পদলেহন

ওসমান পরিবারের পা এর উপর এখন যেমন শ্যামল কান্তির মাথা তেমনি একদা শেখ মুজিবের পা এর উপরে সাজেদা চৌধুরী, কবি সামসুর রহমান প্রমুখ মাথা ঠেকিয়েছিল। যারা মাথা ঠেকায়নি তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। যারা মাথা ঠেকিয়েছে তারা একুশের পদক পেয়েছে। যারা মাথা ঠেকায়নি তাদেরকে জেলে ভরা হয়েছে, তাদের সম্পত্তি হরপ করা হয়েছে, তাদের উপরে নির্যাতন করা হয়েছে যারা মাথা ঠেকিয়েছে তারা মন্ত্রী হয়েছে, লাইসেন্স পারমিট পেয়েছে, খ্যাতি, সম্পদ, ইত্যাদি পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো – টিকে থাকার জন্য যদি কারু পা এর উপরে মাথা ঠেকানো লাগে তখন আপনি কি করবেন? রেফারেন্সের জন্য দুইটি বই পড়া যেতে পারে। দ্যা ব্ল্যাক কোট – লিখেছেন নিয়ামত ইমাম। বইটি ইংরেজীতে লেখা। এর বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে কিনা আমি সঠিক জানিনা। দ্যা ব্ল্যাক কোট বইটি আমাজন থেকে কিনে আমি পড়েছি। আর একটি বই এর নাম “আমার ফাঁসি চাই” বইটিতে এই রকম “শ্যামল কান্তি” চরিত্র পাওয়া যাবে। যারা টিকে থাকার জন্য শেখ হাসিনার পা এর উপরে টাকা রেখেছে । “আমার ফাঁসি চাই” বইটি লিখেছেন মতিউর রহমান রেন্টু। মতিউর রহমান রেন্টু একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং এক সময়ে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসাবে নিজেই অনেক খুন খারাবার ভেতরে জড়িত ছিলেন। পরে শেখ হাসিনা রেন্টুকে “অবাঞ্ছিত” ঘোষনা করলে রেন্টু দেশ ত্যাগ করে। রেন্টুর মৃত্যু হয়েছিল পারিসে ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে।

পদলেহন একটি পুরানা রীতি। সবাই উপরে উঠতে চায়। সবাই বড় লোক হতে চায়। যারা আগে উপরে উঠে গেছে তাদের পা’য়ে মাথা রেখে বা তাদের পা চেটে যদি উপরে উঠা যায় তাহলে মন্দ কি? পা আর মাথা দুইটাই একই শরীরের অংগ। একটা উপরে থাকে আর অন্যটা নিচে। উপরের অংগ যদি অন্য কারু নীচের অঙ্গে এনে ঠেকানো যায় তাতে কি মহা ভারত অশুদ্ধ হবে? হবেনা। হিন্দু রাজাদের পদসেবা করেছি, ইংরেজের পদসেবা করেছি, পাকিস্তানের পদসেবা করেছি, ভারতের পদসেবা করছি,এখন ভারতের অংগরাজ্য বাংলাদেশে ছোট ছোট রাজা মহারাজা পরিবার সম্রাটের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন নারায়ণগঞ্জে ওসমান সম্রাজ্য। এই সম্রাজ্যের সম্রাটের পদযুগলে টাক মাথা ঠেকিয়েছে এক স্কুল মাস্টার শ্যামল কান্তি। এটা ছিল একটা ফিলার। নাটকের মাঝে মাঝে যেমন বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। ঠিক তেমনি বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এর ২৭ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে লুট, নিজামী ফাঁসি, লন্ডনে শেখ হাসিনার উপরে স্থানীয় বিএনপি কর্মীদের জুতা নিক্ষেপ ইত্যাদির মাঝে ফিলার হিসাবে আমরা দেখলাম ওসমান সম্রাজ্যের একজন সম্রাটের পায়ের উপরে স্কুল মাস্টার শ্যামল কান্তির টাক মাথা।

সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত হলো ধর্ম ইস্যু নিয়া শ্যামল কান্তি কি বলেছে তাতে। ইয়াবা সেবনকারীরা সবাই দলে দলে দাঁড়িয়ে গেল কান ধরে। আর ওসমান সম্রাটের মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো সাংবাদিকদের জন্য খিস্তি খেউর যা নাকি আসলে আশীর্বাদের মত বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে গেল আর সাংবাদিকদের মুখ উজ্বল হলো। বাংলাদেশের বিভিন্ন খুনী, ধর্ষক, পুলিশ, র‍্যাব যখন খোলা আকাশের নীচে মানুষ হত্যা করে তখন আশে পাশে কেউ থাকেনা সেজন্য ফটো সাংবাদিকেরা একটি মহান দায়িত্ব পালন করেন এই হত্যার বিভিন্ন কোপের স্টিল ছবি ও স্টিমিং ভিডিও করে আমাদের সামনে তুলে ধরেন সেই গৌরবময় মানুষ হত্যার দৃশ্যগুলো। আমরা সাড়া বিশ্ব থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এইসব “মানুষ হত্যার” ছবি দেখি। অনেকেই উৎফুল্ল হয়। অনেকেই দুঃখ পায়। অনেকেই ক্যামেরা সাংবাদিকদের কাছে কৃতজ্ঞ হয় তাদের মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা পাশবিকতাঁকে সুন্দরভাবে জবাইয়ের ফটোতে ধরে রাখার জন্য, প্রকাশ করার জন্য, মানুষ হত্যা, আর নির্যাতন বাংলাদেশে এখন একটি জনপ্রিয় শিল্প। সাংবাদিকেরা এইসব ছবি উঠিয়ে খুনীদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা পান । সেই সাংবাদিকদের প্রতি ওসমান সম্রাটের মধুর খিস্তি খেউর ভালবাসার ফল্গুধারার মত। সন্তানের প্রতি বাবার ভালবাসা ও আশীর্বাদের মত।

দুর্নীতি – বাংলাদেশের সমাজে আরো একটি জনপ্রিয় শিল্প। বাংলাদেশে যারা শোষিত তারা সবাই শোষকের হাত ধরা বা পায়ে মাথা রাখার অভিপ্রায়ে ছুটাছুটি করে। শোষিতের পাশে তাই কেউ থাকেনা। সবাই শোষকের পদলেহনে ব্যস্ত থাকে। তাই শোষনও একটি জনপ্রিয় শিল্প। সবাই শোষক হতে চায় তাই শোষিতের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। দালাল, দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, ঘুষখোড়, ধর্ম ব্যবসায়ী, লুটেরা, খুনী, ধর্ষক, মিথ্যাবাদী, প্রতারক এরাই হলো ভারতের অংগরাজ্য বাংলাদেশের সমাজে সব চাইতে আকর্ষনীয়, সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য শিল্প। যারা এইসব শিল্পের দ্বারা আক্রান্ত, পরাস্ত, নির্যাতিত, নিপীড়িত তারাই এইসব শিল্পগুলোর পায়ের উপরে মাথা ঠেকিয়ে রেখে নিজেরাও এইসব শিল্পে অবদান রাখার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে ব্যস্ত থাকে। যুগে যুগে এইভাবে শোষিতেরাই বাঁচিয়ে রেখেছে শোষক শ্রেনীকে।

One thought on “পদলেহন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *