চল্লিশ হাজারেরও বেশিবার ধর্ষণ করা হয়েছিল তাকে!

পুরুষের বিকৃত কামনার পরিণতি হলো ধর্ষণ। সেই ধর্ষণ কোন রক্ষণশীল এবং অশিক্ষিত সমাজে ঘটলে সব দোষ গিয়ে পড়ে নির্যাতিতা মেয়েটির উপর। মেয়েটির চরিত্রের দোষ, পোশাকের দোষ দিয়ে অপরাধী ধর্ষক পার পেয়ে যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় নির্যাতিতা। আবার কেউ কেউ আছে যারা রুখে দাঁড়ায়। সমাজের মুখে জুতো মেরে নতুন করে সাজায় নিজের জীবন। তেমনি একজন সাহসীনি মেক্সিকোর মেয়ে কার্লা জাকিন্তো। টানা ৪ বছর তাকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ জন পুরুষ ধর্ষণ করতো! সংখ্যাটা যোগ করলে হয় ৪৩,৮০০ বার! ভাবা যায়? কতটা নৃশংস বিকৃত আমাদের এই পুরুষ সমাজ! বন্দিশালা থেকে পালিয়ে এসে নিজের জীবনের লড়াইয়ের অসাধারণ কাহিনি তুলে ধরেছেন সকলের সামনে, যাতে তার জীবনযুদ্ধ অন্যদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।

কার্লার শৈশব খুব সুখে কাটেনি। মাত্র ৫ বছর বয়সেই এক আত্মীয়ের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন কার্লা। তার বয়স যখন ১২ সেই সময় একটি ২২ বছরের যুবকের সঙ্গে আলাপ হয় কার্লার। পৃথিবীর সমস্ত সুখ কার্লার জীবনে এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় সেই ছেলে। একদিন কার্লাকে পুয়েবলা নামের শহরে দেখা করতে বলে সে। কার্লা গিয়ে দেখেন, যুবকটি একটি লাল রং-এর বিলাসবহুল পন্টিয়াক ফায়ারবার্ড-ট্রানস-আম গাড়ি চালিয়ে এসেছে। গাড়িটির চাকচিক্য, আর একটা রঙিন সুখী জীবনের স্বপ্ন চোখ ধাঁধিয়ে দেয় কার্লার। সেই যুবককে ভর করে কার্লা ভেসে প়ড়েন নতুন জীবনের খোঁজে। সেই ছেলের সঙ্গে ঘর বাঁধেন কার্লা।

প্রথম মাস তিনেক যেন স্বর্গসুখে কাটে তার। তারপর আলাদা একটি ফ্ল্যাটে কার্লাকে নিয়ে উঠে যায় সেই যুবক। যুবকটি সারাদিন কাজের অছিলায় বাইরে বাইরে কাটাত। আর তার অনুপস্থিতিতে কিছু যুবক-যুবতী কার্লাদের ফ্ল্যাটে আসত শারীরিকভাবে মিলিত হওয়ার উপযুক্ত নিভৃতির খোঁজে। যুবকটিকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে সে বলত, ছেলেগুলি তার তুতো ভাই সব, নিজেদের বান্ধবীদের নিয়ে তারা তার ফ্ল্যাটে আসে নিভৃতে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করবে বলে। কিন্তু কিছুদিন পরে বিষয়টি অসহ্য হয়ে উঠল কার্লার কাছে। তিনি সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন নিজের সঙ্গীকে, ‘‘ব্যাপারটা কী বল তো?’’ যুবকটি কোনও রাখঢাক না করেই জানাল যে, সে আসলে বেশ্যাদের দালাল। নারী পাচারচক্রের সঙ্গেও সে জড়িত। পাশাপাশি এটাও সে স্পষ্ট করে দিল যে, কার্লাকেও এবার নামতে হবে যৌন পেশায়। কীভাবে ‘খদ্দের’দের খুশি করতে হবে, কীভাবে কথা বলতে হবে তাদের সঙ্গে, কত টাকা ‘দাম’ চাইতে হবে তাদের কাছ থেকে— সবকিছু সে বুঝিয়ে বলে কার্লাকে। কার্লার স্বপ্ন মু‌হূর্তের মধ্যে ভেঙে যায়। গুয়াদলাজারার বেশ্যাপল্লীতে সেই যুবকটি কার্লাকে নিয়ে গিয়ে তোলে। তারপর শু‌রু হয় কার্লার নরকযন্ত্রণা ভোগ।

সংবাদমাধ্যমকে কার্লা জানিয়েছেন, ‘‘সকাল ১০টা থেকে শুরু হত আমার ঘরে খদ্দের আসা। চলত মাঝরাত পর্যন্ত।”

বিচিত্র সেইসব মানুষ, উদ্ভট তাদের চাহিদা। একবার এক চাষাভুষো মানুষ এল কার্লার ঘরে। সে ঘরে ঢুকেই লোহার চেন দিয়ে পেটাতে শুরু করে কার্লাকে। চুলের মুঠি ধরে মারে যথেচ্ছ কিল, চড়, ঘুষিও। লোহার রড গরম করে ছ্যাঁকাও দেয় কার্লার গায়ে। এমন পাশবিক আচরণে কী সুখ পেয়েছিল সেই মানুষটি, তা আজও বুঝতে পারেন না কার্লা।

কিন্তু কেন কার্লা এমন নরকযন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছিলেন? আসলে ১৫ বছর বয়সেই সেই যুবক সঙ্গীটির সন্তানের মা হন কার্লা। সন্তানের জন্মের পরেই বাচ্চাটিকে কার্লার কাছ থেকে কেড়ে নেয় বাচ্চাটির বাবা। লুকিয়ে রাখে কোনও গোপন আস্তানায়। এই নারকীয় জীবন থেকে যখনই মুক্তির কথা তুলতেন কার্লা, তখনই তাকে ভয় দেখানো হত— ওই যুবক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের কথা না শুনলেই মেরে ফেলা হবে শিশুটিকে।

আর প্রশাসন? তারাও কি মুখ বুজে ছিল? সিএনএন-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কার্লা জানিয়েছেন, একবার গুয়াদলাজারার লালবাতি এলাকায় পুলিশী অভিযান হল। কার্লা সহ অন্যান্য মেয়েদের সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হল অন্য একটি আস্তানায়। কিন্তু, কী আশ্চর্য, মেয়েগুলিকে মুক্তি দেওয়ার বদলে পুলিশ জোর করে তাদের অশালীন ভিডিও তুলে নিল! তারপর শুরু হল ব্ল্যাক মেইল। বলা হল, টাকাপয়সা দিয়ে পুলিশকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে এই ভিডিওগুলি পাঠিয়ে দেওয়া হবে ওইসব মেয়েদের পরিবারের সদস্যদের কাছে। নাবালিকা মেয়েগুলির কান্না সেদিন পুলিশের মন গলাতে পারেনি।

১৬ বছর বয়সে নিষিদ্ধপল্লী থেকে পালাতে সক্ষম হন কার্লা। আজ কার্লার বয়স ২৩। আজ তিনি দিকে দিকে সভাসমিতিতে বলে বেড়ান নিজের অভিশপ্ত জীবনের কাহিনি। উদ্দেশ্য একটাই— নারী পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নিজের ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘আমার ঘরে সেই সময় প্রতিদিন ৩০ জন করে পুরুষ আসত। বছরে ৩৬৫ দিন এইভাবে কেটেছে টানা ৪ বছর। সেই হিসেবে মোট ৪৩৮০০ বার ধর্ষিত হয়েছি আমি।”

একটি মেয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সঙ্গে যৌন মিলনকে ‘ধর্ষণ’ ছাড়া আর কিছু বলতে রাজি নন কার্লা। তিনি জোরের সঙ্গে বলছেন, ‘‘আমি নাবালিকা মেয়েদের সতর্ক করে দিতে চাই যে, তারা যেন তাদের অল্প বয়সে কোনওরকম প্রলোভনে পা না দেয়। অর্থের লোভ যেন তারা না করে। না হলে আমি যে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছি, তা ভোগ করতে হবে তাদেরও।” অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে এসেছেন কার্লা। মনের জোর তার অপরিসীম, টানা চার বছর নিগৃহীতা হওয়ার পরেও সেই মনোবলে চিড় ধরেনি এতটুকু। তিনি বিজয়িনী। পাশাপাশি অন্য মেয়েরা যেন অল্প বয়সে তার মতোই ভুল না করে বসে, তা সুনিশ্চিত করতেও তিনি তৎপর। কার্লাকে অসংখ্য স্যালুট!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *