বয়স আর সম্পর্কের ব্যবধানে একাকীত্ব খেলা করে ।

বয়স বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কগুলোর মধ্য ব্যবধান সৃষ্টি হয় । আমার ছেলেরা যখন ছোট ছিল তখন আমার বুকের মধ্য ঘুমাতো । বড় হবার সাথে সাথে  প্রতি বছর তাদের সাথে আমার ব্যবধান সৃষ্টি হতে হতে এখন তারা আমার থেকে অনেক দূরে। অথচ দেখলে মনে হয় এই তো পাশের ঘরেই আছে বা এই তো একই শহরে আছে। আর ভাবলে মনে হয় ওরা আমার থেকে যোজন যোজন দূরে। ছেলেরা যখন বাইরের জগতে পা রাখলো তখন তাদের জগত সম্প্রসারিত হলো আর আমার সাথে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকলো। আমি একজন কর্মজীবি মা। সারাদিন বাচ্চারা আমাকে দ্যাখেনি। শুধু ছুটির দিন আর রাতে ঘুমাবার আগে আমার সাথে তাদের দেখা হতো। একজন একাকী মায়ের এছাড়া আর কিছু করার উপায় থাকেনা। এখন দেখা যাক আমি যদি সারাক্ষণ ঘরে থাকতাম তাহলে কি আমার সাথে আমার ছেলেদের দূরত্ব বৃদ্ধি হতোনা? হতো। যেসব মায়েরা ঘরে থাকেন তাদের সন্তানদের সাথেও তাদের সম্পর্ক থাকে অনেকটা দায়সারা গোছের। মা সারাদিন রান্না করবে, কাপড় ধূবে, ভাত নিয়ে অপেক্ষা করবে এটাই সন্তানেরা প্রত্যাশা করে। মায়ের জীবনে এছাড়া আর কিছু থাকতে নেই। সেদিন আমার এক বন্ধুর মেয়ে আমাকে বলেছিল – আন্টি আপনি এত ঢং করেন কেনো? এত বয়স হয়ে গেছে আপনার । এই বয়সে আপনি ব্যায়াম করেন, ফ্যাশন করেন, এইগুলা করে কি লাভ?

শুনে আমার খারাপ লাগলেও আমি বুঝতে পেরেছি কেন সে এই কথা বলেছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা মাকে মোটা, বুড়া, অসুস্থ, সারাদিন অভিযোগ করবে, তাদের ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করবে, তাদের জন্য রান্না করবে, তারপর নানা রকমের অসুখ বিসুখে কাতরাবে তখন ছেলেমেয়েরা যার যেমন সুযোগ সুবিধা অনুযায়ি মাকে দেখতে আসবে অথবা দেখতে আসবেনা একদিন মা মরে যাবে। এটাই প্রত্যাশিত।

মোটা, অসুস্থ, বিষন্ন, পরিশ্রমি,  চোখের চারিপাশে গভীর কালো দাগের মাঝ খানে চোখ গর্তে বসা, দিনরাত অভিযোগ, পেট ব্যাথা, পিঠ ব্যাথা, মাজা ব্যাথা, অমুক অপারেশন তমূক বড়ি ইত্যাদি নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে মা। না হলে আর খেলা জমবে কেনো ? ছেলেবেলায় সন্তানেরা মায়ের উপরে নির্ভর করে খাবারের জন্য, টাকার জন্য, আদোরের জন্য, বড় হয়ে তারা মাকে তাদের উপরে নির্ভরশীল দেখতে চায়। তাঁরা চায় মা তাদের যেমন করে লালন পালন করে বড় করেছে ঠিক তেমনিভাবে তাদের জন্য আরো পরিশ্রম করবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বিনিময়ে সন্তানেরা মা দিবসে মায়ের সাথে তাদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করবে আর বাসাতে সবার পেছনে ধমক ধামক দেবে বা নানাভাবে মাকে বুঝিয়ে দেবে যে মা তাদের উপরে বোঝার মত।

মায়ের জন্য গার্লফেন্ড বাসাতে আনতে পারছেনা। গার্লফেন্ড যদি আসেও, বিয়া যদি হয়ও তাহলে মাকে তখন বউ ছেলে বা জামাই মেয়ে সবার জন্য রান্না করতে হবে। আগে ছোট পাতিল চুলাতে উঠাতে কোমরে তেমন ব্যাথা হতোনা এখন মেয়ে জামাই বা ছেলে ছেলের বউয়ের জন্য বেশী রান্না করতে যেয়ে বড় পাতিল চুলাতে উঠানামা করতে করতে মাজা ব্যাথা থেকে ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হবে। সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধ এভাবেই নিজের পেটে সন্তান নেওয়া থেকে নিজেকে কবরে শোয়ানো পর্যন্ত বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। মা যখন ছোট ছিলেন তখন বাবার উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। মায়ের বিয়ে হয়ে যায় কৈশরে তখন স্বামীর উপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠেন তারপর সন্তানের জন্ম দিয়ে সন্তান লালন পালনে ব্যস্ত হয়ে যান তারপর সন্তানেরা বড় হলে তখন সন্তানদের সন্তান লালন পালন করতে না পারলে নিজেকে বোঝা হিসাবে সবার কাছ থেকে নানা ধরণের ভ্রুকুটি সহ্য করেন। এই মায়ের সন্তানেরা যখন তাদের মা সম্পর্কে বাইরে কথা বলে তখন তো পুরাই মাকে ভালবাসা বিষয়ক উপন্যাস লিখে শুনিয়ে দেন। শুধু মা জানেন যে তিনি একজন শ্রমিক হিসাবে জীবন যাপন করে। অনেকেই যার যার জাগাতে শ্রমিক । শ্রমিক অত্যন্ত সন্মানজনক পেশা। তবে শ্রমের সাথে যদি মা মা নাটকের ভুয়া ভালবাসা যোগ করা হয় তখনই সেটা হিপোক্রেটিক্যাল হয়ে যায়।

বয়সের সাথে সম্পর্কগুলো এইভাবে এক বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি করে যা দেখা যায়না শুধু অনুভব করা যায়।  আমার অনেক বয়স হয়েছে আর সেই প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু আমাকে একটা গল্প বলছিল। বন্ধুর এক বন্ধুর মা তার ছেলেদের বলে — তোর আব্বা আসছেন ইফতার করবে অথচ তোরা এখনো কোন ইফতার তৈরি করিসনি। সরবত বানানো হয় নাই। তোর আব্বা ফিরে এসে কি খাবেন? বন্ধুটি জানায় তার আব্বা মারা গেছে অনেক দিন আগে। কিন্তু তার মা আব্বাকে স্বপ্নে দ্যাখে এমনভাবে যেন আব্বা এখনো বেঁচে আছেন।

মায়ের এই স্বপ্ন দেখার কারণ হলো মা তার স্বামীকে হারিয়ে একাকিত্ব বোধ করেন। সন্তানেরা যার যার কাজে ব্যস্ত থাকে। স্বামী স্ত্রী একজন অন্যজনকে সঙ্গ দেন। যখন স্বামী মরে যায় তখন স্ত্রী সন্তানদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আর যখন সন্তানেরা ব্যস্ত হয়ে যায় তখন মা স্বপ্ন দ্যাখেন স্বামীকে । স্বামী বেচে আছেন । ইফতার করার জন্য ঘরে ফিরছেন।

বৃদ্ধারাই কি শুধু একাকী থাকেন? তরুন বা যুবকেরা কি একাকীত্ববোধ করেনা? যখন যুবকেরা একাকীত্ববোধ করে যখন তাদের প্রেমিকারা অন্য প্রেমিক ধরে তাদের ছেড়ে চলে যায় তখন সেইসব যুবকেরা ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কূলা বয়স্ক মহিলাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফিলার হিসাবে। নাটকের বিরতিতে বিজ্ঞাপণের মত। একজন একাকী বৃদ্ধা মহিলা যে সংগী-করুনা ভিক্ষা করে তাকে সা্ময়িকের জন্য সঙ্গ দিয়া সঙ্গ করুনা ভিক্ষা দেয় একাকী যুবক আর একজন প্রেমিকা না জোটা পর্যন্ত । আর একজন প্রেমিকা জুটে গেলেই বৃদ্ধাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদায় করে দেন। বয়স আর সম্পর্কের ব্যবধানে এভাবেই একাকীত্বের খেলা চলে ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *