যদি কোন নেতার সমালোচনা করা হয় তাহলে তিনি যে রাজনৈতিক দলের নেতা সেই দলের বেশীরভাগ সদস্য রেগে যায় এবং বলে “আপনি কেনো আমাদের নেতা সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলছেন”। সমালোচনা করা মানে নেতা সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলা না। নেতার ভুলগুলো তুলে ধরা। নেতা ফেরেস্তা নন। নেতা একজন মানুষ। তিনি ভুল করতে পারেন। নেতার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দলের কর্মীদের ও দেশের জনগন যারা এই দলকে সমর্থন করে তাদের ক্ষতি হতে পারে। নেতার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে স্বপ্লমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে। জনগন নেতার পিছে পিছে ঘুরে না। নেতার কাজ ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগন জানতে পারে বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে। আর এই যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই জনগণ নেতার সিদ্ধান্ত ও কাজের ভালমন্দ সম্পর্কে তাদের অভিমত পোষণ করে্ন। আর সেটাকেই গণতন্ত্র বলা হয়। একজন নেতা একজন রাজা নন একজন জনপ্রতিনিধি। নেতার সমালোচনা করা জনগণের দায়িত্ব।
শেখ মুজিবের কর্মকান্ড ও জিয়াউর রহমানের কর্মকান্ড আমরা বিভিন্ন পত্রিকা থেকে যেমন জেনেছি তেমন এইসব নেতাদের সিদ্ধান্ত, ব্যর্থতা, ভুলের জন্য দেশ ও জনগণের যে ক্ষতি হয়েছে তা নিজের চোখেও দেখেছি। ১৯৭২-৭৫ সালে সাড়া ঢাকা শহরে অসংখ্য হাড্ডিসার মানুষ দেখেছি, ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক দেখেছি, মৃতদেহ দেখেছি। পত্রিকাতে পড়েছি সাড়া দেশে আনুমানিক মোট মৃতের সংখ্যা। বিদেশী সাংবাদিকেরা সেইসব মৃত্যুর উপরে ডকুমেন্টারী করেছে। ইউটিউবে গেলে দেখা যাবে। আজকে যখন মানুষ গর্বভরে সেইসব নেতাদের নাম উচ্চারণ করে বা ফেসবুকে লেখালেখি করে তখন আমার চোখে ঢাকার রাস্তায় মানুষের মৃতদেহ ভেসে উঠে। আমি একজন বাংলাদেশী। শুধু একজন বাংলাদেশী নই আমি একজন সচেতন নাগরিক এবং বাংলাদেশকে ভালবাসি। আর সবচাইতে বড় কথা আমি মানুষকে ভালবাসি। শেখ মুজিবের আমলে আওয়ামীলীগের পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাহিনীর হাতে কতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার তালিকা। পরে গণকন্ঠে বিস্তারিতভাবে এই সংবাদ প্রকাশিত হতো। এইসব পত্রিকার উপরে চড়াও হয়ে চারটি পত্রিকা বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতেও জানা বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলোতে পড়েছি সাড়া বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুর খবর। এইসব মানুষ মধ্য ছিল ছাত্র, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, মজুর, শ্রমিক, সাংবাদিক, লেখক, উকিল ইত্যাদি। এইসব মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী ছিল তাদের বিচার হয়নি। খুনীদের বিচার হয়নি। পরবর্তীকালে সমাজের বিভিন্ন উচ্চপদে এইসব খুনী ও লুটেরারা আসীন হয়েছে।
বেশী দূরে যাবার দরকার নেই ১৯৭১ সালে কাদের সিদ্দিকির কিছু ছিলনা। বিহারীদের সম্পত্তি লুট করে কাদের সিদ্দিকী এখন একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। আওয়ামীলীগের নেতা শেখ মুজিবসহ প্রায় সবাই দরিদ্র। ৪৪ বছর এমন কিছু সময় না যার জন্য জানা যাবেনা কে কোথায় ছিল বা কি করতো আর কিভাবে সম্পদের পাহাড়ে উঠে বসেছে। পরে অনেকেই আওয়ামীলীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছে। ভোল পালটে ফেলেছেন। শেখ মুজিবের আমলে যখন মানুষ হত্যা করা হতো তখন তো জিয়াউর রহমান দেশেই ছিলেন। জিয়াউর রহমান খুনীদের জানতেন, চিনতেন, যারা মানুষের জমিজমা দখল করে নিজেদের নামে লিখে নিয়েছে তাদের অনেকেই জিয়াউর রহমানের সাথে হেটে হেটে খাল কেটেছেন। নেতার পিছ বদলালেই সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় কিন্তু চুরি, দুর্নীতি, লুটপাটের যে নিয়ম সমাজে প্রতিষ্টিত হয়ে গেছে তা বদলানো যায়না। বদলানো যেতো যদি প্রতিটি অপরাধীর বিচার হতো।
যদি নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা থাকতো। ন্যায় বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হলে দেশ থেকে অপরাধের হার কমে যেতো। অপরাধ কোনদিন বন্ধ করা যাবেনা তবে অপরাধের হার কমানো যেতে পারে। ন্যায় বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমেই অপরাধের হার কমানো সম্ভব।
উপরে বর্ণিত মৃত্যুগুলো আমার শৈশব-কৈশরে দেখা। তারপর তারুণ্যে আমি দেশ ছেড়ে আসি। এখন নতুন প্রজন্ম যখন খালে বিলে লাশ ভাসতে দ্যাখে বা পথে মানুষের লাশ দ্যাখে বা কোন ধর্ষিতা নারীকে টুকরো করে পাশবিকভাবে পথে ছড়িয়ে থাকতে দ্যাখে তখন ফেসুবকে স্টাটাস আর শেয়ার দেয় তারপর সবাই চুপচাপ। রানা প্লাজা ছিল অন্য একজনের কাছ থেকে দখল করা সম্পত্তি। সেখানে অপরিকল্পিতভাবে বিল্ডিং তোলার জন্য তা ধ্বসে যায় এবং অনেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। যার জমি দখল করা হয়েছিল সে বিচার পায়নি কারণ মামলা করার মত শক্তি তার ছিলনা। যদি আইনের আশ্রয় নেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য সহজ হতো যদি এই দখলদারের সাজা হতো তাহলে এইখানে বিশাল ভঙ্গুর অট্টালিকা হতোনা আর এতগুলো মানুষের মৃত্যু হতোনা। অবিচার আর অন্যায় যদি সমাজের ভিত্তি হয় তাহলে তো সেই সমাজের যারা নেতা তাদের দায়িত্ব থাকে সেই ভিত্তিমূল থেকে অন্যায় উপরে ফেলা। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের দায়িত্ব ছিল ক্ষমতা পেয়ে সকল অপরাধীর বিচার করা এবং দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্টা করা। কিন্তু তিনি তা করেননি। ফলে কি হয়েছে? তিনি নিজেই অপরাধীদের হাতে নিহত হয়েছেন, তাঁর পুত্র ও স্ত্রী অপরাধীদের দ্বারা বারে বারে লাঞ্ছিত হয়েছে্ন এবং তার রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, আর সাধারণ মানুষেরা ভুগেছে।
ফারাক্কা চুক্তি পদ্মাপাড়ের অগুনিত কৃষকের পেটে লাথি মেরেছে। এই তো বেশীদিন আগের কথা না বাঁশখালীর গন্ডামারা গ্রামে অনেক জমি হরফ করা হয়েছে কয়লা বিদ্যুৎ করার জন্য। গ্রামের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাড়ী বাড়ি যেয়ে মানুষকে পেটানো হয়েছে। হাসপাতালে আহত গ্রামবাসীকে হাসপাতাল বেডের সাথে হাতকড়া লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বেডের পাশে পুলিশ পাহাড়া থেকেছে। কিছুদিন পরে আমরা জানবো এই কয়লা বিদ্যুতের মালিক অমুক মানুষ এবং তার পরিবার এই বিশাল এলাকা স্বপ্নে পেয়েছিল। এই রকম যশোরে, খুলনাতে, রংপুরে দিনাজপুরে অনেক বাড়ী আছে অনেক জমি আছে যা এখনকার মালিক স্বপ্নে পেয়েছে। মিরেরসড়াইয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিশাল জমিদারী উনার পূর্ব পুরুষেরা স্বপ্নে পেয়েছিলেন। এইভাবেই অপরাধীরা নেতা হয়। কিছু টাকা খরচা করে হাসপাতাল দেয়, স্কুল দেয় তারপর জনগন সব কথা ভুলে যায়। এখন অবশ্য অপরাধীরা সেটাও করেনা। আগে অন্য কারু প্রতিষ্টিত হাসপাতালের নাম বদল করে বাপের নামে রেখে দেয়।
বাংলাদেশ এখন একটি অপরাধীর স্বর্গ। সুতারাং কোন নেতা যদি ১০০% ভাল কাজ করে থাকেন তাহলে প্রশ্ন থাকবে এইসব অপরাধীরা কি তাহলে আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো? বাংলাদেশের জন্মের বয়স আর বাংলাদেশে খুন, লুট, দুর্নীতি, অগ্নীসংযোগ, ধর্ষন, চুরি, ডাকাতির বয়স একই। এরা সমবয়সী। এইসব অপরাধগুলো কিভাবে এত দিন বেঁচে আছে? বেঁচে আছে এই কারণে যেহেতু যারা আইন তৈরি করে, যারা আইন রক্ষা করে, যারা আইনের পাহাড়াদার তারা অপরাধ করলে আইন তখন অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে ফালে। আইন তাদের জন্য নয়।
নিরীহ মানুষ আগেও ভুগেছে এখনও ভুগছে। এক অপরাধের স্বর্গে একজন নেতার কি কৃতিত্ব আছে? কিসের অবদান নিয়ে গর্ব করবো? কাকে নিয়ে গর্ব করবো আমরা? পতাকা নিয়ে? গান নিয়ে? লাশ নিয়ে? ধর্ষন নিয়ে? দুর্নীতি নিয়ে? নির্লজ্বের মত খুনীর সাথে সাত পদের তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়া নিয়ে? নেতা নেত্রীদের কোন গুন নিয়ে আমরা গর্ব করবো? কোন অবদান নিয়ে ?
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা
https://www.youtube.com/watch?v=_hZMuuNziDM&t=10s