কেঁচো খুঁড়তে সাপ, কোথায় সেই মুসা

এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছে চারজনকে। সন্দেহভাজন দুই খুনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ঘটনায় ব্যবহার করা অস্ত্রও। গ্রেফতার হয়েছে সেই অস্ত্রের জোগানদাতাকে। মামলার দৃশ্যমান অনেক অগ্রগতির কথা বলেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। কোথায় কীভাবে খুন করা হয়েছে তা উঠে এসেছে আটকদের স্বীকারোক্তিতে। ঢাকার সদর দফতর থেকে সরাসরি তদন্ত প্রক্রিয়া তদারকি করা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এসপি বাবুল আক্তারকেও। কিন্তু কী কারণে ও কার নির্দেশে মিতুকে হত্যা করা হলো এবং নির্দেশদাতার নাম কি?— এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কেউ। মুখে কলুপ এঁটেছেন ঢাকার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারাও। সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেছেন, ‘খুনের কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত দল কাজ করছে। তদন্ত শেষ না করার আগে পরিপূর্ণভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া যাচ্ছে না— কে? কেন মিতুকে খুন করেছে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে একটু সময় লাগবে।’ মিতু হত্যার কারণ নিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামানকে প্রশ্ন করা হলে তিনিও বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ এখনো জানতে পারিনি। তদন্ত চলছে। আরও আসামি গ্রেফতার করা হবে। সব আসামিকে গ্রেফতার করার পর বলতে পারব আসলে কী কারণে মিতুকে হত্যা করা হয়েছে।’ তবে এক পুলিশ কর্মকর্তার দাবি— এ ঘটনার মূল কারণ জানতে পেরেছে পুলিশ। ঘটনার মূল কারণ উপস্থাপন করা হলে বের হয়ে যাবে নির্দেশদাতার নামও! নির্দেশদাতার নাম প্রকাশিত হলে ব্রিবতকর পরিস্থিতিতে পড়বে একটি বাহিনী। প্রশ্নবিদ্ধ হবে বিগত সময়ের ওই বাহিনীর কিছু সাফল্য। এমনকি পুরো বাহিনীই পড়বে তখন আরও ইমেজ সংকটে। সিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, বাবুল আক্তারের পেশাগত কারণে মিতুকে হত্যা করা হয়নি তা বিভিন্ন সূত্র ও গ্রেফতার করা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ড নিয়ে আসামিরা যে তথ্য পুলিশকে দিয়েছে তা ‘গা শিউরে’ ওঠার মতো। আনোয়ার ও ওয়াসিম পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য দিয়েছে তার ‘সিকিভাগ’ও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেনি। তাদের দেওয়া জবানবন্দিতে গুলি কে করেছে তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও রয়েছে। এ ছাড়া গ্রেফতার হওয়া হানিফুল হক ওরফে ভোলা এবং ‘পলাতক’ আবু মুসা সিকদার এসপি বাবুল আক্তারের ‘ঘনিষ্ঠ সোর্স’ হিসেবে পরিচিত। তাদের সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ‘ঘনিষ্ঠ সোর্স’রাই কেন মিতুকে হত্যার নির্দেশ এবং হত্যার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করেছে এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। সূত্র জানায়, মুসা ও ভোলা দীর্ঘদিন ধরে বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে ভোলার সঙ্গে বাবুল আক্তারের সখ্য গড়ে ওঠে সিএমপির কোতোয়ালি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার থাকাকালীন। হাটহাজারী সার্কেলে দায়িত্ব পালনকালে সম্পর্ক গড়ে ওঠে মুসার সঙ্গে। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিনহার্ট অভিযান চলাকালে অস্ত্রসহ ধরা পড়েও ছাড়া পায় মুসা। পরে র‌্যাব ও পুলিশের নিয়মিত সোর্স হিসেবে কাজ করে দুজন। পরবর্তীতে অপরাধ চক্রের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বাকলিয়ায় এসে ভোলার সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদার হয় মুসা।

আরও দুজন গ্রেফতার : মিতু হত্যার অস্ত্র সরবরাহকারী হানিফুল হক ওরফে ভোলা ও মনির হোসেন ওরফে মনিরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার রাতে বাকলিয়া থানাধীন রাজাখালী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় মিতু হত্যায় ব্যবহূত একটি পয়েন্ট থার্টি টু বোর রিভলবার, সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোর পিস্তল উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া ভোলা নগরীর অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ ১৬ মামলা রয়েছে। পরে গ্রেফতারকৃত দুই আসামিকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গতকাল বিচারক নওরীন আক্তার কাকন এ নির্দেশ দেন। গ্রেফতার হওয়া দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চাইবে ডিবি পুলিশ।

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘মিতু কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে ভোলা তাদের খুনের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে উল্লেখ করেছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভোলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে ভোলার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মনিরের বাসা থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়।’ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘গ্রেফতার করা ভোলা ও মনিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হবে। রিমান্ডে এনে এ বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ পুলিশকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ভোলা জানায়, মিতু খুনের অস্ত্র সরবরাহ করলেও খুনের সময় সে ঘটনাস্থলে ছিল না। কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীদের সে অস্ত্রগুলো ভাড়ায় দিয়েছিল। খুনের পর অস্ত্রগুলো ফেরত নেয় সে। পরে অস্ত্রগুলো মনিরের কাছে গচ্ছিত রাখে।

প্রসঙ্গত, ৫ জুন নগরীর জিইসির মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনার পর বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

কোথায় সেই মুসা : গোয়েন্দা কার্যালয়ে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার সন্ধেহভাজন আসামিদের। হত্যার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দেন তারা। বর্ণনা শেষে চোখের বাঁধন খুলতেই তারা দেখেন সামনেই বসে আছেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার। চোখ যেন ছানাবড়া হয়ে ওঠে আসামিদের। কেননা, দীর্ঘ বর্ণনার ধারাবাহিকতায় আসামি আবু মুসা সিকদার ওরফে মুসার সঙ্গে বাবুলের ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা স্বীকারোক্তি দেন। মুসা প্রায়শ যেতেন বাবুলের বাসায়ও। জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে হত্যা পরিকল্পনার পূর্বাপর অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্র আরও জানায়, গেল শুক্রবার রাতে উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ডিবি কার্যালয়ে বাবুল আক্তারের মুখোমুখি বসিয়েই একাধিক আসামিকে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বাবুলকে যে সামনে রেখেই এই জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছিল, তা ওই আসামিরা জানতেন না। তারা মিতু হত্যার ব্যাপারে নির্দেশদাতা, অস্ত্র সরবরাহকারী ও পরিকল্পনার ছক প্রণয়ন এবং ঘটনার বর্ণনা দেন। পুলিশের সূত্র আরও জানায়, আসামিদের বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনার বিষয়ে এবং আসামিদের মধ্যে ওই খুনের ব্যাপারে পুলিশের কথিত সোর্স মুসার নির্দেশনা এবং মুসার সঙ্গে বাবুলের পূর্ববর্তী পরিচয় বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাবুল ও আসামিদের। জিজ্ঞাসাবাদকালে শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষ থেকে ওই সময় দুই পক্ষকেই জানানো হয়, ঘটনার আদ্যোপান্ত সব তথ্যপ্রমাণ পুলিশের হাতে রয়েছে। এমনটি জানিয়ে উপর্যুপরি প্রশ্নের মুখে আসামিরা প্রকাশ করে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য, যা মামলার পরবর্তী তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বার্থেই গোপন রাখা হচ্ছে বলে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাবি করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, মুসাও এর আগে আটক হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে আলোচিত হলেও সেই মুসা এখন কোথায়? খুনিদের জবানবন্দিতে নাম উঠে আসা মুসা তবে কি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে? এক প্রশ্নের জবাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘মুসাকে গ্রেফতারের জন্য আমরা রাত-দিন প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করছি তাকে গ্রেফতার করতে পারব।’

যেভাবে বেরিয়ে আসে হত্যার আদ্যোপান্ত : সিএমপিতে থাকাবস্থায় পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার খুবই শ্রদ্ধাভরে নির্দেশনা মানতেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) বনজ কুমার মজুমদারের। তিনি এখন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান। মিতু হত্যার পর শোকাহত পুলিশ প্রশাসনে স্বাভাবিক দায়িত্বের পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধনের কারণেও পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বিশেষ তদন্ত দল নিয়ে চট্টগ্রামে এসেই বের করে আনেন এই হত্যার গূঢ় রহস্য, যদিও দায়িত্বশীল পুলিশ কর্তারা এই তদন্তের ব্যাপারে যেন একেবারেই মুখ খুলছেন না। সূত্রগুলো জানায়, তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়েই ঘটনাস্থল চট্টগ্রামের জিইসি সার্কেল এলাকায় হত্যাকাণ্ডের আগে সক্রিয় মুঠোফোনগুলো সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ করে। একই সঙ্গে সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের কথিত ‘সোর্স’ মুসাসহ অন্যদের চিহ্নিত করে। খোঁজ নেওয়া হয় হত্যার পরে খুনিদের ব্যবহূত মোটরসাইকেলটির। প্রকৃত মালিক থেকে মোটরসাইকেলটি একবার চুরিও হয়ে যায়। ক্রমে এটির মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ, চোরকে গ্রেফতার এবং চোরের কাছ থেকে মোটরসাইকেলটির ক্রেতা চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর এক ইউপি মেম্বারকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে ওই মেম্বার জানান, কথিত ‘পুলিশ সোর্স’ মুসা চোরাই মোটরসাইকেলটি হত্যাকাণ্ডের আগে নিয়ে গিয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.