যা হয়ে গেছে তা নিয়ে কথা বলা হয় এই কারণে যাতে আগামীতে এই ঘটনা আর না ঘটে বা এই ধরণের ঘটনা ঘটার হার কমে আসে। কালিফোর্নিয়াতে একজন বাংলাদেশী সন্তান তার নিজ মাবাবাকে হত্যা করে। বিদেশে বা দেশে সন্তান লালনপালন করা অনেক কঠিন সেটা আমি জানি। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মা ও বাবা দুই ভূমিকা পালন করতে হয়েছে সন্তান লালনপালণের ক্ষেত্রে। সেজন্য আমি বুঝতে পারি ঠিকভাবে বা স্বাভাবিকভাবে সন্তান লালন পালন করা কত কঠিন।
বাংলাদেশেও অনেক সন্তান তাদের বাবামাকে তিল তিল করে হত্যা করছে। বেশ কিছু সন্তান গলা কেটেও মাকে হত্যা করতে দেখা গেছে। আমার ছেলেকে যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ তোমার মা কেমন?
আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমার ছেলে উত্তর দেবেঃ আমার মা অনেক নিস্টুর। আমাকে নিয়মিত মারধোর করছে।
যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ তোমার মা কেনো তোমাকে মারধোর করেছে?
তাহলে উত্তর হবেঃ শব্জি খেতাম না সেজন্য।
সামান্য শব্জি না খাবার জন্য মারধোর করার কি দরকার? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমি সারাদিন অফিসে কাজ করতাম আর মন থাকতো স্কুলে। অথবা বাসাতে। ভাবতাম এই বুঝি আমার ছেলে স্কুল থেকে ফিরলো। সেকি খেলায় মেতেছে আর টিভি দেখতে দেখতে খাবার কথা ভুলে গেছে। সেকি বাসার কাজ শেষ করেছে। বাসার কাজ করতে কি তাকে সাহায্য করতে হবে? স্কুলে সে কেমন করছে? সে কার সাথে মিশছে? সে কি ঠীকভাবে ঘুমাচ্ছে? কি ধরণের বই পড়ছে,কি ধরণের মুভি দেখছে? কি ধরণের অভ্যাস গড়ে তুলছে? পারিপার্শ্বিকতা তার উপরে কেমন প্রভাব সৃষ্টি করছে। প্রায় তিন চার বছর আমি রাতের সিফটে ব্যাংকে কাজ করেছি যখন আমার ছেলে অনেক ছোট। সারারাত কাজ করে ভোরে দৌড়ে ঘরে ফিরতাম তারপর ছেলেকে ও মাকে নাস্তা দিতাম। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য সে বাসাতে আসতো। আমি মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম আমার ছেলে অন্যান্য ছেলেদের সাথে খেলা করছে। আমি অনেক দিন ঘুমাতে ভুলে গেছি। অনেক রাত না ঘুমে কেটে গেছে ছেলেকে বুকে করে। যখন ঢাকাতে ছিলাম প্রায়ই ওর জ্বর আসতো । ঘন ঘন জ্বর আসাতে সে ঘুমাতে পারতোনা। আমি সারারাত তাকে বুকে করে রাখতাম যাতে সে ঘুমাতে পারে। আমি সারারাত জেগে সকালে অফিসে যেতাম।
বিদেশে এসে অনেক বাংলাদেশীদের ভেতরে অনেক ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেমন অনেকেই হিজাব লাগিয়ে মহা হুজুর হয়ে যায়। অনেকেই বলে আমাদের দেশের কালচার আর এখানের কালচারে অনেক পার্থক্য। এখানকার কালচারকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে আর বাংলাদেশের কালচার নাকি অনেক ভাল। আমি দেখি বাংলাদেশীরা সব আমেরিকান বা ভারতীয় হতে চায়। আমি সতেরো হাজার মাইল দূরে বসে বাংলাদেশকে দেখি। কি দেখি? যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন কি দেখেছি?
বাংলাদেশের কসাইরা যারা ভারতের গরু কেটে জবাই করে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করে তারা কি জবাই করার সময় বিসমিল্লাহের রাহমানুর রাহীম বলে? আমার দৃঢ বিশ্বাস বলেনা। বাংলাদেশের কসাইরা কি ইসলামিক নিয়মে গরু জবাই করে, গরুর টুকরো করে? আমার দৃঢ বিশ্বাস করেনা। তাহলে বাংলাদেশের গরু হালাল কিভাবে হলো? বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায়, বাংলাদেশে তিনচারটি শ্রেনী রয়েছে, ধনী, উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। সাড়া বাংলাদেশে দরিদ্রের সংখ্যায় বেশী। নিম্ন মধ্যবিত্তদের বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফুটে না। উচ্চবিত্তরা ধনীদের মোসাহেবী করে টিকে থাকে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জাগা নাই যেখানে দুর্নীতি ও অপরাধ হয়না। তা থেকে কি প্রমানিত হয়? বাংলাদেশে “ইসলাম” বলে কিছু নাই বা এই ধর্ম কেউ সঠিকভাবে পালন করেনা। বাংলাদেশের মানুষেরা নামেই মুসলমান আর কাজে কেউ কারুকে ভালবাসেনা। মানবাধিকারের উপরে শ্রদ্ধাহীন। এক অপরিছন্ন অপরাধে পরিপূর্ন দেশ বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশীরা যখন বিদেশে আসে তখন নিজেদের বিদেশের সমাজ থেকে পৃথক হিসাবে প্রমান করতে যেয়ে মাথায় হিজাব জড়িয়ে নেয়।অনেকেই পাকা চুলে রং করতে আলসেমী লাগে সেজন্য হিজাব জড়িয়ে নেয়। অনেকেই চুল পরে যেয়ে বিশ্রী দেখা যায় সেজন্য হিজাব জড়িয়ে নেয়।
এই হিজাবের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম ব্যক্তিগত ধর্ম না। মুসলিম উম্মা বলতে বুঝায় সাড়া বিশ্বের মুসলমান এক জাতী এবং এঁকে অন্যের পাশে এসে দাঁড়াবে যখন এই জাতির জীবন বিপন্ন হবার সম্ভাবনা দেখা দিবে। লেবাসে মুসলমান হবার কারণে আসল ইসলাম লেবাস থেকে বের হয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । ইসলাম থাকে হৃদয়ে, ইসলাম থাকে কাজ, কর্মে, ঈমানে।যদি ইসলাম থাকে তাহলে তা প্রমানিত হবে সমাজে।
কালিফোর্নিয়ার যে বাংলাদেশী শিশুটি তার মাবাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে সেই ছেলেটি একজন সমকামী। এই মুহূর্তে আমি টাইপ করা বন্ধ করে চোখ বুজি। ভাবি আমার ছেলে যদি সমকামী হতো তাহলে আমি কি তাকে মেরে ফেলতাম? সব্জি না খাবার জন্য আমি আমার ছেলেকে মারধোর করেছি অনেক। সমকামী হবার জন্য কি মারধোর করতাম?
সমকামীতা আসলে কি সেটা জানার চেষ্টা হয়তো করতাম না । নিজের ছেলের সমকামীতার কথা জেনে হয়তো বাঁধা দেবার চেষ্টা করতাম । কালিফোর্নিয়ার রাব্বি পরিবার সেটাই করেছিলেন এবং সেকারনেই তাদেরই সন্তান তাদেরকে হত্যা করে। এই হত্যার পেছনে যে বা যাহারা ইন্ধন যুগিয়েছে সে বা তাহারা অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
কাহলিল গিবরানের একটি কবিতা
দ্যা চিলড্রেন (The Children)
তোমার শিশুরা আসলে তোমার শিশু নয়
তারা এক একটি পৃথক জীবন
এক একটি পৃথক সত্বা
তারা তোমার থেকে এসেছে ঠিক
তারা তোমার সাথে থাকে সেটা ঠিক
কিন্তু তুমি তাদের স্বত্বাধিকারী নও
তুমি তাদের ভালবাসতে পারো কিন্তু চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারোনা
কারণ তারা এক একজন পৃথক মানুষ, পৃথক মগজ, পৃথক চিন্তাভাবনা
নিয়ে জন্মেছে
তুমি তাদের শরীরকে আশ্রয় দিতে পারো কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়
তাদের আত্মা আগামীদিনের ঘরে বসবাস করে
যেখানে তুমি প্রবেশ করতে পারোনা
এমনকি তোমার স্বপ্নেও নয়
তুমি তাদের মত হতে চেষ্টা করতে পারো
কিন্তু ভুলেও তাদেরকে তোমার মত হতে বলোনা
জীবন পশ্চাদমুখি নয়, ভবিষ্যৎমুখী
তুমি হলে ধনু আর তোমার সন্তানেরা তীর
যা ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান
সম্ভাবনা সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা অপরিসীম
এমনভাবে ঝুঁকে তীর চালাতে হবে
যাতে সঠিকভাবে তার মেধা বিকশিত হয়
সে তার তীরকে ভালবাসে কারণ সেটা ছুঁড়ে যেয়ে লক্ষ্যভেদ করে
যে চায় তার ধনূ হোক শক্তিশালী
নাহলে সেই তীর লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হবে
সমকামীতা হলো একটি “অবস্থা” । সমকামীতাকে ঘৃনা করা ছাড়াও দেশে বিদেশে অনেক কিছুকে আমরা ঘৃনা করি বা করিনা। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে অপরাধ – আমরা যদি অপরাধকে ঘৃনা করতাম তাহলে এত অপরাধ হতে পারতোনা। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। অনেক মানুষের বসবাস। এখানে ক্রেতারা বাজারে পন্যের মুল্য নিয়ন্ত্রন করেনা। বিক্রেতারা করে। ক্রেতারা দুর্নীতি করে যেভাবে হোক টাকা যোগাড় করে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির সাথে পাল্লা দেবার জন্য। বাংলাদেশের সকল প্রতিবাদ মিছিল ও জনসমাবেশে পুলিশে গুলি চালায়, পিটিয়ে মানুষকে পঙ্গু করে ফ্যালে। বাংলাদেশে কোন স্বাধিনতা নাই, বাংলাদেশে কোন মানবাধিকার নাই। বাংলাদেশীরা যখন বিদেশে আসে তখন এইগুলা চিন্তা করেনা। বিদেশে আছে তীব্র সাম্প্রদায়িকতা। তীব্র স্বজনপ্রীতি। তীব্র ঘৃণা । বাংলাদেশ থেকে যারা ঘৃনার চাদরে জড়িয়ে বিদেশে এসেছেন তারাও বিদেশের ঘৃণার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন।
বাংলাদেশের জেলগুলোতে নিরীহ মানুষের ঠায় দেবার জাগা নাই। বাংলাদেশের পুলিশেরা প্রতিদিন মানুষ গ্রেফতার করে টাকার জন্য। টাকা না পেলে মেরে ফ্যালে। বাংলাদেশের খালেবিলেমাঠেঘাটে মানুষের লাশ পাওয়া যায়। এত জনবহুল দেশে কেউ কারু মৃত্যুর খবর রাখেনা। এত এত সমস্যা থেকে যখন আমরা বিদেশে আসি ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য তখন যখন ছেলেমেয়েরা সমকামী হিসাবে আমাদের সামনে আসে আমরা বাধার প্রাচীর গড়ে তুলি।
এই বাধার প্রাচীর হয়ে যায় আমাদের মৃত্যুর কারণ।
হতে পারে রাব্বী পরিবারের শিশুটি এই কারণে তার মাবাবাকে হত্যা করেনি। হতে পারে কারণ অন্য কিছু। ভাবছি আমার শিশুরা কি আমাকে হত্যা করবে? যাদের বুকে করে সারারাত জেগেছি, যাদের জন্য সারাদিন কাজ করে এসে রান্না করেছি, কাপড় ধুয়েছি, বাসন মেজেছি, জীবণের সব সুখ, সাধ, আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়েছি তারা আমাকে গুলি করে বা জবাই করে মেরে ফেলবে?
এখন ভাবি অন্য কিছু। আমি কি আমার মাবাবাকে জবাই করে বা গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম? আমি অনেক দুষ্টু মেয়ে ছিলাম। কারু কথা শুনতাম না। এখনও শুনিনা। দুষ্টু হলে কি সে নির্মম হয়? হতে পারে নাও হতে পারে। কিছুই বলা যায়না। ভেবে দেখি আমি আমার পরিবার থেকে অনেক ভালবাসা পেয়েছি। আমার অবাধ্যতার কারণে আমাকে কখনো মারধোর বা বকা দেওয়া হয়নি। অনেক ভালবাসা আর অনেক খোলামেলা স্বাধীনতার মধ্য আমি বড় হয়েছি অনেক বেশী ধার্মিক ও রক্ষণশীল পরিবারে। আমার জন্য সবকিছু মাফ ছিল। সেজন্য হয়তো আমিও আমার পরিবারের সবাইকে ভালবেসেছি। এখনও ভালবাসি। যতদিন বাচবো ভালবাসবো।
রাব্বী পরিবারের কথা ভাবছি। ভাবছি সেই মা যখন দ্যাখে তার নিজের সন্তান তার নিজের বাবাকে গুলি করে হত্যা করছে তখন সেই মা কি ভেবেছিলেন? বাঁচার আকুতি ছিল চোখে, নিজের সন্তানের কাছে হাতজোড় করে মাফ চেয়েছিলেন ? মানুষের শরীরে যখন মাদকদ্রব্য প্রবেশ করে তখন কেমিক্যাল শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রন করে। রাব্বি পরিবারের সেই খুনী শিশুটি কি মাদকাশক্ত ছিল? পুলিশ রিপোর্টে তেমন কিছু উল্লেখ নেই। থাকার কথা না। কেস ক্লোজড।
ভালবাসা, মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, স্নেহ, দিনের পর দিন ছেলের জন্য রান্না করা, কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা, ছেলের মুখে নিজের আদল খুঁজে ফেরা, ছেলের জন্য সকল সময় ব্যায় করা, সকল মায়ামমতার চাদর বিছিয়ে দেওয়া সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে শুধু মাত্র একটি ধাতব বুলেট এসে বুকে বিঁধে ।
এত বছর ছেলেদের বড় করে এসে আজকে এই লেখা লিখতে যেয়ে আমি চোখের পানি বেঁধে রাখতে পারছিনা। আমি নিজের ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং আমি বিশ্বাস করি সন্তানদের স্বাধীনতা দেওয়া উচিৎ তাদের মানসিক ও মেধা বিকাশে সাহায্য করার জন্য। স্বাধীনতা একটি শক্তি যা মানুষকে নিজের মত করে বাঁচতে সাহায্য করে। স্বাধীনতা একটি অনুপ্রেরনা যা মানুষের মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনে সফল হতে সাহায্য করে। সব্জি না খাবার জন্য মারধোর স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়না। আমি একজন হিসাবরক্ষক তার মানে এই নয় যে আমি চাইবো আমার ছেলেরা সবাই হিসাবরক্ষক হোক বা ডাক্তার হোক বা ইঞ্জিয়ার হোক। আমার সন্তান তাই হোক যা হতে তার ভাল লাগে। আমার সন্তান তাই করুক যা করলে সে সুখী হয়। তবে আমার সন্তান যদি দুর্নীতি করে বা চুরি করে বা মানুষ হত্যা করে বা ব্যাঙ্ক লুট করে তবে আমিই হবো প্রথম ব্যক্তি যে নাকি এই ছেলেকে আইনের হাতে সপে দেবো।