মানে বিশ্ব চেতনায় দেশ, পদ্মায় মূলমন্ত্র

একটাই মূলমন্ত্র, পদ্মাসেতুর প্রতিটি কাজ হচ্ছে বিশ্বমানের, আর তা দেশপ্রেমের চেতনায় সম্মৃদ্ধ। এখানে প্রতিটি কর্মী কাজ করছেন আত্মনিয়োজিত হয়ে। আর সে কারণেই সব কাজ এগিয়ে যাচ্ছে সঠিকভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

পদ্মার মাওয়া পাড়ে প্রকল্প এলাকার গেটে বুক টান করে দাঁড়িয়েছিলেন শরিফুল। হালকা-পাতলা শরীর। মুখে বালসুলভ ছাট। সিকিউরিটি গার্ডের পোশাকে খুব একটা মানাচ্ছিলো না। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শরিফুলকে যেভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেলো তাতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। প্রতিটি গাড়ি চেকিংয়ের পর ফাইনাল পাস পাওয়ার পরই ছাড়ছেন তিনি। জানা গেলো এবছর এএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন শরিফুল। রেজাল্টের অপেক্ষায়। এরই ফাঁকে পদ্মাসেতু প্রকল্পে কাজ নিয়েছেন। এইচএসসিতে ভর্তির আগে পর্যন্ত কয়েক মাস কাজ করবেন। বললেন, দেশে এতবড় একটি কাজ হচ্ছে তাতে অংশ নিতে পেরে ভালো লাগছে।

কথা হচ্ছিলো প্রকল্পের স্পিড বোড চালক আবদুল খালেকের সঙ্গে। দিনে কত বার যে তাকে এপার ওপার করতে হয় তার কোনও গুনতি নেই। বললেন, ‘ওইটা গুইনা লাভ নাই, আমার কারণে কাজ যাতে কোথাও আটকে না যায় সেটাই চিন্তা।’

খালেক এও বললেন, যা কিছু তিনি করছেন তা মনের আনন্দেই করেন। এর আগে মাওয়া ঘাটে স্পিড বোট চালাতেন। তখন থেকেই দক্ষ চালক হিসেবে খালেকের নাম ছিলো। এখন পদ্মাসেতু প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন।

বেতন কত? জানতে চাইলে বলেন, বেতন খারাপ না, তবে আগে নিজে বোট চালালে যা আয় করতেন তার চেয়ে কমই। এখানে আনন্দটা বেশি। কখনো মন্ত্রীর বোট চালাই, কখনো বড় কর্মকর্তার, এইটার মধ্যে একটা মজা আছে, বলেন আবদুল খালেক।

বোট চালালেও সেতুর খুটিনাটি খবরাখবরও রাখেন খালেক। কোথায় কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, কয়টা পাইল বসেছে, কয়টা আরও বসবে, পদ্মার কোন পয়েন্টে পিলার দেওয়া অপেক্ষাকৃত কঠিন হবে এগুলো নিয়েও তার ভাবনা রয়েছে। জানালেন, দেশের একটা কাজ হচ্ছে এর প্রতিটা কাজই যেনো সঠিক হয়, তা নিয়ে আমরাও ভাবি।

রোববার পাইলিংয়ের কাজ হচ্ছিলো ৩৬ নং পিলারে। সেখানে হাইড্রোলিক হ্যামার দিয়ে তিন নম্বর পাইলটি বসানো প্রক্রিয়াধীন। আগের দিন ছোট্ট একটি বিপত্তির কারণে সকালে তখন কাজ বন্ধ। এরই মধ্যে কথা হচ্ছিলো তরুণ শ্রমিক শহীদুলের সঙ্গে। বলছিলেন, এখানে কাজটা মূলত চলে মেশিনে কম্পিউটারে। তাও এই বার্জে তারা জনা পঁচিশেক শ্রমিক সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। নাটবোল্ট খোলা-লাগানো, ওয়েল্ডিং, হাতুড়ি পেটানো এমন নানা ধরনের টুকিটাকি কাজ থাকে।

তবে সবচেয়ে ভালো লাগে, হ্যামার দিয়ে যখন ইঞ্চি ইঞ্জি করে পাইপ নদীর গভীরে ঢুকে যেতে থাকে তখন সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। এই তাকিয়ে থাকাই যেনো কাজ। আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি। উদ্বেগও থাকে। সামান্য ভুলটি হয়ে গেলো কিনা সেটাই যেনো দেখার দায়িত্ব। শহীদুল বলেন কম্পিউটারে কাজটি চলে, ফলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু চায়না মেজরের বড় বড় ইঞ্জিনিয়াররাও এই সময়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। তাদেরও দেখি খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটি করছেন।

ইঞ্জিনিয়ারদেরই একজনকে দেখা গেলো হাতে জটিল সব প্রকৌশলের হিসেব নিকেশ নিয়ে গভীর মনোযোগে দেখছেন। কথা বলতে রাজি হলেন না, কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ‘ইটস মোর ইম্পর্ট্যান্ট নাও’। সুতরাং না ঘাটানোই ভালো।

হ্যামারের পাস দিয়ে উঠে গেছে টানা চল্লিশ মিটার খাড়া সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে  টিম যখন উপরের ছোট পাটাতনে উঠে পড়লো সেখান থেকে গোটা পদ্মা প্রকল্প পাখির দৃষ্টির মতো চোখে পড়লো। চারিদিকেই কর্মযজ্ঞের প্রকাশ। এদিকে ড্রেজিংয়ের ঘরঘর ওদিকে মেশিনের ফট ফট। এদিকে ওদিকে পানির ওপর ভাসমান স্থাপনাগুলো। অদূরেই ৩৫ নং পিলারের তিনটি পাইল পানির মধ্য দিয়ে মাথা তুলেছে।

সেই সামান্য পাটাতনে নির্ভয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দুইজন সার্ভেয়র। এদের একজন নান্টু জানালেন এখানে তারা জিপিএস মেশিন আর কাটা কম্পাসে সারাটিক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। সামান্য হেরফের হওয়ার সুযোগটি নেই। এই কাজে তারা সিদ্ধহস্ত। আর তাদেরও মুখে সেই একই কথা সামান্য ত্রুটিও যাতে না হয়। দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, গর্বের প্রকল্প এর মান ও যথার্থতা নিয়ে কোনও ছাড় নেই।

এখান থেকে হাইড্রোলিক হ্যামার তখন পুরোই নাকের ডগায়। যেমন বড় পদ্মাসেতু, তেমনই বড় তার হ্যামার। দৈত্যাকার এই হ্যামারের হলুদ রঙ এখনো চকচকে। গায়ে মিটার সেন্টিমিটারের দাগ কাটা। ওটা দিয়েই হিসাব কষা যায়।

নান্টু জানালেন, প্রতি সেকেন্ডে একটি করে আঘাত দেয় এই হাইড্রোলিক হ্যামার যা পাইলকে এক ইঞ্চি পরিমান মাটির গভীরে নিয়ে যায়।

পাইলিং ছেড়ে মাঝির ঘাটে উঠে দেখা গেলো নদী শাসনের কাজে সিনো-হাইড্রো কম্পানির বিশাল কর্মযজ্ঞ। সেখানে শত শত শ্রমিক সিমেন্টের ব্লক বানানোর কাজে ন্যস্ত। লক্ষ লক্ষ ব্লক তৈরি করে সারি বেঁধে রাখা হয়েছে। আর তৈরির প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও লাখ লাখ।

এখানেই শাহিন ও রেজাউল আঙটা বানানোর কাজ করছিলেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কাজ থেকে দৃষ্টি সরানো গেলো না। পরে জানালেন দিনে একেকজন হাজার তিনেক আঙ্টা বানাতে পারেন। এই আংটাগুলোই বসিয়ে দেওয়া হয় ব্লকগুলোর ওপর যাতে নদীতে ফেলার সময় ক্রেনের মাথায় লটকে পানিতে ফেলা যায়। হাজারো কাজের মধ্যে অতি সামান্য এই কাজটুকুও অতি গুরুত্বে অতি মনোযোগিতায় করে যাচ্ছেন দুই বাংলাদেশি কর্মী। তাদেরও সেই একই কথা ফাঁকি কেনো দেবো! জানালেন কোট টার্গেট নেই। কিন্তু তারা কাজটি করে যান অবিরাম।

আর পদ্মার ওপারে জাজিরার নাওডোবা পয়েন্টে যেখানে সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট সেখানে দেখা মিললো একদল কর্মীর। তাদের ওই দিন বড় কোনও কাজ নেই। এই একটু আগে বড় একটি ত্রিপল দিলে পাইল করে রাখা কিছু রড ঢেকে দিয়েছেন। আগের দিন তারা এপারের একটি পিলারের স্থানে যে লোড টেস্ট চলছে তার লোড তুলেছেন। টন কে টন রড তুলে সেই লোড তৈরি করা হয়েছে। এখন চলছে লোড টেস্ট। বেলা ১১টার দিকে তারা তখন কিছুটা রিল্যাক্সড। জানালেন, এখন তাদের কাজ আশেপাশেই থাকা ডাক পড়লেই ছুটে যাওয়া, প্রকৌশলীরা কোনও কাজ দিলে সেটি করা। কাজ না থাকলেও কাজ থাকে, বললেন দলের একজন।

এখানেও একজন দাখিল পরীক্ষার্থীর দেখা মিলেলো। মাস দেড়েক হয়েছে এই প্রকল্পে কাজ করছেন। মাসে সাত হাজার টাকা বেতন। মামা এই প্রকল্পে কাজ করেন। তিনিই জুটিয়ে দিয়েছেন। বললেন, তিন মাস কাজ করলে যে টাকা জমবে তা দিয়ে আলিমে পড়ার সময় কাজে লাগবে। দাখিলে গোল্ডেন এ প্লাস থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা মোহাম্মদ রাসেল গাজী নামের এই তরুণ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর। মাথায় যার এখন টুপির পরিবর্তে স্থান পেয়েছে হেলমেট। জানালেন, সারাক্ষণই এই হেলমেট পরে থাকার নিয়ম। প্রকল্প এলাকায় কাজ করতে গিয়ে প্রতিটি নিয়ম কানুন মেনে চলেন। আর যখন যে কাজ আসে সেটাই করেন আন্তরিকতার সঙ্গে।

বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী সাখাওয়াৎ হোসেনের। রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে তার প্রথম অ্যাসাইনমেন্টই হয় এই পদ্মাসেতু প্রকল্প। প্রকল্পের শুরু থেকে তিনি এর সঙ্গে জড়িত। তিনিই বলছিলেন, এখানে মান রক্ষায় আমরা বিশ্বমানটিকেই বিবেচনা করে কাজ করছি। আর চেতনায় আমাদের দেশপ্রেম। ফলে কাজে এতটুকু খুঁত পাওয়া যাবে না। প্রতিটি কর্মীই এখানে আত্মনিয়োজিত হয়ে কাজ করছে। আর সে কারণেই পদ্মাসেতু প্রকল্প তার গতি থেকে একটুকু পিছিয়ে পড়ছে না।

এবছর বিসিএস-এ কোয়ালিফাই করেছেন এই তরুণ প্রকৌশলী। শিগগিরই হয়তো কোথাও নিয়োগ পাবেন। আর তাতে তাকে পদ্মাসেতু ছাড়তে হবে। জানতে চাইলে বলেন, কষ্ট একটুতো থাকবেই। দেশের এই মূহূর্তের সবচেয়ে প্রধান কাজটির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারার গৌরবটাই আলাদা।

তবে তিনি না থাকলে, আরেকজন আসবেন। তিনিও একইভাবে মন দিয়ে কাজ করবেন এটাই প্রত্যাশা সাখাওয়াতের।

বললেন, পদ্মাসেতু প্রকল্পটাই এমন, এখানে যেই কাজ করেন, আত্মনিয়োজিত হয়েই করেন।

সাখাওয়াতের কথার মিল পাওয়া গেলো প্রকল্পের জাজিরা পয়েন্টে অ্যাপ্রোচ সড়কের ওপর কর্মরত বয়োবৃদ্ধ শ্রমিক রহমত মিয়ার সঙ্গে। প্রখর রোদের নিচে, পিচের সড়কে লোহার গদাম দিয়ে ধুপ ধুপ আঘাতে সমান করে বসিয়ে দিচ্ছিলেন ঢালাইগুলো। জানালেন, এই প্রকল্পে তারা কাজ করেন মনের আনন্দে। এটা তাদের ‘দেশের জন্য কিছু একটা করা।’

One thought on “মানে বিশ্ব চেতনায় দেশ, পদ্মায় মূলমন্ত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *