ছোটবেলা থেকেই আমরা শ্রেনী বিন্যাস, শোষন, বিভাজন শিখি। শিশু জন্ম নিয়েই দ্যাখে বাসার গৃহকর্মীর সাথে মাবাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্য পার্থক্য। পাশের বাসা থেকে কোন মানুষ এলে বা কোন বন্ধুবান্ধব বাসাতে এলে তাদের সহাস্য স্বাগত জানানো হয়, তারা সোফাতে বসেই গল্প করে কিন্তু ঘরের গৃহকর্মী যে দিনরাত বাসন মাজছে, মশলা পিষছে, মেঝে সাফ করছে, সে বা তার পরিবারের কেউ এলে সেভাবে আদোর যত্ন করে সোফাতে বসে গল্প করেনা। মেঝেতে বসেই বা বাইরে দাঁড়িয়ে কাজের কথা বলে চলে যেতে হয়। এর কারণ হলো গৃহকর্মীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার শ্রম বিনামূল্যে বা নূনতম মূল্যের কমে ক্রয় করা হচ্ছে। গৃহকর্মীকে শোষন করা হচ্ছে এবং ঘৃনা বা করুনার দ্বারা দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। গৃহকর্তার ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে। গৃহকর্মীর শ্রম বিক্রি হচ্ছে কিন্তু নায্য মজুরী নির্ধারনের কোন উপায় নেই তাই অবস্থার শিকার হিসাবে গৃহকর্মী শোষিত হচ্ছে। ধনী দরিদ্রের পার্থক্য শুধু যে গৃহকর্তার ছেলেমেয়েরা শিখছে তা নয় গৃহকর্মীর সন্তানেরাও শিখছে সমাজে তাদের স্থান কোথায়। গৃহকর্তা কিন্তু গৃহকর্মীর উপরে সম্পুর্নভাবে নির্ভরশীল কিন্তু সেটা যাতে গৃহকর্মী বুঝতে না পারে সেজন্য তাকে মজুরী কম দেওয়া হয় ও সামাজিক পার্থক্য বজায় রাখা হয়। গৃহকর্মীর প্রতি গৃহকর্তা কৃতজ্ঞ নয় বরং নির্মম। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নেই। একজন গৃহকর্মী গেলে অন্যজন আসবে গৃহকর্তার হাতে সেই ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে।
আমরা হিন্দুদের কাস্ট সিস্টেম ঘৃণা করি। কিন্তু আমরা যখন একজন গৃহকর্মীর সাথে কথা বলি আর একজন ধনী ব্যক্তির সাথে কথা বলি তখন দুইজনকে একইভাবে সমীহ করিনা। ফলে হিন্দুদের জাত পাত ভেদাভেদের মতই আমরাও অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে মানুষকে সমীহ করে ও মানুষের সাথে মানুষের ভেদাভেদ বজাই রেখে চলি। ইসলাম ধর্মে কোন জাত পাত ভেদাভেদ নাই কিন্তু মুসলিম বিশ্বের সম্পদশালী দেশগুলোতে সুষ্পষ্টভাবেই ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য রয়েছে। দরিদ্র দেশের মুসলিম শ্রমিকদেরকে ধনী দেশের শেখরা বলে “আল মিসকিন”। অথচ মুসলিম বিশ্বের সবগুলো ইসলামিক রাস্ট্রেই পশ্চিমা দেশের নাগরিকদের জন্য আলাদা এলাকা রয়েছে যেখানে তারা তাদের মত করে নিরাপদে ও আনন্দে বসবাস করে থাকে। বিদেশে আছে বলে তারা যেন দেশের অভাব অনুভব না করে সেজন্য পশ্চিমা উন্নত বিশ্বের ধনী নাগরিকদের জন্য সৌদী আরবে রয়েছে আলাদা এলাকা যেখানে মদ পানের ক্লাব আছে, জুয়া খেলার ক্যাসিনো আছে, বিকিনি পরিধান করে সমুদ্রের কিনারে বসার ব্যবস্থা রয়েছে এবং রয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত আক্রমণ করে তখন সৌদী আরবও আক্রান্ত হবার ভয়ে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র থেকে আর্মী এনে জেদ্দাতে ও পবিত্র কাবা শরীফে মোতায়েন করে । মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের আর্মীদের আনন্দে রাখার জন্য থাইল্যান্ড থেকে যৌনকর্মী ও মদ সরবরাহ করা হয়।
শোষন করতে গেলে শ্রেনী বিন্যাস করতে হবে আর শ্রেনী বিন্যাসকে টিকিয়ে রাখতে গেলে ঘৃণাকে উজ্জীবিত রাখতে হবে। ঘৃণা অপরাধ। জাত, পাত, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, দেশ নির্বিশেষে ঘৃণা হলো যেকোন অপরাধের মত একটি অপরাধ। আমার অনেক বন্ধু আছে। অনেক পরিচিত আছে। যারা বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী। আবার কেউ কেউ কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নয়। এদের সকলেই যে সবাইকে ঘৃণা করে তেমন কিছু নয় তবে একটা পার্থক্য সুস্পষ্টভাবেই দেখা যায়। প্রবাসে একজন বাংলাদেশী অন্য একজন বাংলাদেশীর সাথে দেখা হলেই প্রথমে জেনে নেয় দেশে সে কোন এলাকাতে ছিল বা কোন এলাকায় বসবাস করতো । ধানমন্ডী, গুলশান, বনানী, ইস্কাটন শুনলেই কণ্ঠস্বর বদলে গেলো আর চৌধুরীপাড়া শুনলেই তেমন আর গুরুত্ব নাই। বাংলাদেশের সকল ধনী ব্যক্তিই অসাধু । সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করে বাংলাদেশের মত দেশে কেউ পাঁচ হাজার টাকা বেতন পেয়ে দশ তলা বাড়ী বানাতে পারেনা। বাংলাদেশের দরিদ্ররা দরিদ্রদের ঘৃণা করে কিন্তু ধনীদের সমীহ করে। যারা শোষণের মাধ্যমে শ্রেনী বিন্যাস করে ঘৃনাকে টিকিয়ে রেখেছে তাদেরকে সমাজে সমীহ করা হয় আর সেকারনেই ঘৃণা টিকে আছে।
সেকারণেই হিন্দু কাস্ট সিস্টেমের সাথে মুসলমানদের সমাজের মালিক-চাকর সম্পর্কের কোন পার্থক্য নেই । হিন্দু ধর্মে যেমন শোষন, বিভাজন ও ঘৃনা রয়েছে তথাকথিত মুসলমানেরাও তাদের যার যার ঘরে, সমাজে ও দেশে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে শোষন, বিভাজন ও ঘৃণা বজাই রেখেই চলেছে। একজন ব্রাম্ভন যেমন একজন দলিতের সাথে বসে ভাত খায় না ঠিক তেমনি একজন অসাধু কেরানী যে নাকি ১৫০০০ টাকা বেতন পায় কিন্তু যার ঢাকাতে তিন চারটা বিল্ডিং আছে সে একজন রাস্তার ভিখারীর সাথে ভাত ভাগ করে খাবেনা। কারণ সে একদিন রাস্তার ভিখারি ছিল। যখন সে রাস্তার ভিখারি ছিল তখন সে জেনেছে উপরে উঠতে গেলে কি কি করতে হয়। উপরে উঠতে গেলে উপরে উঠার জন্য যা কিছু করা দরকার সব কিছু করতে থাকতে হয় কিন্তু ভুলেও নীচের দিকে তাকাতে হয়না। তখন সে ভিখারীদের ঘৃণা করে। চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের অনেক ভিখারিই এখন বাংলাদেশের পুঁজিপতি । বলাই বাহুল্য এইসব ভিখারীরা এখন সম্পদশালী হবার ফলে শোষন, বিভাজন ও ঘৃনার মাধ্যমে এরা শুধু ভিখারীই সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশের মত দেশে সৎভাবে জীবিকা উপার্জন করার পথগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। হয় ভিখারি হও নাহয় অপরাধী না হয় অপরাধীদের তোষামোদ করে ঝুলে থাকো মাঝামাঝি। যাকে ঘৃণা করা দরকার তাকে ঘৃণা করা হচ্ছেনা। যা কিছু ঘৃণা করা দরকার সেইসব কিছুকে ঘৃণা করা হচ্ছেনা। অপরাধকে ঘৃণা করা দরকার। অথচ অপরাধকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। ফলে অপরাধ টিকে যাচ্ছে। সততা পরাজিত হচ্ছে। লাঞ্ছিত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে।
খুব বেশীদিন আগের কথা না খুব সম্ভবত ২০১৩ সালে কিছু ব্লগার ইসলাম বিরোধী ব্লগ করে। ফলে সাড়া বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে আলেমরা এই ব্লগের প্রতিবাদ করতে ঢাকাতে আসে। তখন ফেসবুকের বিভিন্ন প্রফাইলে মাদ্রাসার এইসব ছেলেদের জন্য অবজ্ঞা ও ঘৃণা করে মন্তব্য করতে দেখা যায়। এই বছরে গুলশানের একটা রেস্টুরেন্টে সাজানো জংগী নাটকে যখন সুপরিকল্পিতভাবে কিছু মানুষকে হত্যা করা হয় “দেশে জঙ্গি আছে সেটা বহির্বিশ্বে প্রতিষ্টিত করার জন্য” তখন সাড়া ফেসবুকে কান্নার রোল উঠে। গুলশানের জন্য সবাই প্রে করা শুরু করে । আমরা আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি আমাদের নিরাপত্তার জন্য । আমাদের প্রিয় মানুষের জীবনের দীর্ঘায়ূর জন্য। তবে বাংলাদেশীরা প্রে করে প্যারিস বা গুলশানের জন্য । এতিম বা মাদ্রাসার ছেলেদের জীবনের জন্য ওরা প্রে করেনা। ওদের ঘৃণা করে। কারণ খুব সহজ। কারণ ওদের কাছে টাকা নাই। আল্লাহ্র সৃষ্টি নয়, মানুষের জন্য ভালবাসা নয়, দেশ নয়, ধর্ম নয়, টাকাই সকল ভালবাসা ও শ্রদ্ধার উৎস ।
শোষকদের মানুষ ভালবাসে। আদোর করে। সমীহ করে। সেজন্য শোষন, বিভাজন ও ঘৃণা টিকে আছে ও থাকবে।
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা – প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা