সম্পর্ক

সম্পর্ক শব্দের সাথে স্বার্থ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বার্থই সম্পর্কের ভিত্তি। কারখানাতে শ্রমিকের দরকার হয় উৎপাদনের কাঁচামাল হিসাবে । অন্যদিকে একজন শ্রমিক মজুরী পায়  বলেই উৎপাদনের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বৈবাহিক সম্পর্কতে অনেক স্বার্থ জড়িত। অনেক দ্বন্দ। অনেক জটিলতা। বিয়ের ছবিতে হাসিখুশি স্বামী স্ত্রী কে দেখে মনে হয় স্বর্গ থেকে নেমে আসা সুখী পরিবার আশে পাশে রঙচঙের কাপড় পরিহিত মেহমানদের ছবি দেখে মনেই হয়না সামান্য স্বার্থের জন্য এই হাসি উবে যেতে ছয় ঘন্টাও লাগেনা। বিয়েতে কেউ কারুকে বিশ্বাস করেনা বলেই আইনের আশ্রয় নেওয়া হয় ও বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়। দেনমোহর এবং লিখিত অলিখিত অনেক শর্ত থাকে বিয়ের মাঝে। এইগুলা সবই স্বার্থের সাথে জড়িত। বিয়ের পরে বাচ্চা নেওয়া । একটি সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে বাবার চাইতে মায়ের অবদান ও ভূমিকা বেশী থাকে। মায়ের কষ্টও বেশী। অথচ আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত কথা রয়েছে — সন্তান আসলে বাপের সম্পদ। স্ত্রী তার স্বামীকে সন্তান উপহার দেয়।  কথাটি হাস্যকর। বাচ্চা ফেলে বাবা যখন অন্য কারু সাথে চলে যায় তখন এই উপহার মায়ের কাছেই বড় হয় । সন্তান জন্মদানে ও লালন পালনে যেহেতু মায়ের ভূমিকা বেশী এবং বাবার ভূমিকা বীর্য উপঢৌকন দেওয়া পর্যন্ত সেহেতু পুরুষ শাসিত সমাজে ব্রেইন ওয়াশ করে জিনিষটাকে অন্যভাবে প্রবাহিত/প্রচলিত/প্রতিষ্টিত করা হয়েছে।   –” স্ত্রী তার স্বামীকে সন্তান উপহার দেয়” । কস্ট করে সন্তান উপহার দেবার বিনিময়ে স্ত্রী খাবার পাচ্ছে, থাকার জন্য ঘর পাচ্ছে, নিরাপত্তা পাচ্ছে, বিনোদন পাছে, সমাজের প্রচলিত রীতি মেনে চলার জন্য সমাজের প্রচলিত সন্মানও পাচ্ছে। স্বার্থ তো রয়েছেই।

যখন স্ত্রী বাইরে কাজ করে উপার্জন করে, ঘরে রান্না করে এবং স্বামীকে সন্তান উপহার দেয় তখন ঘরে বাইরে দুইজাগাতেই স্ত্রী অতিরিক্ত শ্রম বিনিয়োগ করছে। বাচ্চারা বড় হয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবার প্রতি বেশী ভালবাসা দেখায় এবং মাকে চাকরানীর মত পরিশ্রম করতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে পরবর্তীকালে চাকরানীর ভুমিকাতেই মাকে দেখতে পছন্দ করে। মা সবসময়ই চান স্বামী সন্তানেরা ভাল ভাল খাবার খাক, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করুক, এইসব কিছু চাওয়ার পেছনে মায়ের যে কিঞ্চিৎ স্বার্থ রয়েছে সেই তুলনায় মায়ের অবদান অনেক বেশী ফলে দেখা যায় সংসারে এক মাত্র মা ই মোটামুটি নিঃস্বার্থ।

এখন যাওয়া যাক বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এই সম্পর্কে স্বার্থ একটাই তা হলো ত্যাগ ছাড়া ভোগ। তবে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। যেকোন খেলাতেই একজন হেরে যাবে অন্যজন জিতে যাবে। দুইজনই জয়ী হতে পারেনা। বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষ যে বেশী চালাক এবং নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা রাখে সেই বিজয়ী হয়। যে যত ভালভাবে মিথ্যা বলতে পারবে সম্পর্কে সে বেশীদিন টিকতে পারবে। বা বিজয়ী হবে। মিথ্যা বলা একটা আর্ট। যেমন চুরি করতে জানা একটা আর্ট। দুর্নীতি, ঘুষের লেনদেন, চুরি,ডাকাতি, প্রতারণা সব কিছুই আর্ট বা শিল্পকলা। বিবাহিত  ও বিবাহ বহির্ভুত এই দুই ধরণের সম্পর্কেই মিথ্যাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি বিবাহিত নারী বা পুরুষ অন্য একজন বিবাহিত বা অবিবাহিত নারী বা পুরুষের সাথে সম্পর্ক করে তাহলে সে ঘরে বাইরে দুইজাগাতেই মিথ্যা বলে তার এক্সট্রা ভোগ মিটিয়ে নেয়।  বউয়ের কাছে মিথ্যা বলে যে সে অন্য কাজে ব্যস্ত আর বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে বলে সে অনেক দুখী স্বামী বা অবিবাহিত। নারীদের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য । বাইরে বলে সে স্বামীর কাছ থেকে ভালবাসা পায়না অথবা অবিবাহিত আর স্বামীকে বলে অন্য কিছু।

যেকোন রকমের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে উভয়ের স্বার্থের ভেতরে একটা ভারসাম্য থাকতে হবে। একজন স্ত্রীর যখন স্বামীকে ভাললাগেনা তখন সে স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারেনা । এই না পারার অনেক কারণ থাকে। যেমন সে একা একা চলার সাহস পায়না। সে যেহেতু স্মার্ট তাই এক সম্পর্ক থেকে অন্য সম্পর্কে যেয়ে একই ঘটনার মুখোমুখি বারে বারে হতে চায়না, হয়তো সন্তানের প্রতি টান আছে, অথবা আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা  ইত্যাদি নানা কারণে সে ভাল না লাগার সম্পর্কেই থেকে যায় এবং সুযোগ পেলে যেকোন একটা  অস্থায়ী একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে।  পুরুষের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য হতে পারে। বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে মিথ্যাচার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ন হাতিয়ার। সত্যের মত মিথ্যা বলা।

কোন সম্পর্ক ছাড়া সম্পর্ক হতে পারে। সেটা হলো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে সম্পর্ক। ফেসবুক বন্ধু একটা সম্পর্ক। ইনবক্সে সম্পর্ক হতে পারে। ইমোতে সম্পর্ক হতে পারে। স্কাইপে সম্পর্ক হতে পারে। এইসব সম্পর্ক হলো কোন রকম সম্পর্ক ছাড়া সম্পর্ক । ফেসবুকে দেখা যায় বিবাহিত পুরুষেরা স্ত্রীদের পাশের ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নানা মহিলাদের সাথে রসের আলাপ করে। অথচ স্বামী স্ত্রী দুইজনেরই একসাথে ঘুমিয়ে থাকার কথা। স্বামী স্ত্রীর এক সাথে ঘুমিয়ে থাকার নিয়ম যদি চালু থাকতো তাহলে ফেসবুক সার্ভারে ৮০% ট্রাফিক কম থাকতো । ফেসবুক বন্ধুত্বের সম্পর্কের গভীরতা না থাকার কারণ হলো দূরত্ব । সামনে যে বসে আছে বা আধা ঘন্টা পরে যার সাথে মিলিত হওয়া যাবে তার সাথেই সম্পর্ক বেশী ঘনিষ্ট হতে পারে । যে ১৭০০০ মাইল দূরে বসে আছে তার চাইতে সম্পর্ক তেমন গভীর নাও হতে পারে। হবার পেছনে কোন যুক্তি নাই। কোন স্বার্থ নাই।

এখন দেখা যাক সম্পর্কের সাথে মনের কি সম্পর্ক? কোন সম্পর্কের সাথেই মনের কোন সম্পর্ক নাই। সম্পর্কের সাথে স্বার্থের সম্পর্ক আছে, দেহের সম্পর্ক আছে, মন অনুপস্থিত। সম্পর্কের সাথে অর্থের সম্পর্ক আছে। সম্পর্কের সাথে মনের কোন সম্পর্ক নাই। সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মন কোন ভূমিকা রাখেনা। মন অনুপস্থিত থাকে। মন অন্যভাবে ব্যস্ত থাকে। স্বার্থ ভাবতে বা টাকা গুনতে মন ব্যস্ত থাকে। মনের সাথে মনের মিলনে যে সম্পর্ক হয় সেই সম্পর্কের গল্প রুপকথার বই ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায়না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *