‘বাবা তুই যেমনে পারস, আমারে নিয়া যা’

ঢাকা : পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী সাহানা বেগম। বাড়ি কুমিল্লা। তিন মাস আগে পরিবারের ভাগ্য বদলানোর আশা নিয়ে গেছেন সৌদি আরব। যাওয়ার মাসখানেক পরেই বুঝতে পারেন কোন জাহান্নামে গিয়ে পড়েছেন। অসহ্য হয়ে গেলে ছেলেকে ফোন করে আর্তি জানিয়ে বলেন, ‘বাবা তুই যেমনে পারস, আমারে নিয়া যা’।

শুধু সাহানাই নন, স্বজনদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক মাসে সৌদিতে ১৬ জন বাংলাদেশি গৃহকর্মী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এই ১৬ নারী সম্প্রতি সৌদিতে গেছেন গৃহকর্মী হিসেবে, যাদের সবারই স্বজনরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এসব নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন জুনের ১৫ থেকে জুলাই ১৫ তারিখের মধ্যে। অভিযোগে বলা হয়েছে, এরা সবাই সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ শহর এলাকায় কর্মরত। তবে মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাস্তবে এরকম নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা আরো বেশি হবে।

মন্ত্রণালয়ে আসা এসব অভিযোগে বলা হয়েছে, নির্যাতিতারা গৃহশ্রমিক হিসেবে গত ৫ থেকে ৬ মাস আগে দেশ সৌদিতে গেছেন। যারা অতিরিক্ত কাজের পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী এ পর্যন্ত এক পয়সাও বেতন পাননি অথবা দেশে টাকা পাঠাতে পারেননি। আর স্বজনরা তাদের দেশে ফিরে আনার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছেন।

এরকম গৃহকর্তার দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া গোপাল নগর গ্রামের বাসিন্দা সাহানা বেগম (৪৫)। তার অসুস্থতার পরও জোর করে কাজ করিয়ে নিচ্ছে গৃহকর্তা। একই সঙ্গে চলছে শারীরিক নির্যাতন- এমন অভিযোগ করেছেন তার ছেলে মামুন মিয়া।

মামুন মিয়া জানান, ছয় মাস আগে সৌদিতে গেছেন তার মা। যাওয়ার পর গলায় টিউমার জাতীয় অসুখে ভুগছেন তিনি। এই কয় মাসে কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি দেশে।

মামুন মিয়া বলেন, অল্প খরচে মেয়েদের সৌদিতে যাওয়ার সুবিধার কারণে মা’কে আগে পাঠিয়ে দেই। এরপর তার টাকায় আমার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টাকার পরিবর্তে তার মুখে এখন কান্না শুনতেছি। গত পরশু (বুধবার) মালিকের বাসা থেকে পালিয়ে আমাদের কাছে ফোন দিয়ে বলে, ‘বাবা তুই যেমনে পারস, আমারে নিয়া যা।’

আসলে আমরা গরীব মানুষ। তাই নিয়ে আসার ব্যবস্থাও করতে পারছি না। এখন শুনছি নাকি গলায় টিউমার হইছে। তার সঙ্গে প্রতিদিন তারা নাকি শারীরিক অত্যাচারও করে। আমার মা হচ্ছে ভাই, আমি আর কি বলবো!- এই বলে কেঁদে ফেলেন মামুন।

নির্যাতনের কারণে সৌদির গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন গত তিন মাস আগে দেশটিতে ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া গাজীপুরের শিবপুর গ্রামের জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী আমিনা বেগমের (২৫)। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে শেষ রক্ষা পাননি গৃহকর্তার হাত থেকে। পালানোর কারণে একণ অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়েছে।

জাহিদুল ইসলাম এসব অভিযোগ করে বাংলামেইলকে বলেন, সে (আমিনা) নিজে কোনো দিন ফোন দিতে পারে না। আমরা তাকে নিজ খরচে এখান থেকে ফোন দিলে সে মালিকের নাম্বারের মাধ্যমে কথা বলে। কিন্তু ফোন ধরেই বলে- আমি কানে কিছুই শুনতে পাই না। আমাকে যদি পারো এখান থেকে নিয়ে যাও। তাই আমরা চেষ্টায় আছি কীভাবে তাকে নিয়ে আসা যায়।

তিনি এসব নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন গত ১৪ জুলাই। আমিনা বেগম দুই বছরের একটি মেয়ে রেখে গৃহকর্মীর কাজে সৌদিতে গেছেন।

গত ১৭ এপ্রিল সরকারিভাবেই গৃহকর্মী হিসেবে সৌদিতে গেছেন নীলফামারির কিশোরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম দলিরামপুরের সোমবারু মাসুদের স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৭)। যদিও দালালসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ খরচ পড়েছিল প্রায় ৪০ হাজার টাকা। প্রথম একমাস কিছু টাকা দিলেও আর টাকা পাঠাননি তিনি।

সোমবারু মাসুদ বাংলামেইল বলেন, প্রথম একমাস যোগাযোগ ছিল। আর ফোন দিলেই বলতো- ‘মালিক আমাকে জ্বালাতন করে। বাইরে বের হতে দেয় না। আটকে রাখে, যেভাবে পারেন আমাকে নিয়ে যান’। এর পরের মাস থেকে আর তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় না। গত প্রায় ১০ দিন থেকে কোনো যোগাযোগই হয়নি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের ৪ ও ৭ বছরের দুইটা ছেলে মেয়ে আছে। আমি গরিব মানুষ, ভ্যান চালিয়ে খাই। এখন এক দালাল বলে আরো ১০ হাজার টাকা লাগবে ফেরত আনতে। তাই মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছি। দেখি কী হয়। ভাই, নিজের বউকে বিদেশে পাঠিয়ে আমি যে ভুল করেছি, সেই ভুল আর যেন কেউ না করে!

এই তিনজন ছাড়াও গত এক মাসে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদে কাজ করা গৃহকর্মীর নির্যাতন নিয়ে অভিযোগ এসেছে ১৬টির মতো। এর মধ্যে জেদ্দা শহরে চট্টগ্রামের গোলাম মোহাম্মদের স্ত্রী মমতাজ বেগম, হবিগঞ্জের আব্দুল জলিলের মেয়ে শেপালী বেগম, টাঙ্গাইলের বিল্লাল হোসেনের স্ত্রী মোছাঃ বাসাতন, গাজীপুরের আব্দুল মালেকের মেয়ে আঁখি আক্তার ও দিনাজপুরের ফিরোজুলের স্ত্রী লাইলী নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন।

অপরদিকে রিয়াদ শহরে ফরিদপুরের আলী আকবরের স্ত্রী চায়না বেগম, গাজীপুরের মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী আমিনা খাতুন, ঢাকার আব্দুল হালিমের স্ত্রী ফলি আকতার, সাতক্ষীরার কাওসার আলীর স্ত্রী জোবেতা খাতুন, ময়মনসিংহের সেলিম মিয়ার স্ত্রী শামছুন্নাহার, ঢাকার আব্দুছ ছালামের স্ত্রী বিউটি বেগম, নওগাঁর মাসুদ রানার স্ত্রী ফরিদা বেগম ও নারায়নগঞ্জের শাহ আলম মৃধার মেয়ে ঝুমুর।

এসব নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) এর নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরী বাংলামেইলকে বলেন, আসলে এসব নারী নির্যাতনের কয়েকটি কারণ আছে। তার মধ্যে প্রবাসী নারী শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকা, নীতিমালা থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না করা, প্রাইভেট এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্য এবং দূতাবাসগুলোর দায়িত্ব অবহেলা।

তিনি আরো বলেন, সবগুলো কারণ একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমন: সরকারের যদি নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতো তাহলে সেখানে অবশ্যই গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু ক্যাটাগরি থাকতো। তাহলে প্রাইভেট এজেন্সিগুলোও নিজের ইচ্ছামত পাঠাতে পারতো না। তারা বিদেশে এমন নারী শ্রমিক পাঠায় যারা নিজের নামও লিখতে পারে না। তাহলে তো একটা ভিন্ন দেশে গিয়ে ভিন্ন ভাষা ও কালচারের সঙ্গে সমস্যা হবেই।

আবার দেশটিতে থাকা বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তারা হয়তবা তাদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেন না। কেননা সেখানে যারা যায়, তাদের লিস্ট অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে থাকে। সেই ডাটা লিস্ট অনুযায়ী তারা যদি মাঝে মধ্যেও খোঁজখবর রাখেন, তাহলে তো এই ধরণের নির্যাতন অনেকাংশেই কমে যাবে বলে যোগ করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, গৃহকর্মী হিসেবে যারা সৌদিতে গেছেন পরবর্তীতে তাদের কিছু অংশকে নির্যাতনের অভিযোগ করছেন দেশে থাকা স্বজনরা। মন্ত্রণালয়সহ সেদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। তবে গৃহকর্মে অন্তরীণ পরিবেশ থাকার কারণে নির্যাতনের অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয় না। সেখানে গিয়েও আইনি জটিলতায় পড়তে হয়। তাই এসব অভিযোগ সমাধানে সময় বেশি লাগে।

তিনি আরো জানান, বাস্তবে এসব নির্যাতনের স্বীকার নারীদের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কেননা অনেক নিরূপায় নারী শ্রমিক সব অন্যায় আচরণ সহ্য করে সেখানে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেক স্বজন ব্যক্তিগতভাবে সমাধান করছেন।

স্বজনদের অভিযোগের ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার বলেন, নারী গৃহকর্মীকে পাঠানোর পূর্বে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের এ হার আগের চেয়ে বেড়েছে। হিউম্যান রাইটসের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সেখানে পাঠানো হয়। তবে কিছু কিছু প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বেশি আসে। তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেয়।

প্রসঙ্গত, নির্যাতিতদের আত্মীয়স্বজনের দেয়া এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর তিন মাসে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশ তথা সৌদি আরব, ওমান, দুবাই মিলে ১৯০ জন নারী শ্রমিক নির্যাতিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.