অনেক আগে একটি ভারতীয় মুভি দেখেছিলাম নামঃ “রুধালী” । মুভিতে ডিম্পল কাপাডিয়া রুধালির ভূমিকায় অভিনয় করে। রুধালীরা হলো পেশাদার কাঁদুনি । তার মানে যে মানুষ মরলে কেউ কাঁদে না তাঁর জন্য “রুধালী” ভাড়া করা হয় কান্নাকাটি করার জন্য। যাতে সবাই শুনে যে এই মানুষের জন্যও কেউ কাঁদছে। গ্রামের অত্যাচারী কোন মানুষ যদি মারা যায় তাহলে তার জন্য কেউ কাঁদেনা ।

ফেসবুকে আজকাল দেখা যায় দোয়া করার জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রফাইলে দোয়া মহফিলের আয়োজন করা হয়। “দোয়া করবেন – আমার অমুক আত্মীয় অসুস্থ” এই স্টাটাসের নিচে সব বন্ধুরা দোয়া দরুদ পোস্ট করা শুরু করে। দেখলে মনে হয় এই দেশের মানুষের মন এত নরম এত স্নেহ ভালবাসাতে ভরা অথচ সেই একই দেশে মাঠে ঘাটে সড়কে গুলিবিদ্ধ বা ধর্ষিতা খন্ডিত লাশ পড়ে থাকে, এই দেশেই বহু মানুষ গার্বেজ থেকে আহার করে এই দেশেই বহু মানুষকে থানাগুলোতে প্রতিদিন নির্যাতন করে হত্যা করা হয়, এই দেশেই বহু নারীকে যৌতুকের জন্য নিয়মিত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়, মায়ের সামনে ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, ছেলেকে দিয়ে মাকে ধর্ষন করতে বাধ্য করা হয় না করলে মা ছেলেকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়, এই আজীব দেশেই আজীব আজীব কাজ কারবার চলে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা আর এইসব দোয়া মহফিল কিছুইনা লোক দেখানো সময়ের অপচয় মাত্র।

হতে পারে এই “দোয়া” এতই শক্তিশালী যে ফেসবুকের পাঁচ হাজার বন্ধু যদি “দোয়া প্রার্থনা” স্টাটাসের নিচে একে একে “দোয়া” পোস্ট করে তাহলে এই অসুস্থ মানুষটি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে বা এই মৃত মানুষটি বেহেস্ত চলে যাবে। তবে কোন গ্যারান্টি নাই। আমি বেহেস্তে যাইনি কোন দিন তাই বলতে পারবোনা সেটা কেমন। আন্দাজে এমনকি ধারণাও করতে পারিনা। তবে যাতনা পেয়েছি অনেক। মানুষকে ভুগতে দেখেছি অনেক সে থেকে নরক যাতনা কি হতে পারে তা অনুভব করেছি বহুবার। কারু দোয়াতে এই যাতনার উপশম হয়না সেটাও আংশিক সত্য হতে পারে। আমি জানিনা।

তবে আমি ভাবছি অন্য কথা। আমি ভাবছি একজন মা তার সন্তানকে সব চাইতে বেশী ভালবাসেন। সন্তান জন্মের পরে সন্তানকে দুধ না দিয়ে শুধুমাত্র ভালবাসা থেকে দোয়া করতে পারতেন তাহলেই সন্তান এই দোয়ার শক্তিতেই একাকী বাতাসে বড় হয়ে যেতো । মায়ের দোয়া ও ভালবাসাতেই সন্তান একাকী বাতাস খেয়ে বড় হতো হাটতে শিখতো, কথা বলতো, তখন খাদ্য উৎপাদন করা লাগতোনা, শৌচাগারের দরকার হতোনা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল কিছুরই দরকার হতোনা কারণ যে শিশু বাতাস খেয়ে শুধুমাত্র ভালবাসা ও দোয়াতে বড় হয়েছে সেই শিশু বাতাস খাইলে বাতাস হাগবে এবং বাতাসেই তা উবে যাবে। তেমন কিন্তু হয়না। অনেকগুলো কস্ট আছে যা মানুষের কপালে লেখা থাকেনা। অন্তরে অনুভূত হয়। অনেক কস্ট আছে যা লিখে প্রকাশ করা যায়না। আর অনেক দোয়া আছে যা আসলে ভুয়া। শুধু দোয়াতে কাজ হয়না। সাথে দাওয়া লাগে। এমন অনেক অসুখ আছে যার কোন দাওয়া নেই ফলে শুধুমাত্র দোয়ার উপরেই ভরসা করতে হয়।

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
আমি রুধালি কোথায় পাবো? দরকারই বা কি? এক হাদিসে বর্ণিত আছে – একজন মৃত সব কিছু বুঝতে পারে, শুনতে পায় কিন্তু রিএ্যাক্ট করতে পারেনা বা কথা বলতে পারেনা কারণ মৃত্যুর পরে আত্মা শরীর ত্যাগ করে। সেজন্য মৃত্যুর সাথে সাথে লাশ দাফন করা উচিৎ। লাশ বেশীক্ষণ ফেলে রাখলে চারিদিকে কেউ হাহাকার করে কেউ হাসাহাসি করে তাতে আত্মা কস্ট পায়। একজন মানুষ জীবিতাবস্তায় যত খারাপই থাকুক মৃত্যুর পরে যারা জীবিত তারা তাঁকে ক্ষমা করে দেয় এবং তার আত্মা যা সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাচ্ছে নতুন এক জীবনের শুরু করার জন্য সেই আত্মার শান্তি কামনা করে।

ফেসবুকে অপরিচিত লোকের জন্য দোয়া করলে তা কি অসুস্থ মানুষের কোন কাজে লাগে? অনেকসময় দেখা যায় যে দোয়া চাইছে তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে আসলে জানাতে চাইছে যে সে নিজে একজন মহান ব্যক্তি। একজন নরম মনের মানুষ যে নাকি তার আত্মিয়ের অসুস্থতা বা মৃত্যুর জন্য এতই শোকাভিভূত যে শেষ আশ্রয় হিসাবে ছুটে এসেছে ফেসবুকের দেওয়ালে। হৃদয় খুলে দাও । দোয়া চাই।

ব্যবসায়ীরা পন্য বিক্রি করার জন্য পন্য বাজারজাত করার আগে পন্যের বিজ্ঞাপণ দেয়। এই বিজ্ঞাপণে পন্য সম্পর্কে যা গুনাগুনের বর্ণনা থাকে সেইসব গুনের সমন্বয়ে এই পন্য উৎপাদন করলে হয়তো পন্য উৎপাদন খরচা বৃদ্ধি পেতে পারে ফলে মুনাফা কমে যেতে পারে সেজন্য অনেক সময় দেখা যায় যত গর্জে তত বর্ষেনা।

আপনার অসুস্থ আত্মীয়কে আপনি যদি আসলেই ভালবাসতেন তাহলে আপনি ফেসবুকে আসার সময় পেতেন না। আমার কোন আত্মীয় যাকে আমি ভালবাসি সে যদি অসুস্থ হয় তাহলে তো আমি সারাদিন তার পাশেই থাকবো আর চিন্তা করবো কিভাবে তাকে ভাল করা যায়। আমি ফেসবুকে আসার সময় পাবোনা। অপরিচিত লোকের কাছে দোয়া চাইবার মত মন মানসিকতা বা সময় কোথায় পাবো!!

আমার কাছে ভালবাসার ভিন্ন এক ফর্মুলা আছে। শুধু দোয়া করেই ভালবাসা জাহির করা যায়না। ভালবাসার জন্য নিজেকে উপস্থিত থাকা লাগে আর কোন কারণে যদি নিজে উপস্থিত না থাকতে পারা যায় তাহলে যেকোন উপায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে মন, শক্তি, অর্থ, সময় দিয়ে সেই অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে হতে পারে। সেটাই দোয়া, দাওয়া আর ভালবাসা। আমি যাকে ভালবাসিনা সে অসুস্থ হলে আমি তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। তার জন্য ফেসবুকে দোয়া চাইতে যাইনা।আমি জানি দুনিয়ার কেউ না কেউ তাকে ভালবাসে অথবা সে পেশাদার রুধালী ভাড়া করতে পারে কান্না করার জন্য। আগে রুধালী ভাড়া পাওয়া যাইতো ভারতের গ্রামে গঞ্জে এখন রুধালী পাওয়া যায় ফ্রি ফেসবুক প্রফাইলে।

বর্তমানে আমি অসুস্থ। কারু কাছে দোয়া চাইনি। কিভাবে এই রোগমুক্তি মিলবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। এটা নিয়ে লেগে আছি। ব্যস্ত আছি। ফেসবুক – একটি হৃদয়হীন মানুষের মেলা। ফেসবুকের হৃদয়হীন মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্ত দোয়া থেকে আরো অসুস্থ হয়ে যাবার ঝুঁকি রয়েছে তাই ঝুঁকি নিচ্ছিনা।

তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ – আর সাতক্ষীরা থেকে সীতাকুণ্ড – সাড়া বাংলাদেশে মহামারির মত ছড়িয়ে রয়েছে অপরাধ। সাড়া বাংলাদেশ এখন অপরাধিদের নিয়ন্ত্রনে। নিরীহ মানুষেরা জিম্মি। অপরাধী রোগে আক্রান্ত বাংলাদেশের জন্য ফেসবুকে দোয়া মহফিলের আয়োজন করা খুব জরুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *