কয়লা বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনায় এখন সকাল। শিশুটি ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাপড় হাতড়ায়। ক্ষুধা লেগেছে। মা তাকে বুকে টেনে নেন তারপর সে পরম তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে।

বাঁশখালীর গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনায় এখন সকাল। কিশোরী মেয়েটি পুকুরপাড়ে পা ধুতে যায়। কিনারে বসে কোলা ব্যঙ্গ তাকিয়ে দ্যাখে। পিঁপড়ার সারি একেবেকে চলে উঠোনে হামা দেওয়া শিশু ধরতে চেষ্টা করে। মা তাকে বুকে তুলে নেন।

গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনায় এখন অলস দুপুর। মাঠের মাঝখানে বসে শফিকের গরু জাবর কাটে। মুদি দোকানীর কোন কাজ নেই। চুপচাপ বসে থাকে। স্কুল ছুটি হতে বেশ দেরী আছে। ডাকপিয়ন আসে। সাইকেলে চড়ে বখাটে ছেলে চলে যায়।

পশ্চিম বড়ঘোনায় এখন সন্ধ্যা। সূর্য ডূবে যাবার আগে নানা রঙ্গের ছবি আঁকে যেখানে আকাশ আর সাগর এসে কথা বলে। আকাশের সব রং সাগরে ভাসে। পাখীরা ঘরে ফিরে গেছে সেই কবে। অন্ধকারে তাল গাছে বাধা হাড়িতে বসা পেঁচা নেমে আসে। মোড়ের মাথায় বিশাল বটগাছের গুড়িতে সে রাত কাটায়।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনায় চায়না সেবকো এইচটিজির সঙ্গে যৌথভাবে ৬০০ একর জমির ওপর ২০ হাজার কোটি টাকার কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিল্প প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৭০ শতাংশের মালিকানা চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের। ৩০ শতাংশের মালিকানা থাকবে দুটি চীনা প্রতিষ্ঠানের। এস আলম সাংবাদিকদের জানায়, “কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলাদেশে দক্ষ কোনো শ্রমিক নেই। চীনের দক্ষ শ্রমিকেরা এসে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। তাদের সঙ্গে থাকবে বাংলাদেশি ৫ হাজার অদক্ষ শ্রমিক। এ অদক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকরাই আগামী দিনে কাজ শিখে আরও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে সক্ষমতা অর্জন করবে যা এদেশের শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।“  জার্মান ও আমেরিকান প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। জাহাজ থেকে কয়লা নামানোর জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে তৈরি করা হবে বেসরকারি বন্দরের মতো একটি জেটি। প্রকল্প চলাকালীন এখানে কাজ করবে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে কর্মসংস্থান হবে ৬০০ জনের।

বিনিয়োগ করা ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার মালিকানা ও ঋণ দিচ্ছে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনায় ৬০০ একর জমি কেনার কাজ শেষ। এখন এই ৬০০ একর জমিতে প্লান্ট তৈরীর কাজ শুরু হতেই বাশখালির জনগন ফুসে উঠেছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বাঁশখালীর বিপ্লবী জনগনকে অভিনন্দন।

সাইফুল আলম মাসুদ হলো আওয়ামীলীগের আখতারুজ্জামান চৌধুরি বাবুর ভাতিজা বা ভাগিনা। আখরারুজ্জামান চৌধুরি বাবু ছিল আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য, চট্রগ্রাম-১২ এর এমপি, পাট ও বস্ত্র শিল্পের স্টান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান, আরামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান। ১৯৯৯ সালে আক্তারুজ্জামান চৌধূরী বাবু ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর হুমায়ূন জহীরকে হত্যা করে। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামীলীগের খুনীরা সমাজে সুপ্রতিষ্টিত বাবুর ক্ষেত্রেও এই স্বাভাবিক ঘটনার ব্যতিক্রম হয়নি। পাকিস্তান আমলে চট্রগ্রামের হিন্দুদের সম্পত্তি লুট করতো মুসলিম লীগের সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুরা সব মুক্তিযোদ্ধা হয়ে চট্রগ্রামসহ বাংলাদেশের সকল শিল্প প্রতিষ্টানের মালিক হয়ে বসেছেন। সেই খুনী আক্তারুজ্জামান চৌধূরী বাবুর কিডনি নস্ট হয়ে যায়। আমি বিস্মিত। এত লুটপাট করে সামান্য একটা কিডনি কিনতে পারেনা আওয়ামীলীগের সদস্যরা? জীবন কিনতে পারেনা কিন্তু জীবন নিতে পারে। লুট করা কিছু টাকা হজরত আজরাইল আঃ কে দিয়ে জীবন কিনে নিতে পারতো আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। কিন্তু পারেনি। চেষ্টা করেছে। লুটপাটের টাকায় সিঙ্গাপুর গেছিল চিকিৎসা করাতে । কাজ হয়নি। ২০১২ সালে সকলকে গভীর শোকের সাগরে ডুবিয়ে আখতারুজ্জামান চৌধূরী বাবু সেখানে চলে গেছে ১৯৯৯ সালে যেখানে হুমায়ূন জহীরকে হত্যা করে পাঠিয়েছিলেন তিনি । এখন তার ভাগিনা বা ভাতিজা এস আলম মেতেছে খুনের নেশায়। মুনাফা করা ছাড়া আর কোন নেশা নাই সাইফুল আলম মাসুদের। দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে পণ্য বেচাকেনা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে এস আলম। এখন সে অনেকগুলো ব্যবসা প্রতিষ্টানের মালিক হওয়া সত্বেও গন্ডামারার মানুষ, পরিবেশ ও  গ্রাম ধবংস করে কয়লা বিদ্যুত উতপাদনের মাধ্যমে তাকে মুনাফা লাভের খেলায় মেতেছে।

এস আলমের রয়েছে ঢেউটিন, সয়াবিন তেল, সিমেন্ট, চিনি, সিআর কয়েলসহ বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানা । এ ছাড়াও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্স, রিলায়েন্স ফিন্যান্সসহ অসংখ্য বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার মালিকানা রয়েছে।  বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন একুশে টেলিভিশনের মালিকানা কিনেছেন এস আলম। বিদেশ থেকে তেল, চিনি, গমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করেও তিনি মুনাফা অর্জন করছেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে চিনি ছিল বাংলাদেশের একটি রপ্তানীযোগ্য পন্য। এখন যা আমদানী করা হচ্ছে।

সাইফুল আলম মাসুদের এত টাকা এত সম্পদ থাকার পরেও কেনো সে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনা বেছে নিলো ধবংস করার জন্য?

১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন যখন শুরু হবে তখন রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা কয়লা পুড়বে আর কালো হয়ে যাবে পশ্চিম বড়ঘোনার আকাশ। কয়লাতে থাকে ৯৫% কার্বন ডাই অক্সাইড যা পরিবেশকে দূষিত করে। এস আলমের সেটা চিন্তা করার দরকার নেই। বড়ঘোনার পরিবেশ দূষিত হলে এস আলমের কোন ক্ষতি নেই বরং বিদ্যুৎ বিক্রি করে সে মুনাফা করবে। তার পরিবারের সদস্যরা কেউ বড়ঘোনাতে বসবাস করেনা। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে উতপাদন শুরু হলে গন্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনা ও আশেপাশের সকল গ্রাম মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।

11 কার্বন থেকে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয় যার ফলে পরিবেশ ভারসাম্য হারায়।
কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও কয়লা থেকে নির্গত হবে কোটি কোটী টন সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড,
বাতাসে মিশে এসিড বৃষ্টি ও কুয়াশা সৃষ্টি করবে।

এসিড বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টির ফোটা যেখানে পড়বে সেই জাগা জ্বলে যাবে। এই এলাকাতে কোন আবাদী থাকবেনা। সব সবুজ জ্বলে পুড়ে খাক মরুভূমি হয়ে যাবে।

তাতে সাইফুল আলম মাসুদের কোন সমস্যা হবেনা। সমস্যা হবে এই এলাকাতে যারা বাস করে তাদের। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ক্ষুধার্ত সেই শিশুটি দুধ পাবেনা কারণ দূষিত বাতাস তার মায়ের শ্বাস নেবার ক্ষমতা কেড়ে নেবে। সেই পুকুর পাড়ের কোলাব্যাঙ্গ মরে পড়ে থাকবে । সেই পুকুরের পানিতে পা ধুতে যাওয়া কিশোরীর পায়ে চর্মরোগ হবে পানিতে পা ডুবালে। সেই সাইকেল চালিয়ে যাওয়া বখাটে ছেলে হৃদরোগে ছটফট করবে হাসপাতালের বিছানায়। আরো একটা জিনিষ থাকে তা হলো মার্কারী (Mercury) । ছোট্ট শিশু যাদের শরীরের অংগ বিকোশিত হচ্ছে তাদের জন্য ক্ষতিকারক মার্কারী।

এই বাতাসে শ্বাস নিয়ে সন্তান প্রসবিনি মায়ের গর্ভপাত হতে পারে বা পঙ্গু সন্তান জন্ম নিতে পারে।

এস আলম শুধু টাকা চিনেছে । প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা টাকা ছাড়া কিছু বুঝেনা। মুনাফা করার জন্য এরা গ্রামের পর গ্রাম বিরান করার প্রকল্প হাতে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেনা। মানুষের জন্য শিল্প। শিল্পের জন্য মানুষ নয়। মানুষের জন্য পূঁজি । পূজির জন্য মানুষের বলি হতে দেওয়া যাবেনা।

পুলিশের গুলি ও সাইফুলের দালালদের হুমকী উপেক্ষা করে বাশখালীর জনগন জেগেছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে গ্রামের চারিপাশে। আমি আশা করবো মা, মাটি, মানুষকে রক্ষা করার সংকল্প নিয়ে বাঁশখালীর জনগন ঐক্যবদ্ধ থাকবেন । একতাই শক্তি একতাই বল একতাই ছুড়ে ফেলে দিতে পারে মুনাফাখোরের কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প আর রক্ষা করতে পারে বাঁশখালীর সবুজ ও সুন্দর পরিবেশ ।

শুধু বাঁশখালি নয় রামপাল উপজেলাতে কয়লা বিদ্যুত উতপাদন কেন্দ্রকেও উপড়ে ফেলতে হবে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট একটি বদ্বীপ যেখানে কয়লাকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা মানেই পরিবেশ ও মানুষের জীবন ধবংস করা। সাইফুল আলম মাসুদের টাকার অভাব নেই মাসাল্লাহ। পানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেন, টাকা বানান, অসুবিধা কোথায়? কয়লা কেনো ?? আমি সাইফুল আলম মাসুদকে বলবো আপনি এক মাস চীনের যেকোন কয়লা বিদুৎ কেন্দ্রের পাশে বাস করে আসুন এবং এক মাস পরে আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মত সিংগাপুরে হাসপাতালে ভর্তি হন তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র কি ধরনের ক্ষতি করতে পারে বাঁশখালীর গন্ডামারার পশ্চিম বড়ঘোনার মানুষজন, অন্যান্য প্রানী, আবাদি আর পরিবেশের।

ক ক1 ক2 ক3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *