দাফন শব্দের অনেক অর্থ হতে পারে। সাধারণত মৃত্যুর পরে আমরা যখন মৃতদেহকে গোসল করিয়ে কাফন পড়িয়ে কবরে শুইয়ে মাটি চাপা দেই সেটাকে দাফন বলে। অনেকসময় জ্যান্ত মানুষকেও মাটি চাপা দেওয়া হয়। মৃত্যুর পরে আত্মা দেহ থেকে বেড়িয়ে যায়। সেজন্য দেহকে লাশ বলা হয়। লাশকে মাটি চাপা দিলে তখন কোন কস্ট নেই যেহেতু দেহে আত্মা নেই তাই অনুভূতি নেই। সাপে কামড়ালে মানুষ মরেনা। সাপের বিষ যতক্ষণ দেহে থাকে ততক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় থাকে মাত্র। এই বিষ দেহে ছড়িয়ে পড়ার আগে যদি বিষাক্ত জাগাকে কেটে বিষ বের করে ফেলা হয় আর ক্ষতের চারিপাশে শক্ত করে কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া যায় তাহলে বিষ দেহের চারিদিকে ছড়িয়ে যায়না এবং মানুষ জ্ঞান ফিরে পায়। এটা না করে অনেকসময় মানুষকে মৃত ভেবে দাফন করা হয় ফলে যখন বিষক্রিয়া কেটে যায় তখন সেই মানুষ বেঁচে উঠে এবং যেহেতু তাঁকে কবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়ে গেছে তাই সে দম বন্ধ করে মরে যায়। সাপের কামড়ে নয় মাটির নিচে দম বন্ধ হয়ে সে মারা যায়।
মগজে যখন টিউমার হয় তখন সেটা এত ছোট থাকে যে ক্সান করলে ধরা পড়েনা। তবে অসুবিধা লাগে। যেমন মাথা ঝিম ঝিম করে। এখানে সেখানে অকারণে ঘুমিয়ে যায়। মগজে দুই ধরণের টিউমার হতে পারে। ক্যান্সার অথবা ক্যান্সার ছাড়া। যে ব্রেইন টিউমার ক্যান্সার ছাড়া সেটা সহজেই অপারেশন করে মাথা থেকে বের করে ফেলা যায়। তবে এই টিউমারকে মগজের ভেতর সনাক্ত করার জন্য মগজ স্কান করার দরকার হয়।। মগজ স্কান করার জন্য একটা কাফণের মত বাক্সের ভেতর শরীরকে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। তখন মনে হয় আমি কবরের ভেতর শুয়ে আছি। আমি চিৎকার করে ডাকছি সবাইকে কিন্তু কেউ আমার কথা শুনছেনা। আমি বেঁচে আছি কিন্তু বের হতে পারছিনা। আটকে আছি কবরের ভেতর। এমন মনে হয়। স্কান করতে বেশী সময় লাগেনা। আমি বেশ ক’ইয়েকবার আমার মগজের স্কান করিয়েছি। আমার মনে হয়েছে আমি কবরে শুয়ে আছি। আমি ছটফট করেছি। আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছে। মনে হয়েছে জীবন্ত অবস্থায় আমাকে দাফন করা হয়েছে।

একবার আমি ঠিক করলাম আমাদের উনিশতলা অফিস থেকে এলিভেটর না নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবো। নামতে নামতে হঠাৎ মনে হলো আমি আর নামতে পারছিনা। আর শ্বাস নিতে পারছিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এইসব সিঁড়ির প্রতিটি স্তরে দরজা আছে কিন্তু দরজাগুলো বাইরে থেকে বন্ধ। ভেতর থেকে যে কেউ সিঁড়িতে আসতে পারে কিন্তু বাইরে থেকে সিকিউরিটি পাস ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনা। আমার পাস উনিশতলার দরজা ছাড়া আর কোন দরজাতে কাজ করেনা। আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না আমার মনে হচ্ছিল আমি কবরে শুয়ে আছি। জীবিত অথচ কবরে শুয়ে আছি। আমার মনে হয়েছিল জীবিত অবস্থায় আমি নিজেই নিজেকে দাফন করেছি।  সেসময় আমার কাছে মোবাইল ফোন ছিলনা। কিছুই ছিলনা। আমি ভাবিনি এমন হবে। তবে সেদিন আমার মৃত্যু লেখা ছিলনা সেজন্য এক লোক হঠাৎ কোন এক ফ্লোর থেকে নীচে নেমে এসে আমাকে এই অবস্থায় পেয়ে এমবুলেন্স ডাকে এবং আমাকে সে ধরে রাখে, আমার সাথে কথা বলে, আমাকে শান্তনা দেয় যতক্ষণ না এম্বুলেন্স আসে তারপর আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

নারীপুরুষেরা যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারপর হয়তো স্বামী উপলব্ধি করে যে এই স্ত্রী তার জন্য উপযুক্ত নয় তখন সেই স্বামী স্ত্রীর উপরে কারণে অকারণে খারাপ ব্যবহার করে এবং তাকে এমন অবস্থায় পৌছে দেয় যেন সে বেঁচে থাকে কিন্তু জীবন্মৃত অবস্থায়। এই স্বামী চায় এই স্ত্রী তার সাথে থাকুক কারণ স্ত্রী তার চাইতে বেশী টাকা উপার্জন করে। কারণ এই স্ত্রী নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নেয়। এই স্ত্রী একাকী সব সমস্যার সমাধান করে ফ্যালে। এই স্ত্রী সংসারের যাবতীয় চাপ নিজের কাধেই বহন করে। ফলে স্বামীকে স্ত্রীর জন্য কোন ব্যয়ভার বহন করতে হয়না। কোন ঝামেলা পোহাতে হয়না। সেদিক থেকে বিবেচনা করে এই স্বামী চায় এই স্ত্রী চিরকাল এই সংসার নামক কবরে থাকুক, সব ঝামেলা বহন করুক, সব সিদ্ধান্ত নিক, আর স্বামী তার ইচ্ছামত সুখে শান্তিতে থাকুক। এক ছাদের নীচে দুইজন অপরিচিত মানুষের বসবাস আর উঠতে বসতে মারধোর, আকথাকুকথা চলুক, বাইরের মানুষেরা জানুক আহা কি সুন্দর রামসীতার যোড়, সমাজের মানুষের কাছে সেই আওয়াজ পৌছেনা, সেই থাপ্পর, কিল, ঘুষির আওয়াজ কেউ পাবেনা কারণ সংসারের চারিপাশে মাটি চাপা দেওয়া আছে। অবহেলা, ঘৃণা, তিরস্কার, শারীরিক নির্যাতন স্ত্রীকে এমন এক পর্যায়ে এনে ফ্যালে মনে হয় সংসারটা যেন একটা কবর আর সেই কবরে স্ত্রীকে জীবন্ত মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এটাকেও দাফন বলে বা সংসারে দাফন হয়ে থাকা বলে। বিয়েটাই শেষ কথা না। একটি সংসারের ভিত্তি হলো ভালবাসা। যদি ভালবাসা না থাকে তাহলে সংসার থাকেনা। সম্পর্ক থাকেনা। স্ত্রীর টাকা বা স্বামীর টাকা দুইজনকে এক ছাদের নীচে ধরে রাখে ঠিক কিন্তু সেটা কবরে জীবন্ত দাফণের মত। জীবন খুব সংক্ষিপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে যদি বেঁচে থাকতেই হয় তাহলে যতদিন বাঁচি খোলা বাতাসে শ্বাস নিয়ে বাঁচি। হয়তো এমন মনে হতে পারে – এই স্বামী ছেড়ে দিলে আবার কোথায় স্বামী পাবো? কেউ আমাকে বিয়ে করবেনা! এমন হতে পারে আবার বিয়ে করলে আবার সেই পুরানা কবরে পৌছে যেতে হতে পারে। এই একই ঘটনা স্বামীর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। এই স্বামীর অনেক বন্ধু আছে। বাইরের মানুষের কাছে সে একজন অতি ভদ্র ভালমানুষ। এই কবরে বসেই সেই স্বামী ভাবে আহা আমার ছোটবেলার প্রেমিকাকে যদি বিয়ে করতাম তাহলে কত সুখী হতে পারতাম। ছোটবেলার প্রেমিকার সাথে বিয়া না হবার যাতনা অন্য একজন নারীকে বহন করতে হবে। ঐসব বাইরের লোকেরা যারা এই স্বামীর বন্ধু যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এই কবরে না ঢুকবে ততক্ষণ পর্যন্ত জানবেনা জীবন্ত দাফন হবার অনুভূতি কেমন।

কেউ কারুকে ব্যবহার করতে চায় কিন্তু যাকে ব্যবহার করছে সে ছাড়া অন্য আর একজন দ্বারা ব্যবহৃত হতে চায়। প্রতিটি মানুষ কোন না কোন স্বার্থে অন্য একজন মানুষের সান্নিধ্যে আসে। তারপর? তারপর তাকে ব্যবহার হয়ে গেলে তার উপযোগীতা যখন ফুরিয়ে যায় তখন তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এমন এক কবরে যেখান থেকে সে সবার আওয়াজ পায় শুধু যে তাঁকে ব্যবহার করেছে তার আওয়াজ ছাড়া। ব্যবহৃত সেই প্রানীটি চিৎকার করে ডাকে কিন্তু সে তো কবরে মাটি চাপা দেওয়া তাই তার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়না। সে চিৎকার করে ডাকে, সবার আওয়াজ সে শুনতে পায় শুধু যাকে ডাকে তাঁর আওয়াজ ছাড়া। কারণ যে ব্যক্তি তাকে ব্যবহার করেছে সেই ব্যক্তির শুধুমাত্র একটা কাজেই তাকে বার বার ব্যবহার করবে বলে একটা নির্দিষ্ট কবরে দাফন করে রাখে। এই কবর থেকে বেরুবার পথ নেই। ডেকে ডেকে একদিন তার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসবে। তারপর একদিন সে মরে যাবে।সে মরে যাবে যেহেতু তার আর কোন প্রয়োজন নেই। বস্তুবাদী দুনিয়াতে সবকিছুর বিকল্প আছে।

কথা সাহিত্যের গজগজানিতে অনেক লম্বা লম্বা কথা লেখা থাকে – অমুকের বিকল্প নাই তমুকে না থাকলে অমুক হবে তমুক হবে । এইসব আহাজারি সবকিছুই ধান্দাবাজী, সাহিত্য-বাণিজ্য আর নাম কেনার জন্য আবেগ নিয়ে খেলাধুলা মাত্র। সবাই টাকাকড়ি, গাড়ি,বাড়ি, ঝকমকে সুখের পেছনে ছুটে আর সেই সুখ আর শান্তি পেতে যেয়ে পেছনে দাফন করে দেয় অনেক আবেগ, শব্দ, শক্তি, স্নেহ, ভালবাসা। দুনিয়াতে সব চাইতে খেলো জিনিষ যা তাহলো বিশ্বাস আর ভালবাসা। যার আদৌ কোন দরকার নেই। সবচাইতে আগে যা দরকার তা  হলো বিশ্বাস ও ভালবাসাকে দাফন করা। তাহলেই জীবন সুখ ও শান্তিতে ভরে উঠবে।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *