মৃত মানুষ খেয়ে ২ মাস বেঁচে ছিল বিধ্বস্ত বিমানের যাত্রীরা

ঢাকা: আন্দিজ পর্বতের বুকে ১৯৭২ সালে আছড়ে পড়েছিল একটি বিমান। মৃত্যু হয়েছিল বেশ কিছু বিমানযাত্রীর। কিন্তু ভাগ্যজোরে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তারা প্রায় ২ মাস আটকে ছিলেন হিমশীতল আন্দিজ পাহাড়ের খাঁজেই। খাবারহীন, পানিহীন অবস্থায় ২৭ জন মানুষ কিভাবে টিকে গিয়েছিলেন, সে গল্পই এবার শোনা গেল রবার্ট কানেসা নামে এক বিমানযাত্রীর মুখে।

পেশায় চিকিৎসক রবার্টের সেই অভিজ্ঞতাই বই হিসেবে উঠে আসতে চলেছে পাঠকের হাতে। আগামী ৩ মার্চ প্রকাশ পেতে চলেছে ‘আই হ্যাড টু রেসকিউ: হাউ প্লেন ক্রাশ ইন দ্য আন্দিজ ইন্সপায়ার্ড মাই কলিং টু সেভ লাইফ’ নামের বইটিতে।

১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর। রাগবি খেলার জন্য চিলি যাচ্ছিলেন রবার্ট। সঙ্গে ছিল আরো বন্ধুবান্ধবও। গান-গল্প আর হইহুল্লোড় করে ভালই কাটছিল সময়। বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলেন রবার্ট। তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা হতে চলেছে। রবার্টের কথায়, ‘বুঝতে পারছিলাম আমরা অনেকটাই নিচ দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল, বিমানের ডানা দুটো যেন বরফে ঢাকা আন্দিজের চুড়ার খুব কাছে।’

প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো খারাপ আবহাওয়া। কিন্তু হঠাৎ একটা ভয়াবহ শব্দ করে বিমানটা আন্দিজ পর্বতের উপর ভেঙে পড়ল। ধাতব কিছু একটা উপর থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে ঘুরতে ঘুরতে নিচে নেমে এলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল রবার্টের। যেন ভয়াবহ একটা ঘুর্ণিঝড়ের মুখে হঠাৎ এসে পড়েছে। পাহাড়ের ঢাল ধরে বিমানটা স্লেজগাড়ির মতো নেমে আসছিল। মাথা ঘুরছিল রবার্টের। তিনি লিখেছেন, ‘আমি অপেক্ষা করছি ভয়ঙ্কর সেই ঘটনার জন্য। কিন্তু না! সেটা হতে হতে গিয়েও হলো না।’ বরং যেটা হল সেটা আরো ভয়াবহ।

প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পর পর সব ক’টা আসন যাত্রীদের নিয়েই উপড়ে আসতে লাগল সামনের দিকে। সব যখন শান্ত হল, তখনো বোঝেননি রবার্ট আদৌ বেঁচে আছেন কিনা! সহযাত্রীদের কান্না আর আর্তনাদে আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে আছে। বিমানের অধিকাংশ অংশই ভেঙে পড়েছে। বরফে সাদা পাহাড়ের অংশ দিব্যি দেখা যাচ্ছে আশেপাশে। হিম ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা দিচ্ছে। বাইরে তখন তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রির নীচে। আর বিমানের ভিতরে তাপমাত্রা প্রায় ৭৫ ডিগ্রি। রাত বাড়লো। চারপাশে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এত বড় দুর্ঘটনার পরেও দেহের কোথাও চোট পাননি রবার্ট।

সে সময় উরুগুয়ের মন্টেভিডিও মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রবার্ট। লরি সারেক্কো নামে একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম ছিল তার। রবার্টের কথায়, ‘এর আগে আমাদের জীবন খুব সাধারণ ছিল। আর পাঁচ জনের মতোই একটা কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টায়, সাধারণ জীবনযাপন। ওই মুহূর্তটায় প্রথম বুঝলাম বেঁচে থাকার তীব্র টান আসলে কাকে বলে। যেন ওই রাতটাই আমাদের জীবনের শেষ রাত। দুঃস্বপ্নের ভেতর যেন জেগে রয়েছি বাস্তবটাকে জানব বলে।’

বিমান থেকে তার ছিঁড়ে ঝুলছে। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গিয়েছে, কেউ গুরুতর আহত, কেউ বা কোমায়। খুব সামান্য কিছু খাবার ভাগ করে নিয়েছিলেন ওই ২৭ সহযাত্রী।

ক্রমশ খাবার ফুরিয়ে এল। দিনের পর দিন আসেনি কোনও সাহায্যও। রবার্টের কথায়, ‘মনে হচ্ছিল আমরা যেন অন্য কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী। তখন একটাই উদ্দেশ্য যে কোনোভাবে বেঁচে থাকা। কিন্তু আমাদের খাবার ততদিনে প্রায় শূন্য।’ পাহাড়ের ওই উচ্চতায় কোনও গাছ বাঁচে না।

বাঁচার জন্য স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়েও লড়তে হয়েছিল রবার্টদের। খিদের মুখে বরফের মধ্যে পড়ে থাকা বন্ধুদের মৃতদেহ থেকে খাবলে নেয়া মাংস একটা ধাতব পাতে রেখে ঝলসে খেয়ে বেঁচেছিলেন কয়েকজন। শুধু বেঁচে থাকার তাড়নায় সব রকম সংস্কার-কুসংস্কারের বেড়াজাল টপকে গিয়েছিলেন রবার্টরা। রবার্টের কথায়, ‘সে সময় এমন কাজ করেছি যা হয়তো মানুষের পক্ষে দুঃসহ।’

অবশেষে ৮ ডিসেম্বর, উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছয় ঘটনাস্থলে। রবার্টদের জীবিত অবস্থায় পাওয়া যাবে, তা হয়তো ভাবেননি কেউই। কিন্তু সে দিন ভাগ্যজোরে বেঁচে গিয়েছিল ওই ২৭ জন বিমানযাত্রী। এমন ভয়াবহ জীবন থেকে উঠে এসে রবার্ট লিখছেন, ‘বেঁচে গিয়েছিলাম— হয়তো মৃত্যুর এই গল্প শোনাব বলেই।’

৪ thoughts on “মৃত মানুষ খেয়ে ২ মাস বেঁচে ছিল বিধ্বস্ত বিমানের যাত্রীরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.