ভালবাসা খুঁজে পাশবিকতায়

আমি দুই সন্তানের মা। আমার মনে আছে আমার প্রথম সন্তান যেদিন জন্ম নেয় সেদিন সকালে আমি অফিসে গেছিলাম। প্রসব বেদনা খুব কস্টের। সন্তান জন্ম নেবার পরে নার্স যখন বাচ্চাকে বুকের কাছে এনে রাখে তখন আর সেই প্রসব বেদনার কথা আর মনে থাকেনা। ধীরে ধীরে বাচ্চা যখন বড় হয়। তখন কোন দিন মন হয়না নয় মাস বাচ্চা পেটে অফিস করার বেদনা অথবা প্রসব বেদনার কথা। বাচ্চা যখন বড় হয় তখন প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা  হয়। বাচ্চার অসুখ করে। জ্বর আসে। বাচ্চা খেতে চায়না। বাচ্চা ঘুমায় না। সারারাত কাঁদে। বমি করে। আর এইসব নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি একাকী মা সেই বাচ্চার সাথে ব্যস্ত হয়ে থাকে। সাড়া রাত বাচ্চা বুকে করে গান, আর আদোর করে কেটে যায় আর সারাদিন অফিস।  বাচ্চা কি বড় হয়ে জানতে চায় তাকে কি অবস্থার ভেতর দিয়ে লালন পালন করা হয়েছে? জানতে চায়না। বাচ্চা জন্ম নিয়ে মাবাবাকে ধন্য করে অথচ বাচ্চাকে জন্ম দেবার জন্য যার কাছে সবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ তিনি হলেন বাচ্চার মা।

বাচ্চাকে পেটে নিয়ে বহন, প্রসব, লালন পালনের বিনিময়ে মা যেটা চান তা হলো বাচ্চাকে মানুষের মত মানুষ করতে। মা চান বাচ্চা সুস্থ থাকুক। বড় হোক। লেখাপড়া শিখুক । নিজেকে দেখাশোনা করার মত অবস্থা হোক । বাচ্চা স্বনির্ভর হোক। এছাড়া আর কিছু চাইবার নেই। আমার সন্তানের কাছে এর বেশী কিছু আমি আশা করিনা। আমি কোন দিন চাইনা আমি আবার সন্তানদের বোঝা হবো। আমি চাই উপার্জনক্ষম থাকতে থাকতেই আমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো খুব স্বাভাবিকভাবে, সুস্থভাবে, সুন্দরভাবে। আমার প্রস্থান হবে এক সুন্দর স্বপ্নের মত।

বাচ্চাকে মানুষ করতে মোটামুটি বাইশ তেইশ বছর সময় লাগে। এই বাইশ তেইশ বছরে একজন একাকী মায়ের যেসব নির্মম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তা হলো আর্থিক অনটন এবং বাজারে কেনাকাটার প্রতিযোগীতা। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা তাদের মুঠিতে বৈভব নিয়ে পথে বের হয় আর আমার মত একাকী মায়ের সন্তানেরা অন্য ছেলেদের হাতে নতুন নতুন খেলনা দেখে মন খারাপ করে। কেনার জন্য বায়না ধরে।  তখন আমি আমার ছেলেদের অর্থনীতি শিক্ষা দিয়েছি। আমার ছেলেরা আমাকে ঘৃণা করেছে। আমি বলেছি — দেখো সোনা, আমি তোমাদের খাবার কেনার জন্য, কাপড় কেনার জন্য, মাথার উপরে ছাদ কেনার জন্য আর অসুখের সময় ওষুধ কেনার জন্য যে টাকার দরকার হয় তা ঠিকভাবে যোগার করতে পারিনা আর ঐসব দামী দামী খেলনার নামও আমি জানিনা আর আবার মত মানুষ যদি অইসব খেলনা কেনা শুরু করে তাহলে ভাত, কাপড়, বাসস্থান, স্বাস্থ্যের পেছনে খরচা খাতে ঘাটতি দেখা দেবে। আমার ছেলেরা ওসব বুঝেনা। শুধু বুঝে ওদের মা ওদেরকে ভালবাসেনা।

