অপরাজেয় বাংলা

১৯৭৩-১৯৭৯

এই সময়ে তিনটি প্রান প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের, প্রতিরোধ , ত্যাগ, অর্জন ও প্রান গৌরবের প্রতীক হিসাবে। একজনের কাঁধে রাইফেল, দৃঢ় প্রত্যয়ে বেল্টটি ধরা, লম্বা এই তরুণের পরনে কাছা দেয়া লুঙ্গি আর ডান হাতের মুঠোয় একটি গ্রেনেড। এর চোখে মুখে স্বধীনতার আকাঙ্ক্ষা দিপ্তমান।

থ্রি নট থ্রি রাইফেল দু হাতে কোনাকুনি ভাবে ধরা আরেক যুবক, ঈষৎ ঘাড় কাত করে রাখা এই যোদ্ধাটি যেন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। এই শহুরে যোদ্ধাটির পরনে বেলবটম ডেনিম যেন নাগরিক প্রতিমূর্তি।

রেডক্রসের ফাস্ট এইড বক্স হাতে , পরিপাটি কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা মেয়েটি হাজির হয়েছিল শাস্বত বাংলার মমতাময়ী অথছ দৃঢ়চেতা একজন নারী রূপে।

সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী এই তিনজনকে নিয়ে পত্রিকাতে একটি প্রবন্ধ লেখেন যার শিরনাম ছিল “অপরাজেয় বাংলা”

সেই থেকেই মানুষের মুখে মুখে, তিন জনের ভাস্কর্যটির নাম হয়ে যায় “অপরাজেয় বাংলা”। উল্লেখ্য ভাস্কর্যটির বেদী বা কোথাও অপরাজেয় বাংলা নামটি লিপিবদ্ধ করা নেই। ৬ ফুট বেদীর উপর নির্মিত ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট।

১৯৭২-৭৩ সালে ডাকসুর ভিপি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস ছিলেন মাহবুব জামান, ম. হামিদ তখন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক তাঁরাই প্রথম ডাকসুর উদ্যোগে অপরাজেয় বাংলার কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেন।

অনেক খোঁজাখুঁজি করে ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লা খালিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অপারজেয় বাংলা নির্মানের জন্য। ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ প্রায় তিন মাস সময় নিয়ে চার ফুট সাইজের একটি রেপ্লিকা তৈরি করেন। আর ভাস্কর্যটির বেদী তৈরির কারিগর ছিলেন রবিউল ইসলাম নামের একজন প্রকৌশলী।

১৯৭৩ সালে কাজ শুরু হলেও খুব একটা মসৃণ ছিলনা অপারজেয় বাংলার নির্মানকাল। ১৯৭৫ সালে শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর প্রথম, কাজ বন্ধ হয়ে যায়, ১৯৭৭ সালে ভাস্কর্যটি একবার প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি হয়।

সেই সময় জিরো পয়েন্ট ছিল ঢাকার কেন্দ্রস্থল। ঢাকা জিপিওকে ভিত্তি ধরে প্রাচীন ডাক ব্যাবস্থার প্রতীক হিসাবে বর্শা নিক্ষেপরত রানার বা ডাক বাহকের ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে জাতিয় মসজিদ বাইতুল মোকাররম কেন্দ্রিক মৌলভীদের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত দন্দ শুরু হয় , যেহেতু জিরো পয়েন্ট বরাবর বায়তুল মোকাররম মসজিদটিও অবস্থিত।

তবে জিরো পয়েন্টের বর্শা নিক্ষেপকারী স্থাপনা নির্মানের ধর্মীয় অনুভুতিকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মানাধীন “অপরাজেয় বাংলা” স্থাপনা বাতিল করার অপতৎপরতা শুরু করে কিছু ধর্মান্ধ অমুক্তিযোদ্ধা গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য নির্মূলের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু করলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে উত্তম মধ্যমের স্বীকার হয় এবং তাঁদের মুখে আক্ষরিক অর্থে চুনকালি লেপে দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে ভাষ্কর্য নির্মানের নিরাপত্যা পরিস্থিতি চরম ঘোলাটে হয়ে আসে।

সেই সময় সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হস্তক্ষেপে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ১৯৭৫ সালে বন্ধ হয়ে যাবার পর পর্যাপ্ত নিরাপত্যার মাধ্যমে আবার অপারাজেয় বাংলার কাজ শুরু করা হয়। ১৯৭৯ সালে ভাস্কর্য “অপরাজেয় বাংলা” নির্মান শেষ হয় এবং একদল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ৭৯র ১৬ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত করেন।

কালক্রমে “অপরাজেয় বাংলা” বাংলাদেশে মানুষের কাছে স্বাধীনতা , সার্বভৌমত্ব, গনতন্ত্র, প্রতিবাদ ও অধিকার আদায়ের জ্বালামুখে পরিণত হয়। দলমত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে “অপরাজেয় বাংলা” হয়ে ওঠে মানব হৃদয়ের আকাংকা ও কথা বলার প্রতীক।

“অপরাজেয় বাংলা” নির্মানের সাথে ক্যামেরা হাতে প্রথম থেকেই এ্যক্টিভ ছিলেন তখনকার সময়ে এ্যামেচার ফটোগ্রাফার, পরবর্তিতে প্রতিষ্ঠিত সংবাদ কর্মি মিশুক মনির।

আসুন “অপরাজেয় বাংলা’র সার্বজনীনতা নিয়ে মিশুক মনিরের চমৎকার বক্তব্যটি দেখি।

“অপরাজেয় বাংলা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছতে কোন লিফ্লেটের দরকার পরেনি…

ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, হোয়াটেভার ইট ইজ, যাদেরই রাজনৈতিক কোন বক্তব্য রাখার প্রয়োজন হতো, কোথায় হবে ?

অপরাজেয় বাংলায় হবে। এই যে একটা ইউনিভার্সেল এক্সেপ্টেন্স, এটা ৭৮, ৮৫, ৮৮ কন্সট্যান্টলি হয়েছে।

…… এরকম উদাহরণ হয়তো খুব কমই আছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এক্রস দা প্ল্যাটফর্ম, একই ভেন্যু, একই ইমেজ, একই ফিলিংস থেকে রিলেট করছে । গ্রেট এচিভমেন্ট !”

তথ্যসুত্র – পুরাতন সংবাদ পত্র ও নেট থেকে নেওয়া ছবি

ভাষ্কর্যটির মডেল হবার বিরল সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছিলঃ

আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু -লুঙ্গি পড়া
সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে , -বেলবটম প্যান্ট
আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ

(ওয়াসিম ইফতেখারের ফেচবুক থেকে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *