, রাতে সবাই ঘুমাইত ওনি বেডে শুয়ে কেঁদে বালিশ ভিজাইতো। সুইসাইড করার কারণ টা আর শেষ ইচ্ছে টা মরার আগে চিরকুটে লিখে গেছিলেন.. “মাস দুয়েক আগে উনার ভিসা নিয়ে একটু প্রবলেম হয়েছিল, দুইমাস ধরে বাড়িতে কোন টাকা পাঠাতে পারেনি। সেলারীর সব টাকাই ভিসার ঝামেলা মিটাইতে শেষ হয়ে গেছিলো। ফ্যামিলির সবাই ভাবছিল, ওনি টাকাটা বৌয়ের পারসোনাল একাউন্টে পাঠাচ্ছে, বাড়িতে ফোন দিলে সবাই উনার সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলত, কল কেঁটে ফোন বন্ধ করে রাখত। শেষ পনেরদিন মা উনার সাথে কথা বলেনি। বৌ ভাবছে টাকা বাজে পথে খরচ করতেছে, বৌও এসব নিয়ে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছিলো।উনার সমস্যা টা কাউকে বুঝাতে পারেনি, কিংবা কষ্ট টা কেউ বুঝেনি, ঘরের বৌ এমন কি গর্ভধারিনী মা ও না।ফ্যামিলির কাছ থেকে পাওয়া আঘাত টা সহ্য করতে না পেরেই পৃথিবীর মায়াও ত্যাগ করে নিজ রুমে ফাঁসি দিয়েছেন। চিরকুটে লেখা শেষ ইচ্ছেটা ছিলো,

“লাশ টা যাতে দেশে না পাঠানো হয়, এখানেই দাফন কাফনের ব্যবস্থা

করা হয়।”

…শেষ ইচ্ছে টা হয়ত পূরণ করা সম্ভব হবেনা কারণ কোম্পানি থেকে লাশটা দেশে পাঠিয়ে দিবে। তবে কি পরিমাণ আঘাত আর কতোটুকু কষ্ট পাইলে একটা মানুষ মরার আগে এরকম আবদার করতে পারে ???

.ভাই সিরিয়াসলি একটা কথা বলি, প্রবাসীরা ভোগ- বিলাসিতা কিংবা নিজেদের সুখের জন্য বিদেশ আসেনি, ফ্যামিলির কথা চিন্তা করেই এসেছে। দেশে যারা আছে তারা মনে করে প্রবাসীরা অনেক সুখে আছি, টাকার পাহাড়ে কিংবা টাকার গাছ নিয়ে বসে আছে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে শুধু টাকা পাঠাবো। কিন্তু আমরাতো বুঝি মাস শেষে টাকা পাঠানোর জন্যে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়। আপনার ভাই, ছেলে, স্বামী, বাবার প্রবাস লাইফের একদিনের কষ্ট যদি কখনো দেখতেন, সাথে সাথে বলতেন বাড়িতে চলে আসতে প্রয়োজনে না খেয়ে থাকব তবুও প্রবাসে থাকতে হবেনা।

.প্রবাসীদের কষ্ট বুঝতে বেশি কিছু করতে হবেনা, “ভোররাত চার টায় ঘুম থেকে উঠে 45° সেলসিয়াস তাপমাত্রার সারাদিন রৌদে পুঁড়ে 15/16 ঘন্টা ডিউটি করে রাত নয় টায় রুমে গিয়ে কিচেনে গরম পাতিলের ছ্যাঁকা খেয়ে রান্না করার কষ্ট টা একটু আন্দাজ করুন। অবশ্যই, দেশে থেকে আপনারা কি করে বুঝবেন/ দেখবেন আর বলবেন। আপনারা তো প্রবাসীদের রক্তশুষে ভালোই মৌজে আছেন। আমরা যারাই প্রবাসে আছি, আমরা তো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী, হাজারো কষ্ট বুকে নিয়েও বলি অনেক ভাল আছি। কোন দিন বুঝতে দেইনি আপনার সুখের জন্য আমাদের জীবনের মূল্যবান দিন গুলোকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছি। দেশের মানুষ গুলোর কাছে একটাই অনুরোধ, বিদেশে আপনার ফ্যামিলির যেই থাকুক বাবা, ভাই, স্বামী, বন্ধু, অন্যকোন সম্পর্কের আত্মীয় হোক তাদের সাথে একটু ভাল ব্যবহার করেন, তাদেরকে একটু ফোনে সময় দেন, একটু ভালো ভাবে কথা বলুন। তারা আপনাদের কাছে এরচেয়ে বেশি কিছু আশাও করেনা।কোনরকম মেন্টালি পেইন দিবেন না, কাছের মানুষের ছোট একটা কথাও ধনুকের তীরের মতো বুকে বিঁধে। সেসব ব্যথায় মেন্টালি সার্পোট কিংবা সান্ত্বনা দেওয়ার মতো এখানে ওনাদের কেউ নাই, সবরকম পেইন একাই নিতে হয়। .

প্রবাসী ভাই-বন্ধু, দেশ থেকে যে যাই বলুক না কেন, মনে কিছু নিবেন না। সামর্থ্য যতটুকু আছে ফ্যামিলির জন্য ততটুকুই করবেন। কোন রকম আঘাতে ভেঙ্গে পড়বেন না। আর কোন রেমিটেন্স যোদ্ধা / সহযোদ্ধা কে এভাবে আমরা হারাতে চাই না।

saudilabourbd

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *