আমার পিঠ যখন দেওয়াল স্পর্শ করে আমি তখন কিছুই করিনা। বসে থাকি এই অপেক্ষায় যে আকাশ থেকে একটা উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার আসবে আর আমাকে উঠিয়ে নেবে। সেই হেলিকপ্টারে একজন সুদর্শন মহাপুরুষ আমার প্রেমে পড়ে যাবে তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে আর বাকী জীবন আমি তার প্রেম ও ভালবাসার বাধনে কাটিয়ে দেবো।
গল্প শেষ।
তেমন হয়নি। আমি জানি তেমন হবেনা। আজ অনেক কাল হলো, বেঁচে আছি, তেমন কিছু হয়নি। হবেনা। তাই বলে কি বাকী জীবন আমি নরকে বাস করবো? মহাপুরুষ নাই তাতে কি? কাপুরুষ তো আছে। অসংখ্য কাপুরুষের ভীরে হা ডূ ডূ খেলে বেশ কেটে যাচ্ছে সময়। মাঝে মাঝে পিঠ ঠেকে যায় দেওয়ালে। কেনো এই পিঠ ঠেকাঠেকি?
এর কারণ হলো আমি দৌড়াতে থাকি । পালাতে থাকি। অনেক কাপুরুষের ভিড়ে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। অনেক বানিজ্য চারিদিকে। অনেক দর কষাকষি। অনেক ছেড়াছড়ি । টানা হেচড়াতে অনেক কাল ধরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে হৃদয়ে। কেনো আমার মনের মত হলোনা আমার জীবন। কেনো আমার স্বপ্নের মত হলোনা জীবন এইসব ভাবার আর সময় নেই । কেটে গেছে জীবন যেমন কেটে গেছে তেমন। একটা সুটকেসে আমার পুরা জীবন ভরে ফেলেছি। এখন হাটছি সেই সুটকেস নিয়ে। সুটকেস খুলিনা একেবারেই। খুলিনা ভয়ে। কি অগোছালো জীবন। অবশ্য সুটকেসের কভারে আমি লিখেও রেখেছি – “অগোছালো জীবন” কি এসে যায়? আমার অগোছালো জীবনের জন্য আমি কারু কাছে ঋনী নই। কারু সাথে কোন লেনদেন নেই। কারু কাছে কৃতজ্ঞ নই।
আমার অগোছালো জীবন একান্তই আমার। আমি আমার জীবন ভালবাসি। তাই আমি নিজেই গড়েছি আমাকে আমার মনের মতো করে। আমার কাছে পৃথিবীর সব রং, রুপ, গন্ধ, বদল, অদল, পাশবিকতা, নির্মমতা, হৃদয়হীনতা এক একটি গল্পের মত। গল্পগুলো নানাভাবে সাজানো থাকে। নানাভাবে আমার কাছে আসে। কোন কোন গল্প আসে খুব জটিল্ভাবে। কোন কোন গল্প আসে খুব কঠিনভাবে। কোন কোন গল্প আসে আমাকে ডুবিয়ে দিতে আমার নিজেরই চোখে জলে।
আমি ভেসে যাই আমার চোখের জলে। গল্পেরা আমাকে নিয়ে খেলা করে। তামাশা করে। হাসি ঠাট্টা করে। আমি ভেসে যাই। ছিড়ে যায়। রক্তাক্ত হই। এই মূহুর্তে আমার বুকের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বুকের ভেতরে রক্তক্ষরণ হলে সেটা দেখা যায়না তাই সেই রক্ষক্ষরণ বন্ধও করা যায়না। তবে আমি এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে চাই। এখুনি। আজই। আজ থেকেই আমি ভুলে যেতে চাই সেইসব কিছু যা কিছু আমার হৃদয় ছিড়েছে, খুবলে খেয়েছে। জটিল করে তুলেছে জীবন যাপন। এই মুহূর্তে আমি ভুলে যেতে চাই অনেক কিছু। সেই আগের মত। যখন আমি ভুলে যাবার অনুশীলন করতাম। যখন আমি ভুলে যেতে চাইতাম আমার অতীতের দুঃখগুলো। দুঃখগুলো আমার কাছে এক একটি অসমাপ্ত গল্পের মত। সব গল্প সমাপ্ত হওয়া উচিৎ, না হলে এইসব গল্প পিছু ছাড়েনা। আমি ভুলে যেয়ে এইসব গল্পগুলোকে সমাপ্ত করতে চাই।
যেকোন সমস্যার সমাধান করার জন্য এই সমস্যার মুখোমুখি বসা প্রয়োজন। সমস্যাগুলো যেসব ক্ষত সৃষ্টি করছে সেইসব ক্ষতের মেরামত করা প্রয়োজন । তারপর সব কিছু মেরামত করে, অষুধ লাগিয়ে, ব্যান্ডেজ লাগিয়ে, সমস্যাগুলোর সমাধান করেই সেইসব গল্পগুলোকে সমাপ্ত করা যেতে পারে। একবার গল্প সমাপ্ত হলেই তা ইতিহাসের অন্ধকার সেলফের উপরে ধুলো জমার জন্য রাখা হবে। তারপর আমি ভুলে যাবো সেই গল্প।
এখন এখানে বিকেল। আমার সমস্যাগুলো আমার সামনে। এই সমস্যাগুলো সৃষ্টির কারণ আমি নিজেই। সব সময়ের মত আমি নিজেই নিজের সমস্যা সৃষ্টি করেছি। আমি এক সমস্যা থেকে বেরুতে গেছিলাম। এক গল্প ভুলে যেতে চেয়ে অন্য এক গল্পের ভেতর জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে। এখন আমি এই গল্প থেকে বেড়িয়ে যাবো। খুব জলদী। আজকালের মধ্য। এখন আমি অনুশীলন করবো ভুলে যাবার। এখন আমি পাথর বাধবো আমার হৃদয়ে। তারপর নিজের মুখোমুখি বসে সব ক্ষতের উপরে অষুধ লাগাবো, ব্যান্ডেজ লাগাবো তারপর আমি গল্প সমাপ্ত করে সব কিছু ভুলে যাবো। এই উদ্ধারপর্ব অনেকটা সেই হেলিকপ্টারে করে আসা মহাপুরুষের মত হয়ে গেল। আমি কোন স্বপ্ন দেখিনা। না ঘুমে না জাগরণে। আমি দুনিয়ার তাবৎ অনুভুতিকে নিয়ন্ত্রন করিনা। এমনকি নিজের আবেগের দ্বারাই আক্রান্ত হয়ে ধরাশায়ি হই বারে বারে।
প্রাকৃতিকভাবে আমি একজন সুখী মানুষ। তাই দুঃখরা আটঘাট বেধে সকাল বিকাল আমার চারিপাশে ধর্না দিলেও আমি ওদেরকে এখন খারাপ প্রতিবেশী হিসাবে গ্রহণ করার অভ্যাস করে ফেলেছি নিজের নির্বুদ্ধিতার কারনে। ফলে ওরা খুব সহজেই ক্ষতবিক্ষত করে আমার হৃদয়। দুঃখগুলোকে আমি লুকিয়ে রাখিনা। একেবারে ভি আইপি ফ্রন্ট সীটে বসিয়ে তাদেরকে অবলোকন করি খুব কাছ থেকে। আকাশে যেমন হরেক রকমের নীল রং ঠিক তেমনি আমার দুঃখগুলো নানা রঙ্গের,নানা রুপের, নানা গন্ধের, নানা তামাশা নিয়ে আসে, নানা মুখোশে, নানা সাজসজ্বাতে আমাকে রক্তাক্ত করে। এই মূহুর্তে আমার হৃদয় রক্তাক্ত। এই রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে গত পরশু থেকে। আমি নিজেই দায়ী আমার হৃদয়ে এই অদৃশ্য রক্তক্ষরণের জন্য।
এখন আমি অন্য এক গল্পের ভেতরে প্রবেশ করবো এই গল্প সমাপ্ত করে।