তখন আমি মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করতাম। ভালবাসা আসলে কি? ছেলেরা যখন যে খেলনা কিনতে চাইবে তখন সে খেলনা কিনে দেবার মত আর্থিক অবস্থা আমার ছিলনা কোন দিন। তবে আমি ঋন করতে পারতাম ক্রেডিট কার্ড থেকে আর তা দিয়ে খেলনা কিনতে পারতাম। মাঝে মাঝে আমি ভাত, কাপড়, ছাদ, ওষুধ কেনার জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে থাকি। কোন কালেই আমি আমার খরচের বেশী উপার্জন করার মত ক্ষমতা রাখিনি। আমি আমার ছেলেদের কাছ স্পষ্ট করে বলেছি। দেখো, আমার আয় খুব কম। আমি যে আয় করি তা দিয়ে প্রতি মাসেই আমাকে ধারদেনা করতে হয়, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয় সুতারাংআমার পক্ষে অসব খেলনা কিনে দেওয়া সম্ভব না। ছেলেদের অর্থনীতি ক্লাস নিয়ে যখন আমি একাকী পথে হাটতাম তখন আমি কাঁদতাম। কাদতাম নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে। কাঁদতাম ছেলেদের আমি কতটা ভালবাসি তা বোঝাতে পারিনি বলে। কাঁদতাম এই ভেবে যে আজ যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তাহলে হয়তো আমি যখন যে খেলনা কিনতে চাইবে তা কিনে দিতাম না। কারন সেটা করলে সন্তানের বাজে অভ্যাস হবে। যখন আমি কিনে দিবোনা বা দিতে পারবোনা তখন সে আমাকে শত্রু ভাববে।

ভালবাসা আর অযথা প্রশ্রয় দেওয়া এক কথা নয়। দামী খেলনা, দামী পোষাক, দামী ঘড়ি, কিনে দেওয়া ভালবাসার মাপকাঠি নয়। মানুষের মত মানুষ করাই ভালবাসার মাপকাঠি। আমার ছেলে ঠিকভাবে মানুষ হলো কিনা, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখলো কিনা, এই বিশাল ও জটিল পৃথিবীতে টিকে থাকার সংগ্রামে একজন শক্তিশালী সৈনিক হলো কিনা আর সেভাবে আমি তাকে গড়ে তুলতে পেরেছি কিনা সেটাই দেখার বিষয়। সে চেস্টাই আমি করেছি। সেটাই আমার ভালবাসা। সন্তান পেটে এলে আমি গর্ভপাত করিনি। আমি ছেলেকে অনুভব করেছি আমার ভেতরে। প্রতিদিন তিল তিল করে অনুভব করেছি। তাকে দুনিয়াতে এনে সারাক্ষণ তাকে ভালবেসেছি, তার ডাকে সাড়া দিয়েছি, সাথে থেকেছি, প্রতি মুহূর্তে ভালবেসেছি আর সেই ভালবাসার সাথে আমি পুঁজিবাদী সমাজের ভোগ্যপন্যে কিনতে না পারার ক্ষমতাকে গুলিয়ে ফেলে নিজেকে ছোট করিনা।

সন্তান ভূমিষ্ট হবার অনেক আগে থেকেই সে মাকে চিনে যখন ভূমিষ্ট হয় তখন মিলিয়ে দ্যাখে। এই সেই মা যারা শব্দ সে শুনেছে, যার ভেতরে সে তিল তিল করে বড় হয়েছে, বাচ্চার সাথে মায়ের সম্পর্ক যত গভীর তত গভীর সম্পর্ক বাবার সাথে থাকেনা। সেই মাকে যখন সন্তান পেট্রোল ঢেলে হত্যা করার চেস্টা করে তখন মনে করতে হবে এই সন্তানকে যখন লালন পালন করা হয়েছে তখন তাকে সব কিছু দেওয়া হয়েছে শুধু ভালবাসা ছাড়া। সন্তান যখন যা চাইছে তখন সেই জিনিষ তার হাতে তুলে দেবার আগে চিন্তা করা হয়নি যে এই জিনিষ তাকে দেবার দরকার আছে কিনা। সন্তান মাবাবাকে অনুসরণ করে। মা যদি গৃহকর্মীর উপরে নিপীড়ন চালায় তাহলে সন্তান তার থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল যারা তাদের উপরে নিপীড়ন করতে শিখে। প্রিয়জনের হাতে অন্য কারুকে নির্যাতিত হতে দেখে দেখে সন্তান শিখে –  “দুর্বলের প্রতি আঘাত করা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার”। বাবা যখন মায়ের উপরে হাত তোলে, মৌখিক বা শারীরিকভাবে মাকে নির্যাতন করে তখন ছেলে বা মেয়ে সন্তানেরা যদি বাবাকে বেশী ভালবাসে তাহলে ভাবে যে বাবা আসলে মায়ের উপরে নির্যাতন করে ঠিকই করছে। মায়ের শাস্তি পাওয়া দরকার। আর সন্তান যদি মাকে বেশী ভালবাসে তাহলে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে। অনেকসময় সন্তানেরা খুব ছোট থাকে, বাবার চাইতে দুর্বল থাকে, মাকে রক্ষা করতে পারেনা তখন সে নিজেকে অসহায় মনে করে। যখন সে বড় হয় তখন সে দাম্পত্য জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে। সন্তান বড় হয়ে যখন নিজে কারু সাথে সম্পর্ক করে তখন সেই সম্পর্কে জটিলতা দেখা দেয়।

সেদিন মুগ্ধ নামের ছেলেটি তার মাবাবার শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তাকে মটর বাইক কিনে দেওয়া হয়নি সেজন্য। ধরে নিচ্ছি এর আগে মুগ্ধ মাবাবার কাছে যা কিছুই চেয়েছে সেই সব কিছুই মাবাবা মুগ্ধের সামনে এনে হাজির  করেছে আর সেকারনেই তার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে আর চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেওয়া হয়নি ফলে মাবাবার বেঁচে থাকার কোন অর্থ খুঁজে পায়নি মুগ্ধ। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে লাশ দেখেছে মুগ্ধ। মিছিলে গুলি, মিছিলে টিয়ার গ্যাস, লাঠি চার্জ, পথে পথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, মানুষ হত্যা বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ হত্যা শেখার জন্য প্রতিদিন বাংলাদেশ পুলিশ জনগনকে হাতে খড়ি দিচ্ছে। বাংলাদেশে যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের ছেলেমেয়েরা দুর্নীতি ছাড়া জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবতে পারেনা। দুর্নীতি একটি স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া হয়ে গেছে। গুলি করে বা জবাই করে বা আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা ভিডিও গেম খেলার মত স্বাভাবিক ও মাঝে মাঝে উল্লাস, আনন্দ ও বিনোদন করার মত ব্যাপার। যখন কোন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তখন কেউ তাকে বাধাঁ দিতে যায়না। যদিও দর্শকেরা সংখ্যায় বেশী তবুও অপরাধীর বিরুদ্ধে কেউ উচ্চবাচ্য না করে ফটো তুলতে থাকে বা ভিডিও করতে থাকে। তারপর সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ক্ষমতা যার  আছে সে সন্তানের জন্য আঁকাশ থেকে চাঁদ মাটিতে এনে ফেলতে পারে। মুগ্ধের সেটাই ধারণা ছিল। তার মাবাবা তাকে একটা মটর সাইকেল কিনে দিবে। কিন্তু দেয়নি সেজন্য সে তার মাবাবার শরীরে পেট্রোল ঢেলে দিয়েছে। মুগ্ধের বাবা মারা গেছেন। মুগ্ধের বাবা যাদের উপরে নিপীড়ন চালিয়ে টাকা উপার্জন করেছে তারা নিশ্চয় ভাবছেন — “যেমন কর্ম তেমন ফল”

এক হাত থেকে নেওয়া অন্য হাতে উঠিয়ে দেওয়া — দরকারের অতিরিক্ত আয় করার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় ফলে অনেকেরই দরকার অনুযায়ী জীবিকা উপার্জন করা সম্ভব হয়না। সমাজের এই শ্রেণীবিন্যাসের কারনে অনেক শিশু আজকাল মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। টাকার জন্য আর ভোগ্যপন্যের জন্য মানুষ ছুটছে। ভালবাসা হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জন্য মানুষ নয় এখন পন্য ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মানুষ যেকোন মানুষকে হত্যা করতে পারে – মানুষকে রক্ষা করার জন্য, এঁকে অন্যকে ভালবাসার জন্য, ঐক্যবদ্ধভাবে প্রকৃতি ও অপ্রাকৃতিক ঝুঁকি থেকে এঁকে অন্যকে বাঁচানোর জন্য এখন আর পরিবার গঠন করে মানুষের জন্ম দেওয়া হয়না। এখন যা কিছুই করা হয় সব কিছুই করা হয় শুধু টাকা উপার্জন করে টাকার পাহাড়ে শুয়ে থাকার জন্য ।এখন জীবন হবে বলিউডের মুভির মত।  মুগ্ধের আচরণে মুগ্ধের কোন দোষ নেই। এমন হতে পারে মুগ্ধ ইয়াবা নিয়েছিল। ইয়াবা নিয়ে যেকেউ মানুষ হত্যা করতে পারে। ইয়াবার প্রভাবে মানুষ বুঝতে পারেনা সে কি করছে।

বাংলাদেশের সমাজে মুগ্ধেরা বের হতে শুরু করেছে। আরো অনেক মুগ্ধ আছে। মাবাকে হত্যা করে যারা একে একে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *