ন্যাশনালইজম এবং ইসলামইজম

ক্যাপ্টেন নিমোঃ রাজনীতির সাথে যখন ধর্ম মিলিয়ে ফেলা হয় তখনি উদ্ভব হয় জটিল পরিস্থিতি। রাজনীতির ইতিহাস ঘাটলে খুব ক্লিয়ার একটা বিষয় দেখা যায় এদেশ কেন সারা দুনিয়ায় যখনি ধর্মকে রাজনীতির সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে তখনি সেটা তালগোল পাকিয়ে এক মৌলবাদ অথবা ধর্মীয় হানাহানির তৈরী করে।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছেন, “আমাদের মনে ধর্মের বিশেষ স্থান রয়েছে। আল্লাহতাআলা এক অদ্বিতীয় এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহতাআলার প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ ও অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। সে জন্য প্রতিটি মানুষের তার নিজের ধর্ম পালনের পরিপূর্ণ অধিকার আমাদের কাছে স্বীকৃত সত্য।“

বাংলাদেশে ৯০% মানুষ মুসলমান। ধর্ম পালন করুক না করুক প্রায় সবার মাঝেই ধর্ম নিয়ে এক সফট কর্নার আছে। থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই ধর্মকে জড়িয়ে কেউ যখনি কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অযুহাত তুলে তখনি বুজতে হবে সেখানে ধর্মীয় মুল্যবোধের থেকে ব্যাক্তি বা দলীয় স্বার্থ বেশী প্রকট।

আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে জাতীয়তাবোধ এক করে ফেলা। ইসলাম এবং বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধ কখনো পরিপুরক না। প্রতিটা মানুষ তার ধর্মীয় মুল্যবোধ থেকে অবশ্যই ধর্মীয় আচার বিধি পালন করবে কিন্তু কখনো সেটা আঞ্চলিক জাতীয়তাবোধের সীমিত গন্ডীতে যেন বন্দী না করে ফেলে।

বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের আদর্শ বলতে আমরা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়াকে দেখি। শহীদ জিয়াকে আমরা দেখি একদিকে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন মানে ইংরেজি, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষাকে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে এক করে এদেশে ইসলাম ধর্মকে এক গতি দিয়েছে। অপরদিকে এই জিয়াকেই আবার দেখি চলচিত্র শিল্পকে উন্নতি করার জন্য অনুদান দেয়ার চল তৈরী করে এদেশের সাংস্কৃতি বিকাশে অগ্রনী ভুমিকা রেখেছে, আবার বাউল গানের পৃষ্ঠপোষকতা এই জিয়াই করেন পাশাপাশি মসজিদের ইমামদের জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সন্মন্ধ্যে জ্ঞান দিয়ে সামাজিক উন্নয়নে ভুমিকা রাখে।

১৬ এপ্রিল ১৯৮২ বেগম খালেদা জিয়া স্বাক্ষরিত প্রথম অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসাবে কয়েক হাজার পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা কার্ড বিতরণ করা হয়। আবার ২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩ তে যে ভাষন উনি দেন তা স্বৈরাচারী এরশাদের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়ায়। দেখুন দুটো ঘটনাই কিন্তু এদেশের সাংস্কৃতির সাথে জড়িত। এর মানে তো এগুলো ধর্মের সাথে কোন কন্ট্র্যাডিকশান তৈরী করেনি।

আমাদের জাতি সত্তা আলাদা এবং আমাদের ভাষা বাংলাভাষা। আমাদের এখানকার বাংলা ভাষা হলো মূল বাংলা ভাষা। যেটা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমে এবং পূর্বেও গেছে। আসামেও। যদি আসামীয় কথা শুনেন, আসাম রেডিও কিংবা গৌহাটি রেডিও যখন শুনবেন তখন আপনি অনেক কিছুই বুঝতে পারবেন। দেখবেন বাংলা ভাষার একটি ভগ্ন রূপ বা খণ্ডিত রূপ। তেমনিভাবে যখন পশ্চিম দিকে যাবেন। বাংলা ভাষার রূপটা বদলে যেতে থাকবে। বাংলাদেশ হলো বাংলা ভাষা , বাংলাদেশী সংস্কৃতি ও কৃষ্টির হেডকোয়ার্টার। এটা বুঝতে হবে। অনেকেই আপানারা বুঝেন না এবং শান্তিনিকেতনের কথা বললে আপনাদের আমাদের মনে প্রানে অনেকরকম অনুভূতি হয়। ওখানে যা কিছু নিয়ে গেছে , এখান থেকে নিয়ে সেটাকে আর একটা রূপ দিয়েছে। জিনিসটা বুঝতে হবে। তখন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল। আপনি অতীতে চলে যান, হাজার বছর বা তারও বেশী বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ইতিহাস প্রায় ৯/১০ সেঞ্চুরি থেকে।

আমি আগেই বলেছি রাজনীতিতে ধর্মটা সবচেয়ে বড় কথা নয় কিন্ত ধর্ম একটা কথা হতে পারে। আমরা জাতিগতভাবে ভিন্ন। যেমন আপনারা দেখবেন মোংগলীয় জাতি আছে। তাদের হেডকোয়ার্টার মোটামুটি বলা যেতে পারে চীন দেশের যে কোন একটা মূল বিন্দু থেকে ধরে নিতে পারেন এবং সেখান থেকে এটা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়েছে। যেমন করে দূরে ছড়িয়ে পড়ে জিনিসটা লঘু থেকে লঘুতর হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এটা ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে। বার্মাতে যে জাতি দেখা যায় তারা মোংগলয়েড মোটামুটি। কিন্তু তাদের মধ্যে এবং চীনাদের মধ্যে পার্থক্য দেখবেন। আসামে তারা জাতিগতভাবে মোংগলয়েড কিন্তু চীনাদের থেকে পার্থক্য দেখবেন। যদি আপনি বিভিন্ন জায়গা থেকে মোংগলয়েড সব একসঙ্গে এক কামরার মধ্যে ভরে দেন তাহলে হঠাৎ মনে হবে যে আরে এরা তো সব একই লোক। আসলে কিন্তু এক লোক নয়। কেউ বার্মা, কেউ মালয়েশিয়া, কেউ চীনা, কেউ মোংগলীয়া, কেউ ভুটান, কেউ নেপাল, কেউ সিকিম, কেউ ভারতের পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ আসাম এলাকার।

তেমনিভাবে কতকটা আমাদেরও অবস্থা। এটাই হলো আমাদের জাতি। আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল অবস্থান। বাংলাদেশ এবং এখান থেকে চারপাশে আমাদেরই মাল-মশলা বিভিন্ন সময়ে, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে আমরা বলতে পারিনা যে, কোন এলাকার উপর আমাদের দাবী আছে। আমরা এটা বলতে পারব না। কিন্তু তারাও আমাদের উপর দাবী করতে পারেনা। সেই জন্য এপার বাংলা ওপার বাংলা কথাটায় কোন বাস্তবতা নেই।

ধর্মীয় রাজনীতিবিদ দের মুল যুক্তি হল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুকরনে এদেশে রাজনীতি করবে। এই যুক্তি পুরোপুরি অসার। আমাদের জীবনের আদর্শ হতে পারে মহানবী। এবং একজন মুসলমান হিসাবে এটাই আমার চাওয়া। কিন্তু দেশীয় রাজনীতির সাথে উনার জীবনাদর্শ কিভাবে খাপ খাওয়াবেন? আজকে যদি সৌদী আরব বাংলাদেশ আক্রমন করে তবে কি আপনি শুধু মাত্র মহানবীর জন্ম স্থান বলে আরব কে ছাড় দেবেন? নাকি ভারত আক্রমন করলে হিন্দুরা তাদের দেব দেবীদের আবাসস্থল হিসাবে ভারত কে মেনে নেবে? ধর্মীয় প্রভাব আপনার ব্যাক্তি জীবন এবং পারিবারিক জীবনে প্রভাব রাখতে পারে কিন্তু ধর্মীয় প্রভাব কখনো একটা রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি হতে পারেনা। এদেশ শুধু মুসলমানের নয়। এদেশ হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সবার। এই সব ধর্ম কে এক সুতায় বাধার জন্য আঞ্চলিক জাতীয়তাবোধের উদ্ভব হয়।

আবার ধর্মহীনতার নামে যে উচ্ছৃঙ্খল বাড়াবাড়ি ধর্ম বিদ্বেষ ছড়ায় তাও মৌলবাদের অপর নাম। একজন তালেবান বা আই এস যখন আল্লাহর নামে নিরীহ মানুষ দের জবাই করে আবার একজন ধর্মবিদ্বেষী যখন ধর্মহীনতার নাম করে মুর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বা বেলুন ওড়ানো বা মোমবাতি জ্বালানোকে আমাদের কৃষ্টি বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করে উভয়েই জাতীয়তাবাদের জন্য সমান ক্ষতিকর। আমরা বাংলাদেশী।

বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে যখন দেখতে পাই কিছু মানুষ ধর্মের নামে এক শ্রেনী বা এক ধর্মের মানুষ কে উচ্চশ্রেনীতে ফেলে অন্য কে ছোট দেখার প্রবনতাকে সমর্থন করে তখন ভয় হয় আমার প্রিয় ইসলাম ধর্মতো এটা সমর্থন করেনা তবে কেন প্রচারনা। আবার যখন দেখি ধর্মহীনতার নামে কিছু মানুষ যখন বিভিন্ন ভিন সাংস্কৃতি বা বেলেল্লাপনাকে উৎসাহিত করে তখন বুজতে পারি আমার জাতীয়তাবোধের ওপর আঘাত আসছে।

প্রতিটা জাতীয়তাবাদীকে সাবধান হতে হবে যেন ধর্ম আমার জাতীয়তাবোধ কে আচ্ছন্ন না করে আবার উদার সাংস্কৃতির নামে ভিন দেশীয় বেলেল্লাপনা যেন আমাদের জাতীয়তাবোধ কে গ্রাস না করে।

জিখান/প্রবাসনিউজ২৪.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *