নিজেই নিজের মুখোমুখি

সেদিন আমি আমার নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সামনে আমি এসে দাঁড়িয়ে আমাকে পরখ করছিলাম। আমি আমাকে দেখে আমি ভয় পাই কিনা সেটা আগ্রহভরে দেখছিলাম। আমি ভয় পেয়েছি। আমি আমাকে দেখে ভয় পেয়েছি। কারণ আমি অনেক কিছু লুকিয়ে রাখতে চাই। আমার বুকের ভেতর জমে থাকে এমন অনেক কথা, এমন অনেক ইচ্ছা, এমন অনেক বাসনা, এমন অনেক স্বপ্ন আমি লুকিয়ে রাখি । কারু সাথে শেয়ার করিনা। জমতে জমতে একদিন ওরা হিমালয়ের মত পাহাড় হয়ে থাকে। তবু আমি কারুকে কিছু বলিনা। কাকে বলবো? আপন বলতে আমার কেউ নেই। আমি যাদের খুব ভালবাসি তাদের হারাতে চাইনা। সেজন্য ভয় পাই। ভাবি এইসব কথা যদি তাদের সাথে শেয়ার করি তাহলে ওরা আমাকে ভুল বুঝবে। হয়তো আমি আমার বন্ধুদের হারিয়ে ফেলবো। সেজন্য আমি আমার মনের ভেতরে অনেক না বলা কথার পাহাড় জমা করেছি।

সেদিন সেই পাহাড় থেকেই আমার আমি এসে আমার সামনে হাজির হয়েছে। আমার ভেতরের আমি আমাকে চিৎকার করে বলতে চেয়েছে আমি এই পাহাড়ের নীচে দম বন্ধ হয়ে মরে থাকতে চাইনা। আমি এই না বলা কথার কারাগার থেকে মুক্তি চাই। মুক্তি চাই। সব কথা সবাইকে আমি চিৎকার করে বলে দিয়ে এই কথার স্তুপ সাফ করে ফেলতে চাই। আমি আমার ইচ্ছাগুলোর প্রতিফলন দেখতে চাই। আমি পেতে চাই সেইসব কিছু প্রতিদিন যা আমি স্বপ্নে দেখি। আমি পেতে চাই নির্মল আকাশের নীচে শান্তির আশ্রয়। আমি সবুজ পাহাড়ের চূড়াতে লম্বা হয়ে শুয়ে সূর্যের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে চাই। ঢের হয়েছে এই দায়িত্ব পালন। এই নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যাওয়া জীবন থেকে আমি পরিত্রাণ পেতে চাই। আমি বের হয়ে যেতে চাই এই হৃদয়হীন শহর থেকে।

এইসব ভাবি। কিন্তু পারিনা। পারিনা কারণ আমার কাঁধের উপরে দায়িত্ব আছে। আমার চারটা বোন আছে। ছোট এক ভাই আছে। বাবা আছেন। মা আছেন। সবার দেখাশোনা করার জন্য আমাকে প্রতিদিন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। আমি ছাড়া ওদের কেউ নেই। বোনদের বিয়ে দিয়ে, ভাইকে প্রতিষ্টিত করে আমিও বিয়ে করবো একদিন। আমার মামাতো বোনকে বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছি। বহূ বছর আগে মামী আর দুই মেয়ে আর এক ছেলে রেখে মামা মারা গেলে আব্বাই ওদের সংসারের দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছিলেন। আব্বা কাজ ছেড়ে দিলে আমি এই দায়িত্ব পালন করছি। আমার বিয়ের বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছে। মামাতো বোন আমার চেয়ে প্রায় সাত আট বছরের ছোট। মামার ছেলেটা পেশকারের কাজ করছে। ছোট মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমার বোন তিনটার বিয়ে হলেই আমি বিয়ে করবো। বোনদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। অনেক দায়িত্ব। অনেক কাজ। সবার দায়িত্ব নিয়েছি অনেক ভালবাসি সবাইকে। ওরাও আমাকে অনেক ভালবাসে।

তবে এক এক সময় মনে হয় এই দায় দায়িত্ব আমাকে খেয়ে ফেলছে। এইসব কিছু থেকে বেড়িয়ে যেতে ইচ্ছা হয়। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে । মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ভাইবোনেরা খুব নিষ্টুর। ওরা কিছুই করেনা। বসে বসে অন্ন ধবংস করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই ওদের। আমার মগজের ভেতর আমি এক শহর বানিয়েছি। প্রতিদিন আমি স্বপ্ন দেখি। যা কিছু আমি করতে চাই। করতে পারিনা । সেইসব কিছু আমার স্বপ্নে এসে ধরা দেয়। প্রতিদিন হাসিমুখে সবার সামনে থাকি। বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যাথা কারু কাছে প্রকাশ করিনা।

সেজন্যই সেদিন আমার আমি এসে আমার সামনে হাজির হয়েছিল। আমি ভয় পেয়েছি। চিৎকার করে আমার আমিকে বলেছি – দোহাই লাগে সব কথা বলে দিওনা। সব ইচ্ছাগুলোকে উলঙ্গ করে দিওনা। আমার ক্রোধ, আমর ঘৃনা, আমার রাগ, আমার কান্নাগুলোর উপর থেকে আবরন খুলে দিওনা। তাহলে আমার আমি হারিয়ে যাবে। আমাকে সবাই ভুল বুঝবে। আমি যে ইমেজ সৃষ্টি করে রেখেছি সেই দায়িত্ব পালনকা্রী বড় ভাইয়ের ইমেজ, দায়িত্ববান বড় সন্তানের ইমেজ নস্ট হয়ে যাবে। আমি সেটা চাইনা। আমি কারুকে বলতে চাইনা আমি কি চাই। ওরা কেউ বুঝবেনা আমার কথা। আমাকে স্বার্থপর ভাববে। আমি সেটা চাইনা। মা কস্ট পাবে। আমি সেটা চাইনা।

অথচ আমার আমি চাইছে অন্যকিছু। আমার সামনে এসে দাড়িয়েছে পথ রোধ করে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমিকে হত্যা করে আঘাত করেই আমাকে বের হয়ে যেতে হবে। তারপর আঘাত করতে হবে সেইসব কিছুকে যেসব কিছু আমার ইচ্ছা পূরণে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। তা যদি না পারি তাহলে আমার আমি আমাকে আঘাত করবে। আমাকে শেষ করে ফেলবে। আমার বুক ফেটে যায় কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বের হয়না। আমি সব সময় দুইটা ব্যক্তিত্ব এটে রাখি । একটা ভেতরে একটা উপরে। উপরেরটার সাথে ভেতরের ব্যক্তিত্বের আকাশ পাতাল পার্থক্য। আমি চাইনা আমাকে কেউ ভুল বুঝুক । আমি কোনদিন চাইনা আমার আমি এভাবে বের হয়ে আসুক। কিন্তু এসেছে। আমি হাজার বাধার প্রাচীর দিয়েও রোধ করতে পারিনি।

আমার সেই মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাদতে ইচ্ছা করে। সেই আমার বর্ষানদী। আমার প্রেমিকা। আমার কবিতার মেয়ে । যার চোখে ঘুম নেমে এলে আমি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ি। যার বকে মুখ গুজে আমি সব কস্ট ভুলে থাকি। সে আমার স্বপ্নে আসে। তাকেও আমি বলিনি কিছুই। বলিনি আমার দায় দায়িত্বের কথা। বলিনি মাসের বেতন পেয়েই মায়ের হাতে তুলে দেই। বলিনি আমার চার বোনের বিয়ে না দিলে নিজে বিয়ে করতে পারবোনা। এসব কিছু বলিনি। যদি বলি তাহলে যদি সে চলে যায়। আমি বলিনি আমার কোন কস্টের কথা। আমি তাকে বলেছি আমার আকাশে কখনো আমাবস্যা আসেনা। আমার ঘরে কখনো ক্ষুধা আসেনা। আমার উঠোনে কখনো দুঃখ প্রবেশ করেনা। আমি তাকে দুধেভাতে আদোরে সোহাগে বুকে করে রেখে কাটিয়ে দেবো বাকী জীবন। সে এসেছে প্রতি রাতে। চুপিসারে ঘুমিয়েছে বুকে মাথা রেখে। আর দূরে দাঁড়িয়ে আমার আমি হেসেছে । ক্ষুব্ধ হয়েছে। হতাশ হয়েছে। তারপর একসময় সব বাধা অতিক্রম করে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ।

 

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *