“শিক্ষক সন্তানের পিতা মোতাহারুল হান্নান এখন রিক্সাওয়ালা”

চার সদস্যের পরিবারের বড় সন্তান গোলাপ রাব্বানী রানা খুলনার একটি কলেজের শিক্ষক । একাকী বিয়ে করে খুলনাতেই বসবাস করছেন, কিন্তু বাড়িতে একমাত্র ছোট ভাই আকিবুল হাসানসহ পিতা-মাতার কোনো খোঁজ-খবর নেন না । পরিবারের বড় সন্তান রানাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাতে গিয়ে পৈতিকভাবে পাওয়া চার বিঘা ধানি জমি অনেক আগেই বন্ধক দিয়ে রেখেছেন রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার আজপুর গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের সন্তান মোঃ আফজাল হোসেন ওরফে মোতাহারুল হান্নান ।

বড় আশা করে বড় সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করেছিলেন সংসারের হাল ধরবে বলে । কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছর ধরে পরিবারের কোনো খোঁজ-খবর নিচ্ছেন না । ছোট ছেলে আকিবুল হাসান জিপিএ-৫ পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে পলাশবাড়ি সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে । কলেজ পড়ুয়া এ সন্তানের ভবিষ্যত ও তিন জনের সংসার নিয়ে মোতাহারুল হান্নান বৃদ্ধ বয়সে চরম দুরাবস্থায় পড়েছেন । জমি বন্ধক দেয়ার পরও পলাশবাড়ি বাজারে ছোট একটি কাপড়ের দোকান ছিল, ঋণের কারণে সেটিও এখন বন্ধ হয়ে গেছে । বৃদ্ধ হান্নান এখন তিন সদস্যের সংসারের খরচ সহ ছোট সন্তান আকিবুল হাসানের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ থেকে ঢাকার মিরপুর অঞ্চলের অলি মার্কেটের খায়রুলের গ্যারেজের রিক্সা চালাচ্ছেন ।

হান্নানের স্ত্রীর বড় ভাই ডাঃ ইয়াকুবুল আজাদ । তার স্ত্রী রওশন আরাও একজন চিকিৎসক । ইয়াকুবুল আজাদ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর ওখান থেকেই অবসরে গিয়েছেন । ইয়াকুবুল আজাদ মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিংয়ে স্ত্রীর নামে রওশন আরা টাওয়ার গড়ে তুলেছেন । সেখানে স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে একটি ক্লিনিক করেছেন । ইয়াকুবুল আজাদের অনুরোধেই শিক্ষিত ভাগ্নে গোলাপ রাব্বানী রানা কলেজে শিক্ষতার চাকরি পেয়েছেন বলে জানান, তার বৃদ্ধ বাবা মোতাহারুল হান্নান । গোলাপ রাব্বানী রানার বিরুদ্ধে তার চাকরি দাতা চিকিৎসক মামার কাছেও কোনোদিন অভিযোগ করেননি পিতা মোতাহারুল হান্নান এবং ব্যক্তিত্বর কারণে তাদের কাছেও কোনোদিন হাত পাতেননি তিনি ।

মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আজ সকাল ১১টার দিকে আমার বড় ছেলে নিখাদকে নিয়ে বাসা থেকে নিচে নেমে বাড়ির গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় বৃদ্ধ হান্নান রিক্সা নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন । কালো চুলের আড়ালে পাকা চুল দেখে এবং তার মুখ ও প্রাথমিক দু’চারটা কথা শুনেই আমার সন্দেহ হয় । আমি তাকে বললাম- চাচা আপনাকে তো পেশাদার রিক্সাওয়ালা মনে হচ্ছে না । তাছাড়া আপনি বৃদ্ধ মানুষ, তাই আপনার রিক্সা চড়ে যেতে চাচ্ছি না । এ কথা বলেই প্যান্টের পকেট থেকে ইজি লাইট সিগারেটের পেকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালাম ।নিখাদ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । নিখাদ জানে আমি ধুমপান করি, কিন্তু তার সামনে ধুমপান করেছি বলে খুব একটা মনে পরেনা । তাই হয়তো অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল । আমার কথার প্রেক্ষিতে রিক্সাওয়ালা মোতাহারুল হান্নান বললেন, আপনি না গেলেও আমার তো রিক্সা চালাতেই হবে । তার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা নিখাদ বলল, চলো- ওনার রিক্সা দিয়েই যাওয়া যাক ।

আমার বাসা থেকে মোহাম্মদপুর কলেজ গেট খুব বেশি দূরে নয় । ত্রিশ টাকা রিক্সা ভাড়া দিলেই রিক্সাওয়ালারা খুশি হন । সরাসরি কলেজ গেট না গিয়ে মাঝখানে পিকেএসএফ ভবনের সামনে একটু থেমে পকেট থেকে দশটার একটি নোট বের করে দিয়ে রিক্সাওয়ালা মোতাহারুল হান্নানকে বললাম, চাচা আপনি একটা চা আর একটা পান খান, আমি একটু দুই তলা ব্যাংক থেকে কাজ সেরে আসি, আর নিখাদকে বললাম, তুমি রিক্সাতেই বসো । পাঁচ মিনিটে কাজ শেষ করে আবার রিক্সায় উঠে তাকে বললাম, চাচা আপনি রিক্সা চালাতে এলেন কেনো ? যান পরিবহনের শব্দে রিক্সায় বসে বেশি কিছু শুনতে পারিনি । এর মধ্যে কলেজের সামনে চলে আসি । ত্রিশ টাকা হাতে দিয়ে বললাম, আপনি এ টাকা দিয়ে কলা-রুটি আর চা পান খেয়ে বসুন, আমি কাজ সেরে আসছি । ব্যাংকে ভর্তি টাকা জমা দেয়ার পর বই খাতা কলম নিয়ে বের হতে বেশ সময় লেগে গেলো ।

এসে দেখি রিক্সাওয়ালা চাচা বসে আছেন । তাকে নিয়ে তালতলার একটি কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার পথে রিক্সা ওয়ালা চাচার কথা শুনে নিখাদ বলে উঠলো- আল্লাহ যেন আমাদের এমন সন্তান না বানায় । নিখাদ আমাকে আস্তে আস্তে কানে বলল- চারশ টাকা দিয়ে দিয়ে দিও । আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম । বাসার কাছে এসে নিকটতম প্রতিবেশি ঘনিষ্ট দুই বন্ধুকে ফোন করে বাসার কাছে থাকতে বললাম, তারা বাসার সামনে অপেক্ষা করছিল মোতাহারুল হান্নানকে দেখার জন্য ।

মোতাহারুল হান্নানকে আমার বাসা দেখিয়ে বললাম, এই বাসাতেই আমি থাকি । এ দিকে এলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন । গেটে সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে আমার নাম বলবেন, তারা এন্টারকম করে অথবা আমি বাসার বাহিরে থাকলে মোবাইলে ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবে । তাছাড়া আমার একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম- এটা রাখুন, বাসার টিএন্ডটিসহ আমার মোবাইল নাম্বার ও অফিসের টিএন্ডটি নাম্বার আছে । প্রয়োজন মনে করলে আমার সাথে কথা বলবেন । এই বলে রিক্সাওয়ালা চাচা মোতাহারুল হান্নানের একটি ছবি মোবাইল দিয়ে ধারণ করি । এই চাচার শেষ ইচ্ছে, শরীরের শেষ বিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও তার ছোট ছেলের লেখাপড়া শেষ করে দেখবেন- সব সন্তানই অমানুষ হয় কি-না ।
শেখ এমদাদুল হক মিলনের ওয়াল থেকে সংরহ

১১ thoughts on ““শিক্ষক সন্তানের পিতা মোতাহারুল হান্নান এখন রিক্সাওয়ালা”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *