রূপপুরের আর্তনাদঃ পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাত্র লাখ কোটি টাকা বাজেট

মুখবন্ধ
আসলে কি লিখব, কিভাবে বলব, কিছুই বুজতে পারছি না। এক দিকে চলছে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অন্য দিকে প্রায় নিভৃতে এই দেশের সব থেকে বড় ঋন চুক্তি স্বাক্ষরিত হল তাও বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প।।

রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম প্রস্তাব করা হয় ১৯৬১ সালে। সে সময় ২৫৩ দশমিক ৯০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং রূপপুরে ৭০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন হয়। ১৯৬৪ এবং ১৯৬৬ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে কানাডা, সুইডেন কিংবা নরওয়েজিয়ান সরকারের সাথে আলোচনা হলেও বাস্তব অগ্রগতি হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে আলোচনা হলেও কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। সর্বশেষ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার পুনরায় রাশিয়ার সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের আলোচনা শুরু করে এবং একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। সে হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটির যাত্রা ২০১৩ সালে।

২৬২ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে বিশালাকার এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার ২শ কোটি টাকা, যেটি ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ১০ ভাগ অর্থাৎ ১.২৬৫ বিলিয়ন ডলার সরকারের। অবশিষ্ট ৯০ ভাগ অর্থাৎ ১১.৩৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাষ্ট্রীয় ঋণ চুক্তির মাধমে রাশিয়া প্রদান করবে। এত বিপুল পরিমান বৈদেশিক ঋন আসলে দেশ বিক্রির অন্য রূপ মাত্র। এর সুদের হার হচ্ছে ১.৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশকে ১০ বছর রেয়াতসহ বছরে ২ কিস্তিতে ২০২৭ সাল থেকে ২৮ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

কেন আমি বাংলাদেশে পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধী?

নিরাপত্তাজনিত কারণঃ যেকোনো পারমানবিক প্রকল্পে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করলেও যেকোনো সময় সামান্য ভুলে ঘটে যেতে পারে বড় রকম দূর্ঘটনা। পারমানবিক প্রকল্পে সবচেয়ে হুমকি ধরা হয় ভূমিকম্পকে। বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্প প্রবণ এবং বন্যা পীড়িত দেশ। রূপপুর প্রকল্প এলাকাটি একটি ভূচ্যুতির ওপর অবস্থিত। এ ধরনের ভূচ্যুতি ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু বা উৎসস্থল হয়ে থাকে। বলা হচ্ছে এ পারমানবিক প্রকল্পটি ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে। কিন্তু আমরা দেখেছি প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দেশ জাপান নিজস্ব পারমানবিক প্রকল্পকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। এবং জাপান এখন তার সবগুলো পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দিচ্ছে। আর রাশিয়ার ভিভিইআর-১০০০ মডেলের প্রকল্পে নিম্নমানের যন্ত্রাদি সরবরাহের খবর নিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে ঘন ঘন ভুমিকম্প এক মারাত্মক অশনি সংকেত।

এছাড়া পারমানবিক কেন্দ্রগুলোকে ইদানিং নাশকতার টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের হামলা মোকাবিলা করার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। এবং এ ধরনের হামলায় যে বিপর্যয় ঘটবে তা বাংলাদেশের মতো ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি দেশের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। বাহিরের আক্রমনের কথা বাদ দিলেও দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে দেশের ভেতরের জঙ্গি/মৌলবাদী শক্তিগুলোর টার্গেট হতে পারে এ ধরনের পারমানবিক ক্ষেত্র।

রয়েছে ভাইরাস আক্রমনের শঙ্কা। কিছুদিন পূর্বে ইরানের পারমানবিক স্থাপনাতে ভাইরাস আক্রমন করা হয়। এতে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।

গোপন চুক্তিঃ রাশিয়ার সাথে স্বাক্ষরিত পারমানবিক প্রকল্পে সহযোগিতামূলক এ চুক্তি গোপন রাখা হয়েছে। সাধারণত দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো গোপন রাখা হয়। তাই নিশ্চিতভাবেই এ চুক্তি নিয়ে সকল রকম সন্দেহের উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তেল-গ্যাস নিয়ে বিদেশী কোম্পানীগুলোর সাথে করা চুক্তিতে কোথাও ৮০ ভাগ, কোথাও ৯৬ ভাগ পর্যন্ত মালিকানা ছেড়ে দিতে হয় কোম্পানীগুলোকে। এ চুক্তি মোতাবেক উৎপাদিত বিদ্যুতে রাশিয়ার ভাগ কত সে বিষয়টি জানানো হচ্ছে না।

পারমানবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাঃ বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশে পারমানবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করার কোনো সুযোগ নেই। যথার্থভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা না হলে এর থেকে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। বলা হচ্ছে চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে ‘স্পেন্ট ফুয়েল’ রাশিয়া ফেরত নিবে। কিন্তু এটি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এজন্য তাদের কোনো চার্জ দিতে হবে কিনা এবং যদি হয় তবে তার পরিমাণ কত? প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেন, পারমাণবিক বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন চুক্তি করা হয়নি। আশা করছি, এটা নিয়ে রাশিয়ার সাথে শিগগির আরেকটি চুক্তি সই হবে। যাতে তারা এ বর্জ্য নিয়ে যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তার মানে পারমানবিক প্রযুক্তির সব থেকে ভয়াবহ সেফটি ইস্যুকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করা হয়েছে।

পারমানবিক বর্জ্য ঝুকিঃ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্যপদার্থ থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রাও খুব ভয়াবহ। এই বর্জ্য পদার্থের মধ্যে থাকে প্লুটোনিয়াম পরমাণুর বিভিন্ন আইসোটোপ। যেমন প্লুটোনিয়াম ২৩৯, ২৩৮, ২৪১ ইত্যাদি। এগুলোর তেজষ্ক্রিয়তা বজায় থাকে হাজার হাজার বছর ধরে, অর্থাৎ হাজার বছর ধরেই এগুলো দূষণ ছড়ায়। এই বর্জ্যসমূহ নিরাপদে নিষ্কাশনের কোনো উপায় এখনও আবিষ্কার করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র এত দিন লাসভেগাস থেকে ১০০ মাইল দূরে পাহাড়ের গভীরে এই পারমাণবিক বর্জ্য পুঁতে রাখত। ২০১০ সালে পাহাড়ে পুঁতে রাখার কর্মসূচি পরিত্যক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ফান্ড রয়েছে, যার পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে আমরা এই পারমাণবিক বর্জ্য পুঁতে রাখব কোথায়? ঘণবসতিপূর্ণ এ দেশে এমন কোনো পরিত্যক্ত অঞ্চল নেই যেখানে আমরা পারমাণবিক বর্জ্য সরিয়ে রাখতে পারি। মাটির গভীরে পুঁতে রাখলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে যা আমাদের দেশে বিরাট বিপর্যয় নামিয়ে আনবে। ফলে পারমাণবিক বর্জ্য আমাদের ঘাড়ে এক বিরাট সমস্যা হিসাবে আবিভূত হবে।

তাছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে লোকদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র (গ্লাভস, পোষাক ইত্যাদি) পরিপূর্ণভাবে তেজষ্ক্রিয়ামুক্ত করার পদ্ধতি এখনও জানা নেই। ২০ জানুয়ারি ২০০০ নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক রিপোর্টে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র কারখানায় কর্মরত ৫ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। এসব পরিস্থিতি বোঝাতেই নিউজিল্যান্ডের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী জন পোর্টার বলেছিলেন, “মানুষ এখনও পরমাণু চুল্লীর সাথে বিশ্বাসে ঘর করবার মতো বড় হয়ে ওঠেনি।”

পানির সরবরাহঃ চুল্লি পরিচালনার জন্য প্রচুর পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়। এ প্রকল্প সংলগ্ন নদী পদ্মা থেকে এ পানির যোগান দেয়া হবে। দীর্ঘকাল টানা পদ্মার পানি বিয়োগে উক্ত এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ বিপুল পরিমাণ পানি তোলার মাধ্যমে স্থায়ী মরুময়তার সৃষ্টি হবে।

জানা গেছে, নির্মাণ পর্যায়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৫০ কিউবিক মিটার পরিমাণ পানি এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য প্রতিবছর ৮১ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রয়োজন। এতো পানি কোথা থেকে আসবে, জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব সিরাজুল হক খান সোজাসাপ্টা বলেন, রিসাইক্লিং করে অর্ধেক পানি পুনরায় ব্যবহার করা হবে। পদ্মায় যখন সর্বনিম্ন পানি প্রবাহ থাকে সে সময়ের এক-দশমাংশের কম পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার হবে।

জাতীয় স্বার্থঃ বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে তা রাশিয়ার ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করে দেবে। কেননা শুধু রাশিয়ার প্রযুক্তি সহায়তা বা ইঞ্জিনিয়ারই নয়, বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য যে কাঁচামাল দরকার হবে (ইউরেনিয়াম), তার সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সব সময় আমাদের সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। এমনকি আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করে হলেও। এ প্রকল্প যতদিন চলবে ততদিন দুইটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারে? আমরা অতি সম্প্রতি দেখেছি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আশির দশকে ইসরায়েলি বিমান হাজার মাইল উড়ে গিয়ে ইরাকের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বোমা ফেলে তা ধ্বংস করে দিয়েছিল। আজকের দিনে আর যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন নেই। ‘সাইবার ওয়ার’ই যে-কোনো পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস তথা অকার্যকর করার জন্য যথেষ্ট।

আমাদেরকে বলা হচ্ছে, যে কোন ধরণের ঝুকি মোকাবেলায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি যখন ফুকুশিমা ট্রাজেডি ঠেকাতে পারে না তখনই আরো আধুনিক তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি বাজারে আসে আর ঠিক সে সময়ই ল্যাবরেটরীতে প্রস্তুত হতে থাকে চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি। প্রযুক্তির আধুনিকায়নে এটি খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আধুনিকায়নের এ সূত্র পারমাণবিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে খাটে না। কারণ পারমাণবিক দূর্ঘটনায় যে বিকিরত কণা ছড়ায় তা ঢুকে পড়ে আমাদের শরীরে, খাবারের মাধ্যমে এসে পড়ে আমাদের খাদ্যশৃংখলে, মাটি-পানি-বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে থাকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। জীনগত পরিবর্তন কিংবা ক্রমোজোমাল পরিবর্তনে এটি ধীরে ধীরে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এর ক্রমবর্ধমান প্রকটতা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান নিশ্চিত কিন্তু পরিণতি নিয়ে এখনও সন্দিহান। তাই যে পারমাণবিক ব্যবস্থার ত্রুটি পরিণতিই এখনও ধরা পড়েনি সে ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের কথা বলে রূপপুর প্রকল্পের যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা নিতান্তই হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

অনেকেই ভাবতে পারেন সদ্য ঘটে যাওয়া ফুকুশিমা ট্র্যাজেডির আপাত স্বল্প ক্ষতি উল্লেখ না করে আশির দশকে ঘটা চেরনোবিল দূর্ঘটনার ভয়াবহ পরিণতির কথা তুলে ধরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ভয় ধরানোই বোধহয় এ লেখার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

অন্যান্য দূর্ঘটনার মত তাৎক্ষণিক মৃতদেহ গণনা করে পারমাণবিক দূর্ঘটনার প্রকটতা পরিমাপ করা যায় না। জাতীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক নানান দিকে এর প্রভাব ফুটে ওঠে ধীরে ধীরে। যেমন, ফুকুশিমা ট্র্যাজেডির পর জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তহুকো’র উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের ৭০-৮০ ভাগ বাজার চলে গেছে চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দখলে। এমনকি তেজস্ক্রিয়তার কারণে দূর্ঘটনা অঞ্চলের ৩০০ কিলোমিটার দূরবর্তী কায়াসু কোম্পানীর উৎপাদিত দ্রব্যের বিক্রি কমে গেছে দুই-তৃতীয়াংশ। ফুকুশিমা দূর্ঘটনার দুই বছর পর ২০১৩ এর জুন মাসে ওই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে জাপানের প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মিশিও কাকু বলেন, ফুকুশিমা দূর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নেই লাগবে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ বছর। তাই ফুকুশিমা ট্র্যাজেডির প্রকৃত ক্ষতির ন্যূনতম ধারণা পেতেও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক দশক।

নীতি-নির্ধারণী মহল রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ান প্রযুক্তি আমদানীর গর্বে যখন খুশীতে আত্মহারা তখন পারমাণবিক বিদ্যুতের কদর্য রূপ আর রাশিয়ার তথ্য গোপনের সংস্কৃতিতে আমাদের সামনে শুধুই আসন্ন সংকটের কালো ছায়া।

রূপপুরে ৭ মাত্রার কোন দূর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ মানুষ। এই ৫০ লক্ষ জন হয়তো শাসকগোষ্ঠীর কাছে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ ভাগ। তাই বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার ধোয়া তুলে ক্ষুদ্রতর এই ৩ ভাগের বলি দিতে নীতিনির্ধারকেরা হয়তো কুন্ঠা বোধ করবেন না।

একটা উদাহরণ দিলেই রাশিয়ার তথ্য গোপনের জালিয়াতি আরো পরিষ্কার হবেঃ

চেরনোবিল দূর্ঘটনার পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফার্স্ট মিনিষ্টার সিচেপিনের ১৯৮৬ সালের ২১ শে মে পাঠানো চিঠিতে এই বলে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তেজস্ক্রিয়তায় অসুস্থ হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হবে হাসপাতাল ত্যাগ করার সময় যদি প্রকট তেজস্ক্রিয়তার কোন লক্ষণ না থাকে তবে অসুস্থতার কারণ হিসেবে সাধারণ স্মৃতিবিভ্রাট (vegetovascular dystonia) লিপিবদ্ধ করতে হবে। এই নির্দেশের ফলে তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ হিসেবের বাইরেই থেকে যায়।

১৯৮৬-২০৫৬ সাল পর্যন্ত সময়কালের প্রজন্মকে বলা হয় চেরনোবিল প্রজন্ম যার উপর সরাসরি প্রভাব পড়বে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। নিচে একটি টেবিলের মাধ্যমে এই চেরনোবিল প্রজন্মের কতজন শুধুমাত্র তেজস্ক্রিয়তাজনিত ক্যান্সারে মারা যাবে সেটি উল্লেখ করা হলঃ

টেবিলঃ চেরনোবিল দূর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা জনিত ক্যান্সারে চেরনোবিল প্রজন্মের সাম্ভাব্য মৃত্যু (Malko, 2007)
দেশ তেজস্ক্রিয়তা জনিত ক্যান্সারে মৃত্যু
বেলারুশ ১৭,৫৪৬
ইউক্রেন ১৭,৫৪৬
রাশিয়া ১৫,৭৪৮
জার্মানী ৫,৭৫৪
রোমানিয়া ৩,২৩৬
অষ্ট্রিয়া ৩,১৩১
যুক্তরাজ্য ২,৬৫৪
ইতালী ২,৩৩৭
অন্যান্য ১২,৮৯৯
সর্বমোট ৮৯,৮৫১

ক্যান্সার বহির্ভূত মৃত্যুর হুমকি তেজস্ক্রিয়তাজনিত ক্যান্সার মৃত্যু থেকেও বেশী। এর যৌক্তিকতা ১৯৯০-২০০৪ পর্যন্ত বর্ধিত মৃত্যু সংখ্যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।

টেবিলঃ ১৯৯০-২০০৪ পর্যন্ত চেরনোবিল তেজস্ক্রিয়তা দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যু (Khudoley et al., 2006)
দেশ ইউরোপিয়ান রাশিয়া বেলারুশ ইউক্রেন সর্বমোট
মৃত্যু ৬৭,০০০ ৫৯,০০০ ৮৬,০০০ ২১২,০০০
তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ের তুলনায় কখনো কখনো বাতাস-পানি বা পরিযায়ী প্রানী বাহিত হয়ে সেকেন্ডারী পর্যায়ের সংক্রমণে আরও তীব্র হয়ে ওঠে। একারণেই বিকলাঙ্গতা, মানসিক অপরিপক্কতা, বয়োবৃদ্ধি সহ মারাত্মক সব উপসর্গ প্রজন্মান্তরে ছড়াতে থাকে। এই প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সমগ্র জীবজগতে। প্রকৃতিতে এর পরিবর্তন কৃষির মাধ্যমে তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার কারণে বেলারুশে ২৬৫,০০০ হেক্টর, ইউক্রেনে ১৩০,০০০ হেক্টর এবং রাশিয়ায় ১৭,০০০ হেক্টর কৃষিজমি ইতোমধ্যেই চাষাবাদের অনুপযুক্ত বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। (Aleksakhin et al., 2006)

থ্রী মাইল আইল্যান্ড দূর্ঘটনা, চেরনোবিল দূর্ঘটনা, ফুকুশিমা দূর্ঘটনার মত একের পর এক অভিশপ্ত ঘটনায় সাধারণ মানুষ যখন আতংকগ্রস্ত তখন আমাদেরকে বুঝানো হচ্ছে- রূপপুরে বসানো হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। বোয়িং বিমান এর উপর বিদ্ধস্ত হলেও নাকি এ কেন্দ্রের কিছু ঘটবে না।

কিন্তু আমরা ভাল করেই জানি, প্রযুক্তি নিয়ে রাশিয়ার এই আস্ফালন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবসা প্রসারে রাশিয়ার নানান ধরণের ছলা-কলায় ভুলানোর প্রবণতা নতুন কিছু না। ষাটের দশকে এই রূপপুরেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রিঅ্যাক্টরের চারপাশে নিরাপত্তা ব্যুহ (containment building) ছাড়াই ৪০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরীর পরিকল্পনা প্রস্তাব জমা দিয়েছিল রাশিয়া। নিরাপত্তা ব্যুহের অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তখনও দম্ভভরে বলেছিল, আমাদের রিঅ্যাক্টর ডিজাইনে কোন খুঁত নেই, তাই এর চারপাশে ব্যুহ তৈরীর প্রয়োজন নেই। অথচ এর কিছু কাল পরেই ১৯৮৬ সালে তাদের নিজেদের কেন্দ্রেই ঘটে চেরনোবিল দূর্ঘটনা যাতে নিরাপত্তা ব্যুহ না থাকার কারণে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে। (Matin, 2012)

যে চেরনোবিল দূর্ঘটনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে চেরনোবিল এইডস, চেরনোবিল পা, চেরনোবিল হৃদপিন্ড, চেরনোবিল থাইরয়েড, চেরনোবিল স্মৃতিবিভ্রাট নামের নানা রোগের জন্ম দিল সে দূর্ঘটনায় IAEA (আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা) এবং WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) কর্তৃক প্রণীত ‘দ্য চেরনোবিল ফোরাম’ রিপোর্টে মৃতের সংখ্যা দেখানো হয় মাত্র ৯ হাজার। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় একটি দূর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা এত ছোট!

আসলে রূপপুর ঘিরে যে কদর্য স্বার্থের খেলা শূরু হয়েছে লাখ কোটি টাকার বাটোয়ার হচ্ছে সেগুলো থেকে অনেক আগেই আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে দেয়া হয়েছে, শুধু মাত্র নিজের শান্তির কারনে লিখে রেখে যাই। অন্ততঃ সবাই জানুক।।

পুরো লেখাটি লিখতে বেশ কিছু অনলাইন লেখকের বিভিন্ন লেখার সহায়তা নেয়া হয়েছে। অন্ততঃ ২০ টি বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুক, নিউজ পেপার, গবেষনা পেপারের সহায়তা নিয়েছি। তাদের সবার প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা যারা দেশ কে ভালোবেসে এগুলো লিখেছ…

(লেখাটি কেপ্টেন নিমোর ওয়াল থেকে নেওয়া)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *