সাতক্ষীরা: আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে এখন বাড়ি ছাড়া সাতক্ষীরার আশাশুনির চার গ্রামের প্রায় ১শ’ হিন্দু পরিবার। জীবনের ভয়ে পুরুষেরা বাড়ি থাকতে পারছেন না। আবার বাড়িতে থাকতে ভয় পাচ্ছেন ষোড়শী ও গৃহবধূরাও।
রাতে হঠাৎ তাদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে মেয়েদের ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
‘আমরা এখন কি করব? ছেলেদের হত্যার হুমকি, আর মেয়েদের ধর্ষণের। এখানে থাকলে ছেলেরা হত্যা হবে, আর মেয়েরা হারাবে ইজ্জত। কি অপরাধ আমাদের? আমাদের অপরাধ একটাই। আমরা নৌকায় ভোট দিয়েছি।’ কথাগুলো বলেন আশাশুনি উপজেলার ঠাকুরাবাদ গ্রামের বৃদ্ধা হাজারী দাসী (৭০)।
তিনি আরো বলেন, জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনাকে আমরা মা মনে করি। সারাবাংলার মা আমাদের শেখ হাসিনা। সেই মা ক্ষমতায় থাকতে তার মনোনীত প্রতীকে ভোট দিয়ে এখন দিশেহারা আমরা।
সূত্র মোতাবেক, বৃহস্পতিবার দুপুরে আশাশুনি থানার ঠাকুরাবাদ গ্রামে গেলে সাংবাদিকদের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন হাজারী দাসীসহ একই এলাকার মাধবী সরকার, প্রমীলা সরকার (৫৫) ও সুজিতা সরকার প্রমুখ।
সাংবাদিকদের দেখে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন তারা। তারা বলেন, ‘বাবা আপনারা আমাদের নির্যাতনের কথাগুলো আমাদের মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। তিনি যদি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেন, চলে যাব। আমরা আর এ নির্যাতন সইতে পারছি না।’
‘আমরা আশাশুনি উপজেলা চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিম বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে আছি। আমাদের রক্ষা করুন। তা না হলে আমাদের ভারতে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।’ এ ধরনের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন গান্ধারী (৬৫) নামে এক বৃদ্ধা।
এ সময় ভুক্তভোগীদের আর্তনাদে সংবাদকর্মীরা হতবাক হয়ে যান। ভুক্তভোগীরা জানান, বিগত ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম পিন্টু। অপরদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাকিমের প্রার্থী হিসেবে চশমা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন স. ম. সেলিম রেজা মিলন। নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীককে হারাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। লিপ্ত হন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে।
এদিকে আশাশুনির বলাবাড়িয়া, গাইয়াখালী, হাঁসখালী ও ঠাকুরাবাদ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় আশাশুনি উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাকিম মনোনীত প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে এক চেটিয়া নৌকা প্রতীকে ভোট প্রদান করেন বলে এলাকাবাসী জানান। কিন্তু বিধিবাম! নৌকা প্রতীক বিজয়ী হতে পারেননি। ভোটের পরদিন উপজেলা চেয়ারম্যানের লোকজন ওই এলাকার হিন্দু পরিবারগুলোর উপর বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি প্রদান করতে থাকে।
এদিকে গত বুধবার রাতে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মঙ্গল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে অর্জুন সানার ছেলে সমরেশ সানা, জনার্দন সানার ছেলে রবীন্দ্র সানাসহ ২০/২৫ ইউনিয়নের ঠাকুরাবাদ, গায়াখালী, বলাবাড়িয়া, হাঁসখালী গ্রামে রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ঠাকুরাবাদ এলাকার বাসিন্দারা। এসব গ্রামের মানুষগুলো প্রায় বাড়িছাড়া।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঠাকুরাবাদ গ্রামের কয়েকশ পুরুষ-মহিলা মানববন্ধন করে এঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অপরদিকে একই অভিযোগ পাওয়া গেছে বলাবাড়িয়া গ্রামে। ঠাকুরাবাদের মানববন্ধন শেষে বলাবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে জানা যায়, জীবনের ভয়ে ইতোমধ্যে ডা. সুশীল চন্দ্র মণ্ডল ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। বলাবাড়িয়া গ্রামের ঊষা রাণী (৬০), ঋতিশ (৫৫), বল্লব চন্দ্র সরকার (৮০) জানান, রাতে মঙ্গলবাহিনীর রামদা মহড়ায় সবাই শঙ্কিত।
এর আগে দুপুর বারটার দিকে আশাশুনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হামলার শিকার গাইয়াখালি গ্রামের গৌরপদ মণ্ডল (৪০) এর সাথে কথা হয়।তিনি জানান, নৌকায় ভোট দিয়ে আমি অপরাধ করেছি। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে আমাকে বেধড়ক পিটিয়ে পরে গলা টিপে হত্যা করতে গিয়েছিল। আমি হাসপাতালে আসলেও হামলাকারীদের ভয়ে স্বজনরা আমাকে দেখতে আসতে পারছে না।
এব্যাপারে আশাশুনি থানার অফিসার ইনচার্জ-এর কক্ষে গিয়ে বলাবাড়িয়াসহ ৪টি গ্রামের সংখ্যালঘুদের উপর সন্ত্রাসী হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান অভিযোগ সত্য নয়। দু’জন মেম্বর প্রার্থীর মধ্যে উত্তেজনা ছিল এখন তাও নেই।
এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. শহিদুল ইসলাম পিন্টু স্বাক্ষরিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ.বি.এম মোস্তাকিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে- বলাবাড়িয়া, ঠাকুরাবাদ, হাসখালি ও গাইয়াখালি গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাস চলছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ.বি.এম মোস্তাকিমের নির্দেশে। তার অনুগত ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মঙ্গল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে সন্ত্রাসে জড়িত আছেন বলাবাড়িয়া গ্রামের সমরেশ সানা, রবীন্দ্র নাথ সানা, কার্তিক সরদার, মনিরুল, আছাদুল, সুকৃতি সানা, প্রিয়ব্রত সানা, বিশ্বজিত সানা, সঞ্জয় মণ্ডল, তারক চন্দ্র মণ্ডল, সঞ্জিত সানা, স্বপন সানা, নিমাই মণ্ডল। হাঁসখালি গ্রামের রমেশ বৈরাগী, ঠাকুর বৈরাগী, দৈব্য মণ্ডল, সমীরন বাইন, আনন্দ বাইন, নির্মল বাইন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম পিন্টু নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মোস্তাকিমের সাথে যোগাযোগ করার জন্য নম্বারে বারবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ না করায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।