আমির—নায়ক থেকে খলনায়ক : শোভা দে

ফরাসিরাই এমন মজা করে বলতে পারে, ‘শেখসে লা ফাম’। এর সরল-সোজা মানে দাঁড়ায় এমন, ‘কাঙ্ক্ষিত নারীকে খোঁজো’, এর অর্থ আপাতদৃষ্টিতে সরল হলেও এটা কিন্তু সবকিছুই ধারণ করে!

রামনাথ গণেকা অ্যাওয়ার্ডের রাতে আমির যখন দুটো স্পিকারই মুখের কাছে নিলেন, তখন কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিষয়টি হলো তাঁর বিবাহিত জীবন, আর সেখানে যে কিরণই হলেন ‘বস’, বিষয়টা এখন একেবারে অফিশিয়াল। এ ঘটনায় কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, কিরণও কিন্তু ফেঁসে গেছেন। একেবারে বাজে ধরনের কোনো একটি বলিউডি ফিল্মের চিত্রনাট্যের ভ্যাম্প (খলনায়িকা) হয়ে গেছেন কিরণ (যদিও ছবিটা তাঁর বা তাঁর স্বামীর নয়!)। কারণ আর কিছুই নয়, মিয়া-বিবির একান্ত বাতচিত ‘পাবলিক’ হয়ে গেছে, তাই! কাজটা করে বসেছেন আমির, হয়তো এটা নেহাতই মুখ ফসকে বলা একটা কথা ছিল। হুট করে বলা একটা কথা, যা আমিরের মতো মানুষের কাছ থেকে সচরাচর হয় না। তিনি হলেন এমনই একজন ‘বুদ্ধিবৃত্তিক অভিনেতা’, যিনি আগে থেকে ঠিক করে রাখা কথা ছাড়া কোনো কথাই বলেন না। বলিউডে তিনি অন্যতম ক্ষুরধার মস্তিষ্কের মানুষ, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র বিতর্ক নেই। অন্য দুই খানের মতো তিনি মোটেও ছটফটে নন, বরং একদম ঠান্ডা মেজাজের লোক। গড়ে তিনি বছরে ছবি করেন একখানা, কিন্তু সেই ছবিটি বক্স অফিসে এমন তুঙ্গে ওঠে যে সবাই তাজ্জব হয়ে বলতে থাকে, ‘বাপরে, আমির এমনটা পারে কীভাবে?’

উত্তরটা একেবারে সহজ, আমির দুর্দান্ত রকম স্মার্ট। সে ঝুঁকিটা নিতে জানে, জানে কখন কোথায় কীভাবে মোক্ষম মার দিতে হবে। সে খেলার কায়দা সময়মতো বদলে নেয়। প্রত্যাশার পারদটাও ঠিকমতো চড়ায়। সবকিছুকে তাঁর অনুকূলে নিতে জানে। বোদ্ধারা তাঁকে বলে নিখুঁত হিসাবি, ক্যালকুলেটিং। আমি মনে করি, সে অসম্ভব মেধাবী। মানুষের চিন্তাধারাই এমন যে, আমির কোনো একটা কিছু প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা এটাই বুঝিয়ে দেন যে আমির যে কারণে বা যেটার জন্যই জন্যই অবস্থান নেন না কেন, তা সঠিক। এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ারও তেমন দরকার নেই। তিনি এমন একজন অভিনেতা, যাঁর বোধবুদ্ধি সব সময়ই প্রখর, চালু। গরিব মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। মিশে যান সাধারণের সঙ্গে, তাদের কাছাকাছি যান। বেছে বেছে পণ্যের প্রচার করেন। ভারতের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চড়া লাভজনক রিয়্যালিটি শোতে তিনিও কান্নায় ভেঙে পড়েন। সত্যি, সত্যি, সত্যি!

এখানেই ফাটল বোমা!

একটা ‘আবেগী’ মন্তব্যের জন্য আমিরকে একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু এক মিনিট, মন্তব্যটা কি তাঁর ‘নিজের’? উঁহু, এটা তাঁর স্ত্রীর মন্তব্য। আমির কি বলেছিলেন যে তিনি স্ত্রীর মন্তব্যের সঙ্গে একমত? এমনটা কিন্তু আমরা জানি না! স্ত্রীর এই কথায় কি তিনি বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বা দেখাতে চেয়েছেন? হয়তো, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত পরিসীমায়। দেখুন, আমির কিন্তু চটপটে, স্মার্ট একটা লোক। তিনি হঠাৎই তাঁর স্ত্রীর কথার উদ্ধৃতি দেন… তিনি এভাবে বলেছিলেন যে, “কিরণ খুবই চিন্তিত ‘তাঁর’ (কিরণের!) পুত্রের নিরাপত্তা নিয়ে।” আমরা কিন্তু এটা জানি না যে আমির নিজেও তেমন শঙ্কিত কি না। আমির জানিয়েছেন যে দেশ ছেড়ে অন্য কোনোখানে চলে যাওয়ার চিন্তাটা কিরণের। খেয়াল করুন, কিরণের, আমিরের কিন্তু নয়! সকালবেলা পত্রিকার শিরোনাম পড়ে কিরণ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন, আমির কিন্তু নন! শঙ্কিত কিরণ, আমির নন। আমির একজন আদর্শ স্বামী, কিরণ ও তাঁর সম্পর্কটা শ্রদ্ধাবোধের এবং তাতে পারস্পরিক সমতা বজায় রাখা। তবে যাই হোক, চিন্তাভাবনার ব্যাপারটা কিন্তু কিরণই ঠেলে দিয়েছিলেন, আমির নন। আর এখন একদম ফেঁসে গেছেন যিনি, তিনি হলেন আমির খান!

আমি মনে করি, জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো পাবলিক প্লেসে আমির নাকাল হচ্ছেন, যে জায়গাটা তিনি নিজের করে নিতে জানেন। এই পা হড়কে যাওয়াটা রীতিমতো ঐতিহাসিক! শয়নকক্ষের কথা একেবারে বারোয়ারি আলাপে পরিণত হয়েছে, তার পর একেবারে হুড়মুড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনাই ঘটেছে।

বিষয়টা হচ্ছে, আমরা আমাদের সেলিব্রেটিদের ছেড়ে কথা বলি না। আমরা কখনোই ক্ষমা করি না এবং সবকিছুরই বিচার করে ছাড়ি। একটা ভুল স্টেপ নিয়েছ, ব্যস! তোমার খেল খতম বাছা!

প্রশ্ন হচ্ছে, কিরণ আসলে এই কথা বলে কী এমনই বোঝাতে চেয়েছিলেন যেমনটা ‘সবাই’ বুঝছে? এখনই কি তিনি তেমনটাই মনে করেন? তাঁদের কি এমন মনে হচ্ছে যে, তাঁদের দেয়ালে বা ঘরের একটা কোনায় পিঠ ঠেকে গেছে? তাদের কি মনে হচ্ছে যে, তাঁরা ক্ষমাটমা চাওয়ার চাপে রয়েছেন? আশা করি, তেমনটি নয়। এই পুরো বিষয়টা আসলে, খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমির নিশ্চয়ই নিজের কপাল চাপড়াচ্ছেন। তবে তাঁর ‘হিন্দু স্ত্রী’ এবং ‘হিন্দুর দেশে মুসলিম সুপারস্টার’ বিষয়টি আমাদের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতাই প্রকাশ করছে। আমি ট্রলগুলো পড়েছি এবং চূড়ান্ত নিম্নমানের টিপ্পনীগুলো দেখেছি। এই বিষাক্ত মন্তব্যগুলো কিন্তু বিষ বয়ে নিয়ে চলা মানুষগুলোকেই বারবার ইঙ্গিত করছে।

এটা কি ঠিক যে, যারা সরকারের কর্মকাণ্ড এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছেন, তাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া বা দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা বলা? সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কখনোই নয়। একজন তারকার কি এটা বলা খুবই অন্যায় যে তাঁর স্ত্রী, তাঁর পুত্রের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এবং দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও ভাবছেন?

মানুষজন পারলে যেন আমিরকে খুনই করে ফেলে! অবশ্য একদিক থেকে আমিরের কপাল ভালোই, নতুন ছবি রিলিজ পাবে কিছুদিন পর। আবারো সেটি নিয়ে বিতর্ক হবে, ছবিটি না দেখানোর জন্য প্রতিবাদ হবে, ছবিটি বয়কট করতে বলা হবে। এ ধরনের প্রতিবাদ হতে তো একেবারেই সময় লাগবে না। এটাও খুব লজ্জাজনক, যখন ইন্ডাস্ট্রির বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীরাও নিজেদের রাজনৈতিক মতামত দিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে লড়াইয়ে লেগে যান, অন্যকে আক্রমণ করেন কদর্যভাবে, তাও একেবারে জনপরিসরে।

শঙ্কা প্রকাশের অধিকার সব নাগরিকেরই রয়েছে। এটাই ভাবছি যে আমিরের এই মন্তব্যটা যদি রাম-শ্যাম, যদু-মধু বা অরুণ খান্না টাইপ নামের কেউ করত, তাহলে এর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারত? তাহলে কি প্রতিক্রিয়া একটু ‘কম ভয়ংকর’ হতো?

আহা আমির! হিরো নাম্বার ওয়ান থেকে ভিলেন নাম্বার ওয়ান! এক রাতেই!

তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যাপারে ভরসা রাখতে পারেন। তিনি এ সুযোগটাকেও ঠিকই কায়দামতো নিজের কব্জায় নিতে পারবেন। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ জমজমাট বলেই মনে হচ্ছে। আমির খান আর নরেন্দ্র মোদি যেন ‘রোডিজ’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন। কী দারুণই একটা আইডিয়া, স্যার-জি!

২ thoughts on “আমির—নায়ক থেকে খলনায়ক : শোভা দে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *