মা বা বাবা যখন গৃহকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করে তখন শিশুরা তা অবলোকন করে। মা বা বাবা যখন শিশুর সাথে সুন্দর ব্যবহার করে বা আদোর করে কথা বলে যখন শিশুরা বুঝে যে কেনো মা বা বাবার ব্যবহারে এই তারতম্য। একটি পরিবারের সকল সদস্য সদস্যাদের নানাবিধ ব্যবহার আচার আচরণ থেকে শিশুরা মানুষের আচার আচরণ সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াগুলোকে পর্বেক্ষণ করে। বুঝতে শেখে ভাল, মন্দ, শত্রু, মিত্র, বল প্রয়োগ,স্বার্থপরতা, ত্যাগ, অপমান, সন্মান, ঝুঁকি, নিরাপত্তা ইত্যাদি। সব চাইতে গুরুত্বপূর্ন শিক্ষা হলো যে যেখানে অবস্থান করছে বা যা কিছুর উপরে নির্ভর করছে সেইসব কিছুর উপরে প্রভাব বিস্তার করে নিজের অবস্থানকে মজবুত করার শিক্ষা।
সৌদী আরবে এক গৃহকর্মী একবার এক পরিবারের শিশুকে হত্যা করে। এই শিশুর মাবাবা সপিং করতে গেলে গৃহকর্মী এই শিশুকে হত্যা করে দরোজা আটকে বসে থাকে। শিশুর মাবাবা ঘরে ফিরে এলে গৃহকর্মীর ঘরের দরোজা বন্ধ পেয়ে ডাকাডাকি করে পরে দরোজা ভেঙ্গে ফেলে ভেতরে ঢুকে দ্যাখে শিশুর লাশের সামনে গৃহকর্মী চুপচাপ বসে আছে।
শিশুর মাবাবা এই গৃহকর্মীর উপরে ক্রমাগত নির্যাতন করেছে। এই গৃহকর্মীটি এই শিশুটির মাবাবার কাছে যেমন অসহায় ছিল তেমনি এই শিশুটি এই গৃহকর্মীর কাছে অসহায় ছিল। গৃহকর্মীর দৈন্যতার সুযোগ নিয়ে মালিক বা মালকিন নিয়মিত নির্যাতন করে এই গৃহকর্মীকে শিখিয়েছে দুর্বলের উপরে নির্যাতন করার নিয়ম। এই গৃহকর্মীটি সেটাই করেছে। দুর্বল শিশুটিকে হত্যা করে তার উপরে হওয়া সকল নির্যাতণের প্রতিশোধ নিয়েছে। ফলাফল? মালিক মালকিন তাদের শিশুকন্যাকে হারিয়েছে।
অথচ মানুষ যখন তার নিজের ঘরের মধ্য অসহায় একজন গৃহকর্মীর উপরে নির্যাতন করে তখন চিন্তা করেনা যে তার নিজের একটি সন্তান আছে। অথবা সে নিজেও কারু সন্তান। তার সন্তানের উপর যদি একইভাবে অন্য কেউ নির্যাতন করে তাহলে তার কেমন লাগবে বা তার নিজের উপরে যদি কেউ নিপীড়ন চালায় তাহলে সে কেমন অনুভব করবে ।
আমরা যদি ইসলাম ধর্মের আলোকে এই ব্যাপারটাকে দেখি তাহলে দেখবো – দাস, দরিদ্র ও এতিমের উপরে সদয় হবার জন্য আমাদের উপরে নির্দেশ দেওয়া আছে। ইসলামের তীর্থভূমি সৌদী আরবে গৃহকর্মীর উপরে পাশবিক নির্যাতন করা হয় আর এই খবরগুলো তখন বাইরে আসে যখন সেইসব গৃহকর্মীদের আত্মিয়স্বজনেরা মেয়ের খবর না পেয়ে সেইসব দেশের এ্যামবেসীগুলোতে যেয়ে রিপোর্ট করে। সৌদী আরবের ঘরে ঘরে গৃহকর্মীদের নির্যাতণের খবরগুলোকে চাপা দেওয়া হয়। সব লাশ পাওয়া যায়না। কিছু লাশ গুম হয়ে যায়। কিছু গৃহকর্মী অদৃশ্য হয়ে যায় বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামের সদস্যদের মত। ৫-৬ মে, ২০১৩ সালে সবাই দেখেছে ওদের আসতে কিন্তু কেউ দ্যাখেনি ওদের ফিরে যেতে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা থেকে ৪৫ মিনিটের ভেতরে ওরা বাতাসে মিশে গেছে। চারিদিকে বড় বড় অট্টালিকা ভেদ করে সেদিন খুব জোড়ে বাতাস প্রবেশ করে শাপলা চত্বরের মাঝে খানে। ঘূর্নীঝরে উড়িয়ে নিয়ে যায় সাথে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয় হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ। সৌদী আরবের মতই সাড়া বাংলাদেশের ঘরে ও বাইরে দরিদ্র ও এতিমের উপরে নিপীড়ন চালানো হয়। এটা বাংলাদেশের একটি জাতীয় ঐতিহ্য ।
সব পাশবিকতার খবর প্রকাশ হয়না। পাশবিকতার খবর প্রকাশেও রাজনীতি করা হয়ে থাকে। যদি কোন রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে থাকে তাহলেই এইসব পাশবিকতার খবর প্রকাশ করা হয়। শিশু রাজনের হত্যাকারীকে ফাঁসি দিয়ে দেখানো হলো দেশের আইনকানুন সব ঠিকমত চলছে আর শিশু সৌরভ হত্যাপ্রচেষ্টাতে আওয়ামীলীগ সদস্যকে মুক্তি মুক্তি দিয়ে সর্বকালের মতই জনগণের কাছে একটি বার্তা পৌছে দেওয়া হলো “আওয়ামীলীগের সদস্যদের উপরে প্রয়োগ করার জন্য দেশে কোন আইন তৈরি করা হয় নাই”।
“আওয়ামীলীগ আইন বানায় তাদের খুন, লুটপাট, ধর্ষণের সুবিধার্থে”
একইভাবে সাড়া বিশ্বে যারা শক্তিশালী তারা বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে আর বলে “সেলফ ডিফেন্স” বা “আত্মরক্ষার জন্য মানুষ হত্যা করা হচ্ছে”। পুকুরের এক পাড়ে যদি পানিতে বিষ মেশানো হয় তাহলে পুকুরের পানি বিষাক্ত হয়ে যাবে। পুকুরের সাথে পাতালের সম্পর্ক খুব ক্ষীণ, পুকুরের সাথে পাতালের পানি বা অন্য পানির সংযোগ অনেক গভীরে তাই স্রোত কম আর এই ধীর স্রোতের জন্য এই বিষ কেটে উঠতে অনেক সময় লেগে যায়। পুকুরে যে থির থির স্রোত দেখা দেয় তা বাতাসের জন্য। তাতেও বিষক্রিয়া কাটেনা। এছাড়াও পুকুরের পানিতে নানাভাবে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে ফলে পুকুরের পানি ব্যবহার করে অনেকেই অসুস্থ হয় । যদি সরাসরি বিষ মেশানো হয় তাহলে এই পুকুরের পানি যে পান করবে সে মরে যাবে। সমাজ হলো পুকুরের পানির মত। সমাজের এক কোনে অপরাধ সংঘটিত হলে সমাজে বসবাসকারী সবাই যদি যার যার নিজের টিকে থাকার স্বার্থে চুপচাপ বসে থাকে তাহলে সবার টিকে থাকা ঝুকিবহুল হয়ে যাবে। অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে অপরাধ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্টিত হবে। অপরাধী ও অপরাধের যারা শিকার তারা সবাই একই সমাজে বসবাস করে। এই অপরাধীর সন্তানেরা একদিন অপরাধের শিকার হয়ে যেতে পারে। সেটা কেউ চিন্তা করেনা। যারা লুট করে তারা বিশ্বাস করে, লুটপাট করে আনা সম্পদ যুগ যুগ ধরে তাদের বংশ রক্ষা করবে। ফজলুল কাদের চৌধুরী আইয়ুবের আমলে মন্ত্রী ছিলেন। দুর্নীতি ও লুটপাট করে বিশাল সম্পদ বানিয়েছেন কিন্তু সেই লুটের সম্পদ তার সন্তানকে ফাঁসি থেকে রক্ষা করতে পারেনি। যাদের থেকে লুট করা হচ্ছে তাদের আশে পাশে যারা লুট হয়ে যেতে দেখছে তারাও শিখে নিচ্ছে কিভাবে লুট করতে হয়।
যারা ইসলামী আন্দোলন করেন সাড়া বাংলাদেশে তাদের অনেকেই বড় বড় ব্যবসায়ী এইসব ব্যবসায়ীরা কি ঘুষ না দিয়েই বা চান্দা না দিয়েই বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্টান টিকিয়ে রেখেছেন? অসম্ভব! ঘুষের আদানপ্রদান ছাড়া বাংলাদেশে কোন কাজ হয়না। অন্যায়ের সাথে আপোষ করেই বাংলাদেশে সবাই টিকে আছে। দুর্বলের উপরে আঘাত ও সবলের পদলেহন করেই সবাই টিকে আছে। তাই যারা অপরাধী তারা অবিচার ও অত্যাচারের নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। আর যারা মেনে নিচ্ছে তাঁরা সবাই অপরাধীকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে এবং নিজেরাও অপরাধীর তালিকাতে নাম অন্তর্ভুক্ত করছে।
অন্যায়কে “না” বলার কেউ নাই। সবাই অভিযোগ করে কিন্তু কেউ নিজের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেনা – সমাজে এই অন্যায় ও অবিচার প্রতিষ্টায় তার নিজের কতটূকু অবদান আছে?
অন্যায় মেনে নিয়ে বা অন্যায়ে অংশগ্রহণ করে সে কতটূকু অবদান রেখেছে?
“উপায় নেই” বলে একটা শব্দ প্রচলিত আছে সেই শব্দ দিয়ে সে কতবার নিজের দুর্বলতা, ভয়, ও নীতিহীনতাঁকে “অসহায়” মোড়কে সাজিয়ে ইঁদুরের মত লুকিয়ে থেকেছে বা থাকছে?
অন্যায়ের সাথে আপোষ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার নাম “উপায় নেই”!!
অপরাধভিত্তিক বাংলাদেশের সমাজ প্রতিষ্টাই বাংলাদেশের সমাজের সকলেরই কিছুনা কিছু অবদান রয়েছে। কেউ অন্যায় করে আর কেউ অন্যায় করতে দিয়ে বা কেউ চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে অন্যায় প্রতিষ্টিত করেছে। অন্যায় ও অবিচার এখন নিয়ম হয়ে গেছে।
তাই কারু মুখেই অভিযোগ মানায়না। অভিযোগ করার অধিকার হারিয়েছে সবাই।
ব্রাম্ভনবাড়িয়া, কালিহাতি বা শাপলা চত্বর – মানুষ হত্যার উৎসবে তথাকথিত মানুষেরা নীরব দর্শক হিসাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কেউ বলেছে রং মেখে শুয়ে ছিল। কেউ বলেছে “ওদের মাবাবা খুঁজতে আসেনি তার মানেই পুলিশ ওদেরকে যার যার বাসায় লেপের নিচে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে। আর এভাবেই বাংলাদেশের সমাজ থেকে “মানুষ” নামের দ্বিপদ প্রানী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বহুযুগ আগে আমাদের কাছে ধর্ম প্রচার করা হয়েছিল সম্ভবত আমাদের মাঝে “মানুষ” আবিস্কার করার স্পর্ধায়। কিন্তু পাশবিকতার উপরে “মানুষ” ক্ষমতায়ন করতে পারেনি। পশুরা জিতে গেছে। “মানুষ” হেরে গেছে। তাই প্রতিদিন নানা উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের দরিদ্র, এতিম, দুর্বল, নারী ও শিশুদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। পাশবিকতার জয় হয়েছে।
Abdul Alim liked this on Facebook.
Zahidul Islam Shahin liked this on Facebook.