ছবিটি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের। ফেনীর ছাগলনাইয়ায় শ্রীনগর সীমান্ত চৌকির কাছে গভীর বনে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অস্ত্রহাতে অবস্থান করছেন ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ।
এই অলি আহমেদ সেই মুক্তিযোদ্ধাদের একজন যারা একাত্তর সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাদানে জড়িত ছিলেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য অলি আহমদকে বীর বিক্রম খেতাব দেন।
ওই খেতাব দেওয়ার ৪৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমেদের খেতাব কেড়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা ব্যক্তিরা।
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘটনার জন্ম দেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দুই নেতা শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসির মামুন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অধিপতি মতামতের বাইরেও অনেক ভিন্নমত রয়েছে। এর মধ্যে একদল মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন রণাঙ্গনে উপস্থিত ও অনুপস্থিত লোকদের অবদানে পার্থক্য রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ সিরাজ সিকদারের অনুসারীরা যুদ্ধকালীন ভারতের সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করে এর সমালোচনাও করেন।
অধিপতি মতের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি শহীদ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
দুই পক্ষের দুই মত নিয়ে প্রায় সময়েই তুমুল বিতণ্ড চলে, যা কোনো কোনো সময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
কিন্তু স্বাধীনতার বিরোধিতা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্নমতগুলোকে একাকার করে ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার’ নামক তত্ত্ব দিতে গিয়ে শাহরিয়ার কবির যা করেছেন তা তুলনারহিত ব্যাপার।
তিনি বলছেন, “কোনো মুক্তিযোদ্ধাও যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্বীকার করেন তাহলে তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, ভাতা বন্ধ এবং খেতাব থাকলে তা কেড়ে নেওয়া হবে।”
তবে শাহরিয়ার কবিরের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় জেরাকালে তার মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে কথা ওঠেছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় জড়িত শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ শফির স্ত্রী শহীদজায়া ও শহীদভগ্নি বেগম মুশতারি শফির লেখা “চিঠি জাহানারা ইমামকে” বইয়ে দাবি করা হয়েছে, শাহরিয়ার কবির একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতেন। মুশতারি শফির এই বইটি প্রকাশের পর অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও শাহরিয়ারে ভূমিকা নিয়ে লেখা তথ্যটি প্রত্যাহার করা হয়নি।
তারপরেও শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে শাহরিয়ার কবির মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমেদের খেতাব কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলেন।
অলি আহমেদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতর অভিযোগ সম্পর্কে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির বলেন, “এই বিষয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে, এ বিষয়ে আমরা আগেও বলেছি, কোনো খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যদি ‘অস্বীকার অপরাধ আইন’র অধীনে অপরাধ করে, তাদের খেতাব কেড়ে নেওয়া হবে।”
শাহরিয়ার বলেন, “খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে এটা আরও বড় অপরাধ বলে আমরা মনে করি। আইনে যে বিচার ও শাস্তির কথা থাকবে সেটাতো হবেই। সাথে সাথে খেতাব কেড়ে নিতে হবে।”
কিন্তু অলি আহমদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকারের অভিযোগটি হলো, সম্প্রতি একটি টকশোতে তিনি বলেছেন ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। বরং ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমদের এই বক্তব্যকে অপরাধ দাবি করে মু্ক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা পাশ (ডান্ডিকার্ড) গ্রহণ করে নিরাপদে থাকা মুনতাসির মামুন বলেন, “কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি এই ধরনের অপরাধ করেন, তাহলে তার ভাতা বন্ধ করতে হবে। তাকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারব না।”
একই সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের সদ্য বিদায়ী বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ধৃষ্টতা দেখিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যা দেন।
শামসুদ্দিন বলেন, “শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি নেত্রী যে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন, তাতে আমি বিস্মিত হইনি। কারণ আগাগোড়াই তিনি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন; যেমনটি ছিলেন তার স্বামী জিয়াউর রহমান।”
সংবাদ সম্মেলনে একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন’ প্রণয়নসহ আট দফা দাবি জানায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
আট দফা দাবি হলো, “মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন, মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ আইন প্রণয়ন; যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দল ও বাহিনী হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, শান্তি কমিটি, রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও মুজাহিদের বিচার; মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্প্রত্তি বাজেয়াপ্ত, বাংলাদেশের গণহত্যার ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ, একাত্তরের যেসব যুদ্ধশিশু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহী তাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণা প্রদান”।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উত্থাপন করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রমুখ।
Moin Ahmed liked this on Facebook.
Laltu Hossain liked this on Facebook.
MD Uzzol Baruniya liked this on Facebook.
Rizwan Mahmud liked this on Facebook.