সময়টা বেশি আগের না। পনের-ষোল বছর আগের কথা। গ্রামের প্রতিটি ঘরে তখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছায় নি। ইট-কংক্রিটে গাঁথুনিতে কাচা রাস্তা পাকা হয়ে উঠে নি। দশ বিশ ঘর খুঁজে তখন সাদাকালো টেলিভিশনের সন্ধান পাওয়া ছিলো দুষ্কর। অসংখ্য খাল আর বিস্তৃত বিল আবহমান বাংলার পরিচয়ে তখন সমৃদ্ধ।
বিকেল হলেই মহল্লায় জমত বিভিন্ন খেলার আসর। ঋতু অনুযায়ী খেল। বর্ষাকালে হাডুডু, ফুটবল, লুডু আবার শীতকালে রোদ পোহাতে বসে ষোল গুটি, তিন গুটি। বাড়ির উঠান ভরে উঠত শিশু-কিশোরদের হৈ-হুল্লোড়ে। কানামাছি, কুতকুত, বউ বউ, গোল্লাছুট খেলা হতো। বরফ পানি, মারবেল, লাটিম, মোরগ লড়াই, সাত চাঁড়া, ডাংগুলির কদর ছিলো বেশি।
কিন্তু এসব খেলাই আজ স্মৃতির খাতায় লেখা হয়ে গেছে। এক এক করে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এসব খেলাধুলা। লাঠি খেলা, ষাঁড় দৌড় প্রবীণদের স্মৃতিতে এখনো দাগ কেটে বেড়ায়। মনে করিয়ে দেয় আগেকার সুন্দর সব সময়ের কথা, মনে পড়ে আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…
কানামাছি ভোঁ ভোঁ/ যাকে পাবি তাকে ছোঁ…
‘ছি কুতকুত তানিয়া/ নৌকা দিমু বানাইয়া/ নৌকা যদি ডুবে/ বিয়া দিমু তোরে পুবে…।’ ‘ওপেন্টি বায়স্কোপ/ নাইন টেন টেইস্কোপ/ চুল টানা বিবি আনা/ সাহেব বাবুর বৈঠকখানা/ সাহেব বলেছে যেতে/ পান সুপারি খেতে/ পানের ভিতর মরিচ বাঁটা/ ইসকাপনের ছবি আঁটা/ যার নাম রেনু বালা/ গলায় দিলাম মুক্তার মালা।’ ‘ইচিং বিচিং চিচিং ছা, প্রজাপতি উড়ে যা…’। ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ/ যাকে পাবি তাকে ছোঁ…’ এমন হরেক রকম কথায় খেলায় মেতে উঠত গ্রাম-বাংলার শিশু কিশোররা। কিন্তু সময়ের খড়গে আজ খেলা বিপন্নের পাশাপাশি হারিয়ে গেছে কথাগুলো। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব ছড়া যেন একেবারেই অপরিচিত।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পথে পথে…
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য খেলাধুলার ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন এবং পুরানো। গ্রামকে বলা হয় বাংলাদেশের হৃদপিণ্ড। এককালে গ্রামে যেসব খেলাধুলা শিশু-যুবক-কিশোররা খেলত হরদম, খেলাধুলার আবেশে মাতিয়ে রাখতো বাড়ির উঠোন, স্কুলের মাঠ, ফসলবিহীন ক্ষেত বর্তমানে এসে দিন দিন সেসব খেলা হারাতে বসেছে বাংলার পল্লীগ্রামের আনাচে-কানাচ থেকে।
ক’বছর আগেও দেখা যেত গায়ের কিশোরীরা উঠোন দখল করে খেলছে সাত চারা, গোল্লাছুট, কানামাছি, বউচি, কুতকুত, মাছ-মাছ, বরফ-পানি, মোরগ লড়াইসহ প্রভৃতি খেলা। আর খেলাধুলাতে কোনো কালেই কখনো পিছিয়ে থাকেনি বাঙালি ছেলেরা। বিশেষত গ্রাম্য ছেলেরা (কিশোর-যুবক)। তাদের খেলতে দেখা যেত দাড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, মারবেল, লুডু, ক্যারাম, দাবার মতো খেলা। লুডু খেলা, ষোল গুটি, তিন গুটির মতো বুদ্ধির খেলা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো বুড়োদের হাত ধরে। অবসরে কিংবা শীতকালে রোদ পোহাতে পোহাতে এসব খেলা খেলত বুড়োরা। জমত ভালো। বর্ষাকালে খোলা মাঠে কিংবা ব্যস্তহীন রাস্তায় দেখা মিলত কিশোরদের।
কাদা মাটিতে হা-ডু-ডু কিংবা হাওয়াহীন ফুটবল খেলা জমত সবচেয়ে বেশি। তবে খেলার চেয়ে কাঁদা মাখামাখি হতো উৎসাহজনকভাবে। খেলোয়াড়রা যখন খেলা খুব কম থাকতো। সারা শরীরে কাঁদাত লাগানোয় তাদের উৎসাহ যেন ছিলো বেশি। সেই দস্যি ঘরে ফিরলে মায়েরা হয়তো একটু বকাবকি করতেন। খেলোয়াড়রা তা গায়ে না মেখে পরদিন একই চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরত। এই যাওয়া আসা হতো চিরন্তন। কিশোরদের থেকে যারা একটু ছোট তাদের ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা হতো একটু ভিন্ন ধরনের। কিশোরদের ফুটবলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ফুটবল নয়, তাদের ফুটবল কখনো কখনো ছিলো চালতার কড়ি, কখনো কখনো হতো গাছ থেকে ঝরে পড়া জাম্বুরা। খেলার উপকরণ যাই হোকনা কেনো, উৎসাহে ভাটা পড়েনি।
দাড়িয়াবান্ধা ছিলো গ্রামের লোকজনের এক চমকপ্রদ খেলা। দাগের দুপাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখত উৎসুক মানুষ। উত্তেজনায় হৈ হুল্লোড়ও হতো প্রচুর। মারবেল আর ডাংগুলি খেলা হতো শরত শীত ও গ্রীষ্মকালে। গ্রামের বুড়োরা কেউ কেউ এই দুটো খেলাকে দেখত খানিক বাজে খেলা হিসেবে। বিশেষত ডাংগুলি খেলাটা বিপদজনক বটে। কখন কার চোখে গিয়ে পড়ে সেই শঙ্কায় থাকতেন অভিভাবকরা। এসব খেলাগুলো অহরহ খেলতে দেখা গেলেও ডিজিটাল যুগে এসে সেই হারিয়ে গেছে গ্রাম্য খেলাগুলো। গ্রাম ছেড়ে ক্রমশ শহরমুখী মানুষ ক্রমশ ভুলছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলো।
কে নিলো কেড়ে সোনা রঙ্গের দিন….
কানামাছি, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, মারবেল, দাড়িয়াবান্ধার মতো শরীরের জন্য উপকারী খেলাগুলোর বদলে স্থান নিয়েছে ডিশ এন্টেনার টিভি চ্যানেল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ নানা ধরনের বিনোদন। শিশু কিশোররা তাই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এসব বিনোদনে। ফলে শারীরিক শ্রমের মতো বিনোদনগুলো ঠাই পাচ্ছে না আধুনিক সমাজে। তাই বিলুপ্তির প্রহর গুনছে গ্রামীণ বাংলার খেলাধুলাগুলো।
চোখে থাকুক মুক্ত আকাশ, নিঃশ্বাসে থাকুক বিশুদ্ধ বাতাস…
খেলাধুলার গুরুত্বের কথা আমরা কে না জানি। কায়িক পরিশ্রমের অভাবে বর্তমান প্রজন্মের যেমন যথাযথ মানসিক বিকাশ ঘটছে না, তেমনি তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটছে, বাড়ছে রোগব্যাধির সংখ্যা। তাই নিজেদের ও সন্তানদের স্বার্থেই গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা জরুরি। আগামী প্রজন্মের চোখে থাকুক মুক্ত আকাশ, নিঃশ্বাসে থাকুক বিশুদ্ধ বাতাস, বিনোদনে থাকুক এ হারাতে বসে যাওয়া গ্রামীণ ক্রীড়া চর্চা এমনটা প্রত্যাশা করা সময়েরই দাবি।
গুম আনিস liked this on Facebook.
Asif Sarker liked this on Facebook.