জনতার উচ্ছ্বাসে ভাসলেন অনুপ চেটিয়া

কাছে যে নিজের পরিচয় দিতে হবে ভাবতেই পারেননি মণিকা বরা  চেটিয়া। পরে দু’জনই হেসে ফেলেন।
জ্ঞান হওয়ার পরে এই প্রথম বাবাকে দেখল ২২ বছরের জুমন। এতদিন নিজেকে কারাবন্দি ব্যক্তির সন্তান হিসেবেই দেখে এসেছে সে। আজ বিমানবন্দর থেকে আদালত অবধি বাবাকে ঘিরে সংবাদমাধ্যম ও আমজনতার যে উচ্ছাস চাক্ষুষ করল তা দেখে তিনি অবাক।
নিজেও ১৮ বছর জেলে ছিলেন। এত দিন পরে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হাজির হন গুয়াহাটির সিজেএম আদালতে। এজলাসে তোলার আগে অনুপকে  দেখে জড়িয়ে ধরলেন উলফার সহ-সভাপতি প্রদীপ গগৈ। কুশল বিনিময়ের পরে অনুপের সামনের ফোকলা দাঁত আর বেড়ে যাওয়া বয়স নিয়ে কিঞ্চিত হাসি-ঠাট্টা হল।
দীর্ঘ ২৪ বছর পরে আজ অসমে পা রাখলেন উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া। ১১ই নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ  চেটিয়ার দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়। ১২ই নভেম্বর দিল্লির বিশেষ সিবিআই আদালত তাকে ৬ দিনের ট্রানজিট রিম্যান্ড দেয়। চেটিয়া আসবেন  জেনে গতকাল সকাল থেকেই তার স্ত্রী-পুত্র, এমন কী পুলিশকর্তারাও গুয়াহাটি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বিকেল অবধি তিনি আসেননি। পরে উলফার তরফে জানানো হয় ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে যাত্রীবিমানে আনতে সমস্যা হয়েছিল।
আজ বিএসএফের বিশেষ বিমানে চেটিয়াকে গুয়াহাটি আনা হয়। বিমানবন্দরের পিছনের ভিআইপি দরজা দিয়ে ৫টি গাড়ির কনভয় চেটিয়াকে নিয়ে সিজেএম আদালতে রওনা হয়। বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করেও বিমানবন্দরে তার দেখা পাননি মণিকাদেবী ও উলফা নেতারা।

বেলা ১০টা ৪০ মিনিটে নীল জামা, কালো প্যান্ট আর লালচে চুলের চেটিয়াকে নিয়ে কনভয় সোজা ঢুকে যায় আদালত চত্বরে। সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে বিচারক সঙ্গীতা হালৈয়ের এজলাসে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানেই প্রদীববাবু, উলফার বিদেশ সচিব শশধর চৌধুরি, অর্থ সচিব চিত্রবন হাজরিকা, সহ  সেনাধ্যক্ষ রাজু বরুয়া, নেতা প্রাণজিৎ শইকিয়া এবং মণিকাদেবী চেটিয়ার সঙ্গে কথা বলেন।
বাইরে এসে প্রদীপবাবু জানান, শরীরের বয়স বাড়লেও অনুপ মনের দিক থেকে একইরকম শক্ত আছেন। তার কথায়, ‘২৪ নভেম্বর উলফার সঙ্গে কেন্দ্রের শান্তি আলোচনা রয়েছে। আশা করি অনুপও বৈঠকে থাকবে। অনুপকে দেখার জন্য এই জনসমদ্র প্রমাণ করে দিল উলফা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।’ কিন্তু, আত্মসমর্পণকারী উলফার একাংশ দাবি করেছে, পরেশ বরুয়াকে না ফেরাতে পারলে আলোচনা অর্থহীন।
সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, চেটিয়ার সঙ্গে কারাগার থেকেই পরেশ বরুয়া ও দৃষ্টি রাজখোয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তবে কী পরেশকে ফেরাতে অনুপকে কাজে লাগাবে উলফা? প্রদীপবাবু বলেন, ‘এত কথা হয়নি। অনুপ অবিভক্ত উলফার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং আছেন। তিনি জনতার সামনে আসতে চান। অংশ নিতে চান শান্তি আলোচনায়।’
পৌনে দু’টো নাগাদ বেরিয়ে আসেন চেটিয়া। অপেক্ষমান জনতার দিকে হাত  নেড়ে হাসতেই সিবিআই অফিসারেরা দ্রুত, মাথা চেপে তাকে গাড়িতে ঢুকিয়ে  দেন। এনএসজি কম্যান্ডোরা কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেননি। চেটিয়াকে বিমানে  ফের দিল্লি নিয়ে যায় সিবিআই।
১৯৮৬ সালের হত্যার ঘটনা নিয়ে ১৯৮৮ সালে একটি মামলা দায়ের করেছিল সিবিআই। আজ ওই মামলায় সিবিআইয়ের আইনজীবি ১৪ দিনের জন্য  চেটিয়াকে হেফাজতে চান। চেটিয়ার আইনজীবি বিজন মহাজন দাবি করেন, ২০০৬ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছিল সিবিআই। এত বছর পরে ওই মামলায় চেটিয়াকে আটকে রাখা অযৌক্তিক। দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে বিচারক চেটিয়াকে পাঁচ দিনের