২৮৬ পুলিশ পরিবারে কষ্টের দিনরাত

দিনরাত পরিশ্রমে তাঁরা রক্ষা করেছেন জনগণের জানমাল। দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই মৃত্যু ঘটেছে তাঁদের। সেই সব পুলিশ সদস্যের পরিবার কাটাচ্ছে কষ্টের দিনরাত। অর্থকষ্টের চেয়েও বেশি পীড়া দেয় তাঁদের খুনিদের শাস্তি না পাওয়া। গত তিন বছরে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় নিহত ২৮৬ জন পুলিশ সদস্যের পরিবারে প্রায় অভিন্ন কষ্টের কাহিনী। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রকম ১৪টি পুলিশ পরিবারকে দেওয়া হয় আর্থিক সহায়তা। সেখানে উপস্থিতদের চোখেমুখে ছিল এ বেদনার স্পষ্ট চিহ্ন। এইসময় নিজেদের বিপন্নতার কথা জানিয়েছে অনেক পরিবার।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘দেশের মানুষের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা মারা যাচ্ছেন। একজন পুলিশ সদস্য মারা যাচ্ছেন আর তাঁর পরিবারে নেমে আসছে অভাব-অনটন। স্বজন হারানোর বেদনা অত্যন্ত কষ্টের। তাঁদের পরিবারকে সার্বক্ষণিক সচ্ছল রাখতে আমরা চেষ্টা করছি। তাঁরা যে আত্মত্যাগ করেছেন তা অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের। পুলিশ হত্যা মামলাগুলোর দ্রুত তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিতে বলা হয়েছে। নিহতের স্বজনদের পুলিশে চাকরি দেওয়া হবে। এ নিয়ে যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয় সেদিকেও নজর দেওয়া হবে।’

গত ৫ অক্টোবর পাবনায় পাকশী পুলিশ ফাঁড়ির সদস্য এটিএসআই সুজাউল ইসলামকে জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহতের স্ত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দিতে গিয়েই আমার স্বামীকে হারাতে হয়েছে। একমাত্র সন্তান শাহরিয়ার নাজমিনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়েছে। তার পড়ালেখার খরচ জোগাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। শাহরিয়ার পাবনায় একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সন্তানকে পুলিশের চাকরিতে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ভয় লাগে, যদি বাবার মতো অবস্থা হয়।’ এ কথা বলেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে প্রায় প্রতিটি পরিবার পড়েছে আর্থিক সংকটে। আর যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন তাঁদের পরিবার সন্দিহান, আদৌ খুনিরা শাস্তি পাবে কি না। ঢাকার গাবতলীতে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত এএসআই ইব্রাহিম মোল্লার স্ত্রী খায়রুন নেছা বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুতে পরিবারের সবাই দিশাহারা, দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। পুলিশ সদর দপ্তর যে আর্থিক অনুদান দিয়েছে, তা দিয়ে হয়তো বছরখানেক চলা যাবে। এরপর কী হবে?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, ‘হত্যাকারীদের বিচার হলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাব। কিন্তু তা কি এ জীবনে দেখে যেতে পারব?’

৪ নভেম্বর আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল মুকুল হোসেনের বাবা সহিদুল

ইসলাম বলেন, ‘সন্তান হারানো কী যে বেদনার, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এখন কিভাবে পরিবার চলবে, বুঝতে পারছি না। বড় ছেলে জিসান রংপুর কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ে। তাকে যদি পুলিশে একটি চাকরি দেওয়া যায় তাহলে সংসারের অভাব-অনটন কিছুটা কমবে।’

২০১৩ সালে ঢাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় মারা যান কনস্টেবল আজিজুর রহমান। তাঁর স্ত্রী আসলামা হাবিবা বলেন, ‘সরকার যে অর্থ সহায়তা দিয়েছে, তা প্রায় খরচ হয়ে গেছে। এখন অর্থের অভাবে সন্তানদের নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আর বিচার নিয়ে তো দিন দিন হতাশা বাড়ছে। প্রকৃত ঘাতক এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। এমনকি মামলার চার্জশিট পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।’

রাজশাহীতে নিহত কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকারের বাবা বিমল সরকার বলেন, ‘অভাব-অনটনে সংসার চলছে। সন্তানের বেতনের টাকায় আমার সংসার চলত। সরকারের সহায়তা পেয়েছে তার স্ত্রী। আমার খবর নেয়নি কেউ।’

ঢাকার বাংলামোটরে বোমা হামলায় নিহত কনস্টেবল ফেরদৌসের স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘অর্র্থের অভাবে তিন সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।’ এ রকম প্রায় অভিন্ন কাহিনী নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারগুলোতে। আগামী দিনগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতাসহ নানা দুর্ঘটনায় নিহত হন ১০৯ পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে শুধু রাজনৈতিক হামলায় মারা যান ১৭ জন। ২০১৪ সালে বিভিন্ন ঘটনায় মারা যান ১২০ জন। আর চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ৫৭ জন পুলিশ সদস্য। এসব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে দঃখ-বেদনার অন্য রকম চিত্র। যদিও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করছেন পুলিশ পরিবারের সদস্য বিবেচনায় সব সংকটে সহযোগিতার। কিন্তু তাতেও থামছে না তাদের কান্না।

৮ thoughts on “২৮৬ পুলিশ পরিবারে কষ্টের দিনরাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *