১৯৭১ সনের ২রা ডিসেম্বর থেকে ১৬/১৭ ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবািহনী বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসির হস্তক্ষেপ করে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারাই সামনের সারিতে যুদ্ধ করেছে, অকাতরে শহীদ হয়েছে,পঙ্গু এবং আহত হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী পেছন পেছন অগ্রসর হয়েছে। তবে এই চৌদ্দ দিনের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আনুমানিক ১২ থেকে ১৪ হাজার সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। তাদের এই প্রাণ হারানো সাথর্ক হয়েছে কি? কার স্বার্থে ১৪ হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রাণ বিসজর্ন দিলো? বাংলাদেশের স্বার্থে? কিসের টানে?
না। একটি ‘মার্সিনারি আর্মির’ সদস্যদের কোন স্বার্থ নেই, থাকেত পারে না। তারা কেবল প্রাণ দেয় স্বার্থাণ্বেষী মহলের নির্দেশে, কোন প্রাণের টানে নয়। জীবন তাদের কাছেও প্রিয়। কিন্তু তবু তা তাদের কাছে তুচ্ছ, যেহেতু তারা বেতনভুক্ত কর্মচারী। বেতনভুকেদর কোন আপন ইচেছ নেই। তারা কেবল প্রভুর ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাতে বাধ্য থাকে। ভারতীয় সেনাবািহনীর সাধারণ সদস্যসহ নিম্নপদধারীরা ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে কেবল। বাংলাদেশের কোন খালে, কোন বিলে ভারতীয় বাহিনীর কোন সদস্যের লাশ ভেসে গেছে সে ইতিহাস কেউ কোনদিন লিখবেনা।
তবে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে ভারতীয় সেনাপতি জেনারেল জগোজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানী সেনাপতি জেনারেল নিয়াজী যে আত্মসমর্পন করেছে, সে ইতিহাস চিরযুগই অম্লান হয়ে থাকবে। বেতনভুকদের ইতিহাস লেখা হয় না, তারা ইতিহাস নয়, তারা ইতিহাসের খোরাক মাত্র।
ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সন। বাংলােদেশর মুক্তিযুদ্ধের আনুমানিক অবসানের দিন। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ভারতের পূর্ব অঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন করে। যে যুদ্ধ বাঙালীর সশস্ত্র গণবিস্ফোরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হয়, তার শেষ হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের কাছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর অধিনায়কের আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে।
হিসেব মিলছে না কেন? হিসেবের এই গরমিলের জন্যে দায়ী কে বা কারা? যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল যুদ্ধ শেষে পরাজিত শত্রুপক্ষ সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমপর্ন করল না কেন? পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে তো কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং মুক্তিকামী বাঙালী জনগনের মধ্যে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের হেতুটা দেখা দিল কেন? কোন উদ্দেশ্যে?
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর কাছে পাকিস্তানের পরাজিত জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পন করলেন না কেন? আত্মসমর্পনের সময় কর্নেল ওসমানী অনুপস্থিত ছিলেন কেন? আত্মসমর্পনের বেশ কয়েকিদন পর কর্নেল ওসমানী ঢাকায় এলেন কেন? এসময়কাল তিনি কোথায় ক্ষেপণ করেছেন? তিনি তাহলে সত্যিই কোলকাতায় বন্দী ছিলেন?
আজো বাঙলাদেশের জনমনে নানান প্রশ্নের ভীড় জমছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দেশবাসী আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা করছে। কিন্ত আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব এবং ভারতে অবস্থানরত প্রবাসী আওয়ামীলীগ নেতা এসকল প্রশ্নের জবাব দেয়ার আজ পর্যন্ত কোন তাগিদই বোধ করেনি। তাছাড়া আত্মসমর্পনের প্রায় এক সপ্তাহ পর প্রবাসী আওয়ামীলীগ সরকার বাঙলাদেশে ফিরে এসে বিনা প্রশ্নে গদিতে বসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কেন অনুপস্থিত ছিলেন না সে সত্যটি উদঘাটন করার জন্য আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের এই অসহায় মহানায়ক কর্নেল ওসমানীর কতোই না প্রশংসা। কেন এই মিছেমিছি প্রশংসা?
এর অন্তরালে কি রহস্য? রহস্য তো অবশ্যই রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ১৬ ই ডিসেম্বর, যাকে আমরা বিজয় দিবস হিসেবে অভিহিত করি, সেইদিন থেকেই বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। ১৬ ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিজয় দিবস’ এর পরিবর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে ইতিহাসে আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আসল উদ্দেশ্য হলো বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্বীকার করা এবং পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় ঘোষণা করা।
এই বিজয়ে বাঙলাদেশের মুক্তিপিপাসু জনগণ এবং মুক্তিযদ্ধারা ছিল নীরব দশর্ক। আওয়ামীলীগ নেতারা ছিল বিনয়ী তাবেদার এবং কর্নেল ওসমানী অসহায় বন্দি। এ যেন ছিল ভারতের বাঙলাদেশ বিজয় এবং আওয়ামীলীগ সরকার এই নব বিজিত ভারতভূমির যোগ্য লীজ গ্রহণকারী সত্তা। যেমন সত্তা তেমনই তার শত- আর যায় কোথায়!!
এতো গেলো ১৬ ই ডিসেম্বর সম্পর্কে কিছু কথা। অনুরূপভাবে ১৭ ই ডিসেম্বর তারিখ খুলনার সার্কিট হাউজ ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
নয় নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষ আমাকে একরকম জোর করেই পেছনের সারিতে ঠেলে দেয়। বার বার প্রচেষ্টা চালােনা সত্বেও আমাকে সামনে আসতেই দেয়া হলো না। আমার প্রতিপক্ষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দানবীর সিংকে দিয়েই সেই আত্মসমর্পনের নের্তৃত্ব বজায় রাখা হয় অথচ দানবীর সিংয়ের অধীনস্থ সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময়ই আমার বাহিনীর অনেক পেছনে অবস্থান করতো।
মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ ন’টি মাসের অসীম ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে রচিত বিজয়পর্ব এভাবেই ভারতীয় শাসকচক্র দ্বারা লুণ্ঠিত হয়ে যায়।
সংগ্রামী, লড়াকু বাঙালি জাতি প্রাণপণ যুদ্ধ করেও যেন বিজয়ী হতে পারলো না। পারলো কেবল অপরের করুণায় বিজয় বোধ দূর থেকে অনুভব করতে। বিজয়ের সরাসরি স্বাদ থেকে কেবল বাঙালী জাতি বঞ্চিত হলো না, বঞ্চিত হলো প্রকৃত স্বাধীনতা থেকেই।
সুতরাং সেই বঞ্চিতকারীদের কবল থেকে নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করার লক্ষ্যে আর একটি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধেরর প্রয়োজন কি এখনও রয়ে যায়নি?
উৎস:- ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’
লেখক- বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের নয় নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ.জলিল।
Wasi Khan liked this on Facebook.
Rizwan Mahmud liked this on Facebook.
MadZy Anik MoLlick liked this on Facebook.
probasnews24.com liked this on Facebook.
Asif Siddique liked this on Facebook.