‘গুলি করবি, কর’, হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রবিবার সন্ধ্যায় ছুরি হাতে ঢুকে পরা সেই যুবককে ঠেকাতে গেলে আমর্ড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) সদস্যদের উদ্দেশ্যে সে এই কথায় বারবার বলেছিল। পরে সেই যুবকের হামলায় নিহত হয়েছেন আনসার সদস্য সোহাগ। এছাড়া, এপিবিএন পুলিশ সদস্য ইশতিয়াক ও আশিক সেই যুবকের ছুরিঘাতে আহত হন।
এ ঘটনায় ঘাতক তরুণের নাম শিহাব উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তের গঠিত হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি। সোমবার বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ঘটনার এসব বিবরণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সোমবার এক যাত্রী বিমানবন্দরের কোনও এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছে এমন ঘটনা শুনি। তখন এ ঘটনায় কোনও ক্লিনার জড়িত কিনা খোঁজ নিতে বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকা এ কে ট্রেডার্সের একজন সুপারভাইজকে সঙ্গে কথা বলি। সেই সময়ে আমরা শুনি ওপরে গুলি হয়েছে।’
এপিবিএনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘পরে ঘটনার বিস্তারিত জেনেছি। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখেছি। হামলাকারী ঐ ছেলেটি হলুদ পোলো শার্ট পড়া ছিল, সাধারণত বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতার কাছে নিয়োজিত এ কে ট্রেডার্সের লোকজন হলুদ পোলো শার্ট পরে। তাকে দেখে এবিবিএনের সদস্যরা সন্দেহ করে, একে ট্রেডার্সের লোক অথচ তার গলায় আইডি কার্ড নেই। তখন তাকে নিরাপত্তা কর্মীরা প্রশ্ন করে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন। কিন্তু সে (হামলাকারী) যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পরে তাকে চ্যালেঞ্জ করে আটকাতে গেলে সে ছুরি দিয়ে এপিবিএন সদস্যের হাতে আঘাত করে। তখনই আতঙ্ক তৈরি হয়। এরপর সে চার নম্বর গেটের কাছে আনসার সদস্য সোহাগকে আঘাত করে। এরপর তিন নম্বর গেটের দিকে সে চলে আসে। ভেতর থেকে লোকজন তখন তাকে প্রবেশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিল, যাতে ঢুকতে না পারে। তখন রক্ত মাখা ছুরি দেখে ভয়ে কেউ কেউ সরে গিয়েছে।’
ছুরি হাতে হামলাকারী যুবক বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে পড়ে উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, ‘বিমানবন্দরে ভেতরে হওয়ায় যাত্রীদের ভিড়ে তাকে গুলি করে থামানোর চেষ্টাও করা যাচ্ছিল না। আবারও সেও (হামলাকারী) বলছিল, গুলি করবি কর। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি কিছু। তারপর উন্মাদনা শুরু হয়, যেই সামনে গিয়ে তাকে থামাতে যায় তাকেই মারতে যায়। বিমানবন্দরে চাইলেই গুলি করা খুব কঠিন। কারণ অনেক যাত্রী থাকে, অন্য কারও গায়ে লাগতে পারে। তারপরও তাকে ঠেকাতে পায়ে গুলি করে ঠেকাতে চেষ্টা করে একজন এপিবিএন সদস্য। যদিও গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ফ্লোরে লাগে।’
এপিবিএনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ভেতরে তাকে ধরার জন্য ধস্তাধস্তির সময় এপিবিএন সদস্য ইশতিয়াক নামের একজন আহত হয়। তার হাতে যে চাকু ছিল সেটা ফেরিওয়ালারা রাস্তা ঘাটে আম বা আমড়া কাটে এমন ধরনের। ধরা পড়ার পর সে কোনও কথা বলেনি। হাসপাতালেও নেয়ার পরও নিজের নামও বলেনি, শুধু বলেছে রাজশাহী।’
এ ঘটনায় ঘাতক তরুণের নাম শিহাব উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে আনসারের কোম্পানি কমান্ডার আশরাফুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
হামলার ঘটনার তদন্তে আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত ডিআইজি হাসিব আজিজকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া, সিভিল এভিয়েশন অথিরিটিও একটি তদন্ত কমিটি করেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বন্দরের নিরপত্তায় নিয়োজিত সকল সংস্থার সঙ্গে মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জরুরি বৈঠক করবেন।
এছাড়া, ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেডলাইন এ্যাসুরড সিকিউরিটি লিমিটেডও ঘটনাটির পর্যালোচনা করছে। মূলত ব্রিটিশ এই প্রতিষ্ঠান সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার তদারিকর জন্য দুই বছরের দায়িত্ব পেয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির অথোরাইজড স্টাফ মেম্বার এমা মেসন (Emma mason) ঘটনাস্থল, প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এপিবিএনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি হাসিব আজিজ সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ডিআইজি হাসিব আজিজ বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনা কেন ঘটলো, নিরাপত্তার কোনও দুর্বলতা আছে কিনা, কারও দায়িত্ব অবহেলা আছে কিনা, এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে।’
তবে এ ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কোনও কর্মকর্তা। একাধিকবার যোগাযোগ করার পরও মুখ খুলেননি তারা। সিভিল এভিয়েশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জরুরি বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করবেন।
উল্লেখ্য, গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় শাহজালালে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন সোহাগ মিয়া। এ ঘটনায় আহত হন আরও ৩জন। তারা হলো, আনসারের সদস্য সহকারী প্লাটুন কমান্ডার (এপিসি) জিয়াউর রহমান। তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত এপিবিএনের দুই সদস্য কনস্টেবল আশিক ও কনস্টেবল ইশতিয়াককে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।