রোজা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি মনোদৈহিক ইবাদত। রমজানের রোজা ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। রোজার বিধান নারী ও পুরুষ সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। হাদিস শরিফে আছে: কোনো নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমতো আদায় করেন, রমজান মাসে পূর্ণরূপে রোজা পালন করেন, নিজের সম্ভ্রম ও ইজ্জত আবরু রক্ষা করে চলেন এবং স্বামীর অনুগত থাকেন; তিনি জান্নাতের আটটি দরজার যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা হবে চাইলেই প্রবেশ করতে পারবেন। (সুনানে তিরমিজি)।
ঋতুমতী, গর্ভবতী এবং প্রসূতিদের রোজা ও নামাজ
রমজানে রজঃস্রাবের কারণে নারীরা তিন থেকে দশ দিন রোজা রাখতে পারেন না এবং নামাজও আদায় করতে পারেন না। অনুরূপভাবে নিফাস অবস্থায় অর্থাৎ সন্তান প্রসবোত্তর স্রাব চলাকালীন (সর্বোচ্চ ৪০ দিন) নামাজ ও রোজা পালন করতে পারেন না। এ সময়ের রোজাগুলো পরে আদায় করে নিতে হয়; কিন্তু এ সময়ের নামাজ আর আদায় করতে হয় না।
যেহেতু নিফাস বা প্রসবোত্তর স্রাবের সর্বনিম্ন কোনো সময় নেই; তাই স্রাব (রক্তক্ষরণ) বন্ধ হলেই নামাজ ও রোজা পালন শুরু করতে হবে (৪০ দিনের অপেক্ষায় থাকা যাবে না)।
অনেক নারী রোজা পালনের সুবিধার্থে ওষুধ খেয়ে রজঃস্রাব বন্ধ রাখেন। এতে যদি (বিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতে) শারীরিক কোনো বড় ধরনের অসুবিধা না হয়; তাহলে কোনো অসুবিধা নেই।
রোজা অবস্থায় রজঃস্রাব হলে ওই দিনের রোজা হবে না; কিন্তু রমজানের সম্মানে সেদিন ইফতার পর্যন্ত তার পানাহার থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। পরদিন থেকে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত রোজা রাখতে হবে না।
যাঁরা যেকোনো কারণে রোজা রাখতে পারেন না, তাঁরা রমজান মাসের রোজার সম্মানে ও রোজাদারদের সম্মানার্থে প্রকাশ্যে পানাহার থেকে বিরত থাকবেন।
কোনো নারী যদি রমজানের কোনো রাতে সাহরির সময় শেষ হওয়ার আগে স্রাব থেকে মুক্ত হন এবং যেকোনো কারণে গোসল করতে না পারেন; তাহলে সাহরি খেয়ে রোজা শুরু করবেন, পরে গোসল করে নামাজ আদায় করবেন।
বিশেষ সময়ের করণীয় আমল
নারীদের রজঃস্রাবের সময়ে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, কোরআন তিলাওয়াত ও স্পর্শ করা এবং মসজিদে প্রবেশ করা নিষেধ। কিন্তু তাঁরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বা নির্দিষ্ট ইবাদতের সময় হলে অজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে কিছু সময় বিভিন্ন দোয়া দরুদ, তাসবিহ তাহলিল ও জিকির আজকার করবেন; এতে তিনি সম্পাদিত আমলের ও সময় নির্ধারিত আমলের সওয়াব লাভ করবেন।
অনেকে মনে করেন অন্তঃসত্ত্বা নারী রোজা পালন করলে সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে পারে; তাই তাঁরা রোজা না রেখে তার ফিদইয়া দিতে চান; এটা মোটেই ঠিক নয়। যদি অবস্থা এমন হয় যে অভিজ্ঞ কোনো ডাক্তার, যিনি ধর্মীয় বিধানের গুরুত্ব ও রোজার সামগ্রিক দিক সম্বন্ধে যথাযথ ওয়াকিবহাল এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জানার পর তাঁকে রোজা পালনে নিষেধ করে থাকেন; তবে এই নারী সন্তান প্রসবের পর সুস্থতা লাভ করলে তখন এই রোজা কাজা আদায় করবেন। এ ক্ষেত্রে ফিদইয়া বা কাফফারা গ্রহণযোগ্য হবে না।
ফিদইয়া হলো শুধু তাঁদের জন্য, যাঁরা অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত অক্ষমতার কারণে রোজা রাখতে পারছেন না, যে অসুস্থতা থেকে আর সুস্থ হওয়ার কোনো আশা বা সম্ভাবনা নেই। আর শুধু শুধু অহেতুক আশঙ্কায় রমজানের ফরজ রোজা ছেড়ে দেওয়া জায়েজ হবে না।
ইস্তিহাযা বা নারীদের অসুস্থতা
কোনো নারীর যদি তিন দিনের কম বা দশ দিনের বেশি সময় মাসিক পিরিয়ড হয় অথবা নিয়মিত পিরিয়ড হওয়ার পর পুনরায় রক্তক্ষরণ দেখা দেয়, একে ইস্তিহাযা বলা হয়। ইস্তিহাযা চলাকালীন নামাজও পড়তে হবে এবং রোজাও রাখতে হবে।
অনুরূপভাবে সন্তান প্রসবের চল্লিশ দিন পরও যদি রক্তপাত বন্ধ না হয়, তাহলে অজু-গোসল করে যথারীতি নামাজ আদায় করতে হবে এবং রোজাও পালন করতে হবে। এ উভয় অবস্থায় নফল নামাজ, নফল রোজা ও অন্যান্য সকল ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মোস্তাহাব ও নফল ইবাদত করা যাবে। তাওয়াফ, জিয়ারত এবং কোরআন তিলাওয়াত, স্পর্শ করাসহ সব ইবাদত করতে পারবেন।
দুধ পান করানো ও রক্ত বের হওয়া
রোজা অবস্থায় সন্তানকে দুধ পান করালে রোজা ভঙ্গ হবে না। এমনকি এমনিতে দুধ নিঃসরণ হলেও রোজার ক্ষতি হবে না। অনুরূপভাবে কাটা-ছেঁড়া বা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বা তরল বের হলে (তা যে পরিমাণই হোক না কেন) রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, রোজা শুধু পানাহার ও রতিক্রিয়া দ্বারাই বিনষ্ট হয়; অন্য কোনো কারণে তা নষ্ট হয় না।
উল্লেখ্য, রক্ত বের হওয়া বা তরল ক্ষরণ হওয়া অজু ভঙ্গের কারণ; রোজা ভঙ্গের কারণ নয়। তবে নারীদের ঋতুস্রাব বা প্রসবোত্তর স্রাব হলে রোজা ভঙ্গ হবে। এই রোজা পরে কাজা আদায় করতে হবে; তবে কাফফারা দেওয়া লাগবে না। (ফাতাওয়া মিসরিয়া)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com