ঢাকা: টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা বাস্তবে আমরা অনেক সময়ই দেখি থাকি ফ্যাশন মডেলদের। নানা ঢঙে আর নানা সাজে তারা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন রকমারি পোশাক। এ সময় একটা বিষয় খেয়াল করার মতো- কখনোই হাসতে দেখা যায় না ফ্যাশন মডেলদের। এটাকে বলা যায় তাদের একটা চিরস্থায়ী স্বভাব। যদিও অনেকে মনে করেন, সবার সামনে হাসিমুখেই নিজেকে উপস্থাপন করা উচিত মডেলদের।
তবু মঞ্চে কখনোই হাসেন না তারা। অথচ অন্য সময় ঠিকই হাসেন। ফ্যাশন বিষয়ক ম্যাগাজিনগুলোতেও খুব কমই হাসতে দেখা যায় মডেলদের। এছাড়া ফ্যাশনের বিষয়ে আরো একটি বিরক্তিকর জিনিস হচ্ছে, এটি একটি নান্দনিক বিষয় হওয়ায় এর ব্যাপারে কোনো ভবিষ্যদ্বানী করা যায় না যে কখন, কী পরিবর্তন হতে পারে। এর পরিবর্তন নির্ভর করে সময়ের সাথে সাথে নান্দনিকতার পরিবর্তনের ওপর। তাই গোমরামুখের ফ্যাশন মডেলরা হঠাৎ করেই হাসিমুখে নিজেদের উপস্থাপন করবেন মঞ্চে- এমনটাও আশা করা যায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন হাসেন না ফ্যাশন মডেলরা? প্রত্যেক মঞ্চে, প্রতি বছর কেন একই রকম মুখভঙ্গি নিয়ে আবির্ভূত হন তারা? আসলে মডেলদের বর্তমান মুখভঙ্গি অনেক কিছুই প্রকাশ করে, যা হয়তো আমরা বুঝি না। এর একটি আকর্ষণীয় ও অভিজাত ইতিহাসও আছে। ১৯ শতকের রাজকীয় চিত্রকর্মগুলোতে দেখা যায় এক ধরনের শক্ত কাগজের ওপর আঁকা হতো মানুষের এক ধরনের নিরস প্রকৃতির ছবি, যাকে বর্তমান সময়ে আমরা বলতে পারি ‘প্রোফাইল পিকচার’।
২০ শতকের শুরুর দিকে বিখ্যাত জার্মান-আমেরিকান ফ্যাশন আলোকচিত্রী হর্স্ট পি হর্স্ট মনে করতেন, এ ধরনের আভিজাত্যমূলক চিত্র দ্বারা বুঝানো হতো, ‘আমি তোমার চেয়ে উত্তম’। অর্থাৎ, আমরা সাধারণত নিজেদের হাসিমুখের মধ্য দিয়ে অপরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে চাই বা তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চাই। আর এ ধরনের নিরস চাহনির মাধ্যমে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বোঝানো হয়, নিজেদের উচ্চ শ্রেণির ‘সভ্য’ ইউরোপীয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া এর মাধ্যমে কোনো বিষয়ে নিজের অনড় অবস্থানও প্রকাশ পায়।
ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক অ্যালান রিকম্যান মনে করেন, জঙ্গি বিমানের পাইলটদের ইস্পাত কঠিন চেহারা আমরা বেশি পছন্দ করি। আর মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী আরভিং গফম্যান আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন নিজের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণটাই বেশি দরকার। এতেই আভিজাত্য প্রকাশ পায়।
তবে মঞ্চে মডেলদের দেখতে যেমনই মনে হোক না কেন, ফ্যাশনে তাদের বর্তমান ভঙ্গিমার পেছনে রয়েছেন খুব সুক্ষ্ম এক ধরনের ব্যবসা কৌশল। ১৯ শতকের ইতিহাস নয়, ব্যবসায়িক স্বার্থেই তারা মঞ্চে নিজেদের গোমরামুখে উপস্থাপন করেন।
ধরুন, একদিন আমি সম্পূর্ণ নতুন পোশাক এবং ভঙ্গিমায় নিজের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় নিজের মধ্যে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। কারণ আমরা সবাই প্রচলিত ধারার সাথে থাকতে চাই। প্রচলিত ধরাই আমাদের বলে দেয়, কোন ধরনের পোশাক আমাদের জন্য প্রযোজ্য। যারা আমাকে সব সময়ই দেখে থাকে তাদের কাছে আমার এই পরিবর্তিত পোশাক সম্পূর্ণ নতুন বলে বিবেচিত হতে পারে। এতে কেউ আমাকে পছন্দ করতেও পারে, নাও করতে পারে।
তবে এই পছন্দ অপছন্দের জন্য কিছুই যায় আসে না। একজন মডেল নিজেই নিজের পোশাক পছন্দ করেন না। তাকে ডিজাইনারের পছন্দ অনুসারে পোশাক পরতে হয়। তার স্বার্থে মডেলকে নিজের প্রত্যয়ী ভাব প্রকাশ করতে হয়। আর এজন্য তাকে নিজের নিরুদ্বেগ ভাব, স্থির অবস্থান, স্বাভাবিক চলাফেরা এবং নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণও ধরে রাখতে হয়। এ অবস্থা থেকে তাদের বিচ্যুত হলে চলে না। মডেল হাসিমুখে থাকলে পোশাকের পরিবর্তে দর্শকদের মনোযোগ মডেলের দিকে চলে যাবে। মডেলদের স্বীকৃতি নয়, পোশাকের স্বীকৃতিটাই এখানে মুখ্য। পোশাকের স্বীকৃতি বাড়লেই বাড়বে পোশাকের ব্যবসা।
এতে মডেলের ব্যক্তিত্ব যতই ক্ষতির সম্মুখীন হোক না কেন- তাতে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কিছু যায় আসে না। মডেলের হাসিমুখ তার নিজের জন্য খ্যাতি বয়ে আনলেও, তা দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য। আর এ করণেই মঞ্চে হাসতে পারেন না ফ্যাশন মডেলরা। যা-ই ঘটুক না কেন মঞ্চে তাদের নিরস মুখভঙ্গিটাই ধরে রাখতে হয়।