জেনে নিন কিডনিতে পাথর ও চিকিৎসা সমাধান

কিডনিতে পাথর হওয়া কোনো বিরল ঘটনা নয়। বাংলাদেশে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা শতকরা ৩ ভাগ। কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে পাথর পরীক্ষা করে এর কম্পোজিশন সম্পর্কে ধারণা করা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাথর ক্যালসিয়াম ফসফেট ও অক্সালেট দ্বারা তৈরি। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে সিসটিন দ্বারাও পাথর গঠিত হয়। কেন এবং কীভাবে রক্তের ক্যালসিয়াম ফসফেট ও ইউরিক এসিড জমাট বেঁধে কিডনিতে পাথর তৈরি করে তা প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই অজানা। আমরা অবশ্য যদি ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে কেন পাথর হয় তা জানতাম তা হলে পাথর চিকিৎসার জন্য আর শল্য চিকিৎসার দরকার হতো না, ওষুধ দিয়েই নিরাময় করা যেত। পাথরের রোগীদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের রক্তে যে ক্যালসিয়াম রয়েছে তা প্রস্রাব দ্বারা বেশি পরিমাণে নির্গত হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনাই হচ্ছে, এসব রোগীর প্রস্রাব দিয়ে বেশি ক্যালসিয়াম নির্গত হয়। আমরা জানি, বেশি পরিমাণে খাবারে ক্যালসিয়াম খেলে অথবা বেশি পরিমাণ আমিষ খাবার খেলে বা অত্যধিক লবণ খেলে প্রস্রাবে অত্যধিক ক্যালসিয়াম নির্গত হয়। কিন্তু তাই বলে যারা খাবারের ক্যালসিয়াম বেশি খায় বা আমিষ বেশি খায় তাদের সবার তো কিডনিতে পাথর হয় না। কিডনিতে পাথর হওয়া রোগীদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের হাড়ে ক্যালসিয়াম ও আমিষের ঘনত্ব কম থাকে। শরীরের রোগ প্রতিরোধের যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন; যা দ্বারা শরীর বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করে, সেই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দুতে হয়তোবা কোনো অসুবিধার দরুন এ ধরনের পাথর হওয়ার আশঙ্কাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।

রোগের উপসর্গঃ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগী কোমরের ওপরে মেরুদণ্ডের যে কোনো এক পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যথা নিচের দিকে নেমে কুঁচকির দিকে যেতে পারে। পাথরের ব্যথা সাধারণত তীব্র হয়। সঙ্গে বমিও হতে পারে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যথার সঙ্গে প্রস্রাবে রক্তও যেতে পারে। বড় পাথরের তুলনায় ছোট পাথরে বেশি ব্যথা হয়। শতকরা ১০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা প্রস্রাব দিয়ে পাথর বেরিয়ে যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রস্রাবে প্রদাহ, জ্বর, উচ্চরক্তচাপ এমনকি কিডনি ফেইলিউর নিয়েও আসতে পারে। এটা জেনে রাখা ভালো যে, একমাত্র পাথরজনিত কিডনি রোগের শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

রোগ নির্ণয়ঃ
শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণত পেটের এক্স-রে করে পাথর হয়েছে কি না বোঝা যায়। সাধারণত এক্স-রের সঙ্গে আলট্রাসনোগ্রাম বা আইভিইউ করলে শতকরা ১০০ ভাগ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া যায়। পাথর ধরার পর প্রস্রাব পরীক্ষা করে তাতে লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা, যাচ্ছে কি না দেখা হয়ে থাকে। শ্বেতকণিকা বেশি গেলে প্রস্রাব কালচার করিয়ে নিতে হয়। কী কারণে পাথর হয়েছে তা জানার জন্য রক্তের ক্যালসিয়াম ফসফেট এবং ইউরিক এসিড এবং ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবের কী পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ইউরিক এসিড বেরিয়ে যাচ্ছে তা নির্ণয় করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অক্সালেট ও সিসটিনের পরিমাণও দেখা হয়। পাথর দ্বারা কিডনির কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না তা জানার জন্য রক্তের ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন করার প্রয়োজন হতে পারে। শতকরা ৪ থেকে ৫ ভাগ ক্ষেত্রে প্যারা থাইরয়েড গ্রন্থি ও ভিটামিন ডি-এর আধিক্যে সারকয়েডসিস নামক রোগ অথবা অস্থির অসুখের কারণে পাথর হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ওই রোগের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে করতে হয়।

চিকিৎসাঃ
বিংশ শতাব্দীতে কিডনিতে পাথরের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। পাথর হওয়া মানেই শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে পাথর বের করা নয় বরং পাথর ভবিষ্যতে না হয় তার জন্য বেশি মনোযোগী হতে হয়, শতকরা প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে একবার পাথর হলে তা বারবার হতে পারে। পাথরকে শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে বের করতে হবে, নাকি লিথোট্রিপসি মেশিনে গুঁড়া করে দেয়া হবে তা নির্ভর করে কিডনির কোথায় তা আটকা পড়েছে এবং এর সঙ্গে পাথরের আকৃতি ও সংখ্যার ওপর নির্ভর করে। পাথর যদি ১-১.৫ সেন্টিমিটারের মতো ছোট হয়, তবে তা প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসার আশঙ্কা অনেক বেশি, এর জন্য শুধু বেশি পরিমাণে পানি খেলেই চলে। অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত হাঁটাহাঁটি বা দৌড়াদৌড়িতেও কাজ হয়। বেশি পানি খাওয়া বলতে ৩ থেকে ৪ লিটার পানি খাওয়া বোঝায়। আর যদি পাথর ১.৫ সেন্টিমিটারের বেশি বড় হয় বা কিডনির শাখা-প্রশাখাতে আটকিয়ে যায় অথবা ইউরেটার বা নলের দিকে নেমে আসে এবং বোঝা যায় তা কিডনির ওপর চাপ দিচ্ছে তাহলে তা লিথোট্রিপসি মেশিনের সাহায্যে গুঁড়া করাই শ্রেয়। আর যদি পাথরের আকৃতি ২.৫ সেন্টিমিটারের ওপর চলে যায় তখন শল্য চিকিৎসার চিন্তা করা হয়। উন্নত বিশ্বে পেট না কেটে এনডোস্কোপির সাহায্যে বড় ধরনের পাথর বের করে নিয়ে আসা হয়। পাথর যদি একের অধিক হয়ে থাকে এবং তা কিডনির গভীরে থাকে বা কিডনিতে কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি না করে সেসব ক্ষেত্রে কী ধরনের চিকিৎসা রোগীর জন্য উপকারী হবে তা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই বলবেন। তবে পাথর বের করে নিয়ে আসার পর ভবিষ্যতে যাতে আবার পাথর তৈরি না হয় তার দিকে সব রোগীকেই নজর দিতে হবে। বিভিন্ন ধরনের ওষুধের মাধ্যমে পাথর যাতে আবার না হয় তার চিকিৎসা করা যায়। এসব ওষুধ ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত খেতে হয়। পাথর হওয়ার প্রবণতা যাদের রয়েছে তাদের খাবারের প্রতিও বিশেষ নজর রাখা হয়। কী কারণে পাথর হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে খাবারের ক্যালসিয়াম, ইউরিক এসিড, সিসটিন, অক্সালেট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যাদের বেশি পানি খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পাথরের রোগ হওয়ার আশঙ্কা হয়তোবা কিছু কম হতে পারে।
(সংকলিত)
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.