সহিংসতায় রেকর্ড, দায় এড়িয়ে ‘সুষ্ঠু’ দাবি

ঢাকা: চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও অনিয়ম কোনোভাবেই থামাতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। তিন ধাপের পর চতুর্থ ধাপেও কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটনার সঙ্গে সহিংসতায় প্রাণ গেছে সাতজনের।

বিগত সব নির্বাচনের সহিংসতার রের্কড ছাড়িয়ে গেলেও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করছে ইসি। একই সঙ্গে ইসির সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরকার,আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী দায় এড়িয়ে  সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছে।

তবে কমিশন ‘ভিন্ন রঙের চশমা পড়ে আছে’ বলে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ‘এই কমিশন চোখে দেখে না, কানেও শোনে না। চোখের সামনে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে কিন্তু ইসি ভিন্ন রঙের চশমা পড়ে আছে। গা-ছাড়া ভাবে নির্বাচনগুলো পার করে যাচ্ছে।’ এমনকি সহিংসতার দায় রাষ্ট্রও এড়িয়ে যেতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তারা।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ২১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এবারের ইউপি নির্বাচনে হতাহতের এ রের্কড ছাড়িয়ে গেছে। ওই নির্বাচনে তালিকা করে ইসির পক্ষে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়েছিল। চারধাপে ইউপি ভোটে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৭০ জন। সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যা ৫ হাজার
ছাড়িয়ে গেছে। তবে এসব হতাহতের কোনো রেকর্ডই নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই।

ইসি বলছে, নির্বাচনে শুধু ভোট নিয়ে অনিয়ম দেখাটা কমিশনের দায়িত্ব। বাদ-বাকিটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিষয়।

এদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে। মানুষের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে নির্বাচনে সহিংসতা হচ্ছে।

অন্যদিকে, সহিংসতার দায় মাঠ কর্মকর্তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দায় এড়াচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ইসি কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন কমিশন অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। মাঠ পর্যায় থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে না। অনিয়ম-সহিংসতার বিষয়ে মাঠ কর্মকর্তারদের কাছ থেকে আশানরূপ তথ্য-প্রতিবেদন আসছে না। এমনকি বিভিন্নস্থানে অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত থাকলেও মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি সন্তোষজনক রিপোর্ট
পাঠানো হচ্ছে। ফলে ইসি থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।

ইসিতে আসা কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, শনিবার চতুর্থ ধাপের ভোটে বেশ কয়েকটি ইউপি থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কারসাজির খবর পাওয়া গেছে। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের দুটি কেন্দ্রে শুক্রবার রাতে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ পাওয়া যায় দুই প্রিজাইডিং কর্মকর্তার
বিরুদ্ধে। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতিবান্ধা ইউনিয়নের লয়খা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল বারিক মিয়া ঘুষ গ্রহণের সময় সাধারণ মানুষ হাতে নাতে ধরে ফেলেন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা জানান, নির্বাচন কমিশনের উচিত গণমাধ্যমের খবর ও প্রার্থীদের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়া। কিন্তু তা করছে না কমিশন। ফলে কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করছে না।তবে ইসির কর্মকর্তারা জানান, মাঠ পর্যায়ের রিপোর্ট ছাড়া এ পর্যন্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুবই কম।

শনিবারের নির্বাচনেও হাতেগোনা কয়েকটি জায়গা ছাড়া কোথাও কোন সহিংসতার তথ্য নেই ইসির কাছে। শনিবার সকাল ৮টা থেকে ৭০৩টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা অব্যাহত থাকে।

ইসি সূত্র বলছে, চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে প্রথমার্ধে শেষ হওয়ার আগেই শতাধিক কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধের খবর আসে ইসিতে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে দেখানো হয় মাত্র ৫১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। যেমন, শনিবার দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ২০টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে ইসিতে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু বিকেলে কমিশন থেকে জানানো হয়, সেখানে মাত্র ৪টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে।

ভোটগ্রহণের দিনই প্রথম পাঁচ ঘণ্টার পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বসেন নির্বাচন কমিশনারা। বৈঠকে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পাঠানো প্রতিবেদনে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন একজন কমিশনার। গণমাধ্যম ও প্রার্থীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অভিযোগ আসছে তার সিকি পরিমান চিত্রও ফুটে উঠেনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের রিপোর্টে বলে ইসি সূত্র জানায়।

এ ব্যপারে একজন কমিশনার জানান, মাঠ পর্যায় থেকে রিপোর্ট না আসলে আমাদের কিছু করার নেই। তাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হয়। নির্বাচন কমিশনের এই যুক্তিকে দায়সারা মনোভাবের প্রকাশ বলে মনে করছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মাদ ছহুল হোসেঈন।

তিনি বাংলামেইলকে বলেন, নির্বাচনে ঘটে যাওয়ার সহিংসতার দায় তারা এড়াতে পারে না ইসি। দায় এড়িয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রকৃত পক্ষে ইসির অসহায়ত্বই প্রকাশ পায়। নির্বাচন কমিশন চাইলে যে কোনো অ্যাকশন নিতে পারে। যেমন গাজীপুরের এসপির বিরুদ্ধে তারা অ্যাকশন নিয়েছে।
এভাবে অনিয়মের বিরুদ্ধে অ্যাকশন না নিলে নির্বাচন সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তন হয়ে যাবে।

এ ব্যপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগে. (অব) এম সাখওয়াত হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে কথা বলতেই এখন আর ভালো লাগে না। যেখানে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় শিথিলতা রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছেন এই কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তাই রিপোর্ট পাঠিয়ে লাভ কী? তাছাড়া কমিশন তো নিজেই বলেছে, তাদের করার কিছু নেই। প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের ওপর ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে আসলে কমিশনের কোনো মাথাব্যাথাই নেই। তা অনেকটা গা-ছাড়া ভাব নিয়ে কোনোমতে সময় পার করছেন।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনের প্রতিটি ধাপে ইসির চোখের সামনে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। তবে কমিশন তা দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তারা ভিন্ন রঙের চশমা পড়ে আছে।’ এ রকম করে একের পর একটা নির্বাচন পার করে যাচ্ছে।এ বারের ইউপি নির্বাচন ৫ জানুয়ারির সহিংসতাকেও হার মানিয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনায় যারা মারা গেছে তাদের দায় রাষ্ট্রকেও নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচনী পর্যবেক্ষ সংস্থা জানিপপ এর চেয়ারম্যান ড.নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের কারণে যারা মারা গেছেন এর দায় রাষ্ট্রও এড়াতে পারে না। কেননা, নাগরিকের জানমালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সামগ্রিকভাবে সরকারের সহায়তায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।’

যদিও চতুর্থ ধাপের ভোট গ্রহণ শেষে সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ে আমরা মোটেও নির্লুপ্ত নই। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’

One thought on “সহিংসতায় রেকর্ড, দায় এড়িয়ে ‘সুষ্ঠু’ দাবি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *