পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। বাঙালি ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে শুরু করে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। স্বাধীনতার পর থেকে এক এক করে নতুন নতুন দেশের দরজা খুলে যেতে থাকে আর ঘরকুনো বাঙালি ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। এখন এমন দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যেখানে বাংলাদেশি নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সকে। প্রতি বছরের বাজেটের আয়ের উৎস থাকে বৈদেশিক রেমিটেন্স। আর এই রেমিটেন্স আসে প্রবাসীদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের টাকায়।
মূল কথায় আসা যাক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার, দুবাই, বাহরাইন, ওমান, আবুধাবি, কুয়েত কিংবা জেদ্দা থেকে ঢাকামুখি অনেক যাত্রীকেই দেখা যায় ইমিগ্রেশন কার্ড পূরণ করতে অন্যের সাহায্য নিতে, এর একমাত্র কারণ ভাষাগত দুর্বলতা। এই প্রবাসীরা ভাষাগত অদক্ষতার কারণে প্রবাসে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। প্রবাসীদের বড় যে সমস্যাটা দেখা দেয় সেটা হলো কোনো কারণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলে। ইংরেজি অথবা আরবিতে যতই দক্ষ থাকুক না কেন অসুস্থতার কথা নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে না পারলে পুরোটা বলা যায় না। আর তাই অনেক প্রবাসী এই ভাষাগত দুর্বলতার কারণে অসুখে-বিসুখে ডাক্তারের কাছে যেতেও সঙ্কোচ বোধ করেন। সঙ্কোচ কাটিয়ে যারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেই নিজের সমস্যার কথা ভাষাগত দুর্বলতার কারণে ডাক্তারের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছে না। অনেক সময় ডাক্তার অন্য কারও সাহায্য নিচ্ছেন নাহয় রোগী যেটুকো বলতে পেরেছে তার ওপর ভিত্তি করে বাকিটা অনুমানের ওপর নির্ভর করে প্রেস্ক্রিপশন দিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় বিশেষ করে সাধারণ শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে। আবার বেশ অনেককেই দেখা গিয়েছে রোগ শরীরে পুষে রাখতে। কারণ তাদের চিন্তা, দেশে ফিরে ডাক্তার দেখিয়ে নেবে। আর এতে করে দীর্ঘমেয়াদি অসুখের বসতবাড়ি গড়ে উঠছে এইসব প্রবাসীর শরীরে।
কাতারের এক ইমাম সাহেবের স্ত্রীকে নিয়ে অসংখ্যবার হাসপাতালে যেতে দেখেছি আমার বোনকে। ইমাম সাহেবের স্ত্রী গর্ভবতী, গর্ভ ধারণের পর থেকে সন্তান হওয়ার পর পর্যন্ত যতবার ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে প্রতিবার আমার বোন সাথে গেছে। আর এর একমাত্র কারণ ভাষাগত দুর্বলতা। শুধু ইমাম সাহেবের স্ত্রীই নন এরকম হাজারো উদাহারণ পাওয়া যাবে কাতারে।
কাতারের সরকারি ভাষা আরবি। আন্তর্জাতিক কাজকর্মে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হলেও এখানকার প্রায় ৫৬ ভাগ লোক আরবি ভাষায় কথা বলেন। প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক ফার্সি ভাষায় কথা বলেন। বাকিরা উর্দু, ভারতীয় উপমহাদেশের ও ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য ভাষাতে কথা বলেন। কাতারের বিভিন্ন হাসপাতালে অসংখ্য ভারত, ফিলিপাইন, মিশর, জর্দান, তিউনিসিয়া, নাইজেরিয়া, লেবানন, সুদান ও পাকিস্তানের ডাক্তার থাকলেও বাংলাদেশি ডাক্তার রয়েছেন মাত্র কয়েকজন। যারা রয়েছেন তাদের মাঝে মাত্র ছয় জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে যাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। তারা হলেন: ডা. আয়েশা, ডা. মুন্নি, ডা. জামশেদ, ডা. ক্বুদসিয়া হুদা, ডা. মানিক এবং ডা. মোসাদ্দেক। ডা. জেসমিন সুলতানা নামে আরও একজন প্র্যাকটিস করার অনুমতি পেয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্র্যাকটিস শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন। আর বাকি যারা আছেন তদের কারও ব্রিটিশ, আমেরিকান অথবা অন্য দেশি পাসপোর্ট।
কাতারে অসংখ্য ফিলিপিনো শ্রমিক ও গৃহকর্মী রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী, তারপরও কিছুদিন আগে ফিলিপিনো কমিউনিটি থেকে তাদের জন্য আলাদা হাসপাতালের জন্য কাতার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল যেন তারা তাদের ভাষায় তাদের ডাক্তারের কাছে সমস্যাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরে সঠিক চিকিৎসা নিতে পারে। কাতারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে অসংখ্য ফিলিপিনো ডাক্তার ও নার্স রয়েছে। কাতার সরকার চাইলে তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল করে দিতে পারে। কিন্তু একই দাবি আমরা বাংলাদেশিরা চাইলেও করতে পারি না। কারণ আমাদের পর্যাপ্ত নার্সতো দূরের কথা ডাক্তারই মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন। এমন অবস্থায় এই দাবি হাস্যকর।
কাতারে বাংলাদেশি ডাক্তার প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন কাতার শাখার সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন আক্ষেপ করে বলেন, কাতারে ২৭০ জনের ওপরে প্রকৌশলী রয়েছে। এছাড়াও পলিটেকনিক থেকে পাস করা উপ-সহকারী (ডিপ্লোমা) রয়েছে অনেক। কিন্তু বাংলাদেশি ডাক্তারের বড়ই অভাব। বিভিন্ন দেশ, যেমন ভারত। তারা তাদের নিজস্ব অর্থায়নে কাতারে অসংখ্য ক্লিনিক তৈরি করছে আর এসব ক্লিনিকে তারা তাদের দেশ থেকে নিয়ে আসছে অসংখ্য ডাক্তার। এছাড়াও সরকারি ভাবেতো আসছেই। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে কোনো সাড়া নেই। আসলে আমরা কিছুই করতে পারবো না যতক্ষণ না আমাদের সরকার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করেন। আমরা আশা করছি সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
কাতারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মোহাম্মদ নাজমুল হক জানান, কাতারে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি ডাক্তার একেবারেই নগণ্য, সব মিলিয়ে ১০/১২ জনের মতো হবে, আর যে কয়জন আছেন তাদের মাঝে আবার বেশিরভাগই অন্য দেশের পাসপোর্টধারী। তবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং কাতার সরকারের সাথে বাংলাদেশ থেকে আরও কিছু ডাক্তার আনার ব্যাপারে কথা চলছে। আশা করি, কিছুদিনের মাঝেই আরও কিছু ডাক্তার বাংলাদেশিদের সেবায় নিয়ে আসতে পারবো।
কাতার আর্মড ফোর্সে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে কর্মরত তুমুল খান জানালেন তার ডাক্তার স্ত্রীর কাতারে প্র্যাকটিস করার অনুমতি নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। নানা জায়গায় কাঠখড় পুড়িয়ে প্রায় দেড় বছর ছোটাছুটির পর অবশেষে মিলেছে কাতারে প্র্যাকটিসের অনুমোদন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের সরকার কাতারে লেবার রপ্তানী নিয়ে কাজ করলেও ডাক্তারদের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের প্রচুর ডাক্তার রয়েছেন তাদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এমনকি ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশে প্র্যাকটিস করলেও কাতারে লম্বা প্রসেস এবং পর্যাপ্ত সরকারি সহযোগিতা না থাকায় কাতারে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশি ডাক্তাররা আর এই জাগয়াটা দখল করে নিচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইনের মতো দেশের ডাক্তারেরা।
কাতারে কেউ ডাক্তারি প্র্যাকটিস করতে চাইলে তাকে দুবাই ভিত্তিক ডাটাফ্লো নামক এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। জেনারেল ফিজিশিয়ান এবং স্পেশালিস্ট উভয়ের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। স্পেশালিস্ট আবেদনকারীদের যাদের এস. এমডি. করা আছে তারা সরাসরি ভাইভার মাধ্যমে কাতারে প্র্যাকটিস করার সুজোগ পেয়ে থাকে। আর যদি কাতারের হামাদে আবেদন করতে চায় তাহলে USMLE step 2 CK পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় এবং আবেদনকারীর IELTS অবশ্যই স্কোর ৭ থাকতে হয়।
ডাটাফ্লো আবেদনকারীর ডাটা কাতার থেকে দুবাই পাঠায়, সেখান থেকে ডাটা প্রসেসিং শেষ হলে সেগুলো পাঠানো হয় বাংলাদেশের সেইসব প্রতিষ্ঠানে যেখান থেকে এমবিবিএস পাস করেছে এবং যে সব প্রতিষ্ঠানে প্র্যাকটিস করেছেন। বাংলাদেশর সেইসব প্রতিষ্ঠান থেকে আবেদনকারীর সব তথ্য যাচাইবাছাই করার পর রিপোর্ট পেলে সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সেখান থেকে ফাইনাল রিপোর্ট পাঠানো হয় কাতারের সুপ্রিম কাউন্সিল অব হেলথে। রিপোর্ট পজেটিভ হলে আবেদনকারীকে এক বছর ইন্টার্নশিপ করার অনুমতি দেয়া হয়। এক বছর পর আবেদনকারীকে প্রোমেট্রিক এক্সামে অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হওয়ার পর কাতারে প্র্যাকটিস করার অনুমতি দেয়া হয়। তবে প্রোমেট্রিক এক্সামে অংশগ্রহণ করার আগে কাতারের যে কোনো একটা হাসপাতাল অথবা ক্লিনিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে এবং প্রোমেট্রিক এক্সামে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই প্র্যাকটিস করতে হবে, চুক্তির মেয়াদ যতদিন থাকবে। এরপর চাইলে অন্য কোথাও ট্রান্সফার হতে পারবে।
ডাটাফ্লো নামক এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করে ইন্টার্নশিপ করার অনুমতি পেতে একজন ভারতীয় ডাক্তারের যেখানে ৩ মাস লাগে সেখানে একজন বাংলাদেশির লাগে এক বছরের বেশি। এর কারণ হিসেবে কাতারের নাসিম আল রাবি মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত বাংলাদেশি ডাক্তার মাহফুজ জামশেদ বলেন, ডাটাফ্লো আমাদের দেশে কোন ডাক্তারে সম্পর্কে তথ্যের আবেদন করলে সেখানে মাসের পর মাস পরে থাকলেও ডাটাফ্লোকে তথ্য দিতে গড়িমসি করে সেইসব প্রতিষ্ঠান, এ কারণে ডাটাফ্লোর তথ্য পেতে অনেক সময় লেগে যায়। এমতাবস্থায় আবেদনকারীর প্রসেসের সময়ও অনেক দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় অনেক ডাক্তাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এমতাবস্থায় কাতারে ডাক্তার নিয়োগের ব্যাপারে আমাদের সরকার যদি একটু আন্তরিকতার সাথে কাতারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে কাতারের সুপ্রিম কাউন্সিল অব হেলথে এবং কাতারের প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে মার্কেটিংয়ের জন্য কমপক্ষে দুইজন অফিসার নিয়োগ করেন সেই সাথে কাতারের সুপ্রিম কাউন্সিল অব হেলথের একটা প্রতিনিধি দলকে যদি বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় সরকারি হাসপাতাল যেমন : বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, বগুড়া মেডিকেল কলেজের মতো বড় বড় হাসপাতালগুলোতে ভিজিট করানো যায় তাহলে হয়তো বাংলাদেশি ডাক্তার সম্পর্কে তাদের ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে ফলপ্রসূ হবে। তাহলে হয়তো কাতারে বাংলাদেশি ডাক্তারদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত সম্পন্ন হবে সেই সাথে কাতারে বাংলাদেশি ডাক্তারদের কর্মসংস্থান আরও বৃদ্ধি পাবে।
কাতারে বাংলাদেশি ডাক্তারের কর্মসংস্থান আরও বৃদ্ধি করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশি মালিকানাধীন ক্লিনিক গড়ে তোলা। যেমনটা করছে ভারতীয় ব্যাবসায়ীয়া। কাতারে অনেক বড় বড় বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রয়েছে, কোটি কোটি রিয়েল ইনভেস্ট করছে বিভিন্ন খাতে। শত শত শ্রমিক কাজ করছে তাদের প্রতিষ্ঠানে কিন্তু এখন পর্যন্ত চিকিৎসা খাতে কাওকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। সরকারের পাশাপাশি এইসব ব্যাবসায়ীরাও যদি চিকিৎসা খাতে একটু নজর দেয় তাহলে হয়তো কাতারে বাংলাদেশি ডাক্তারদের কর্মসংস্থানের বড় একটা সম্ভবনা তৈরি হবে। সেই সাথে প্রবাসীদের সু-চিকিৎসার পাশাপাশি দেশে রেমিটেন্সের প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে।
Moin Ahmed liked this on Facebook.
Shahin Vai liked this on Facebook.
MadZy Anik MoLlick liked this on Facebook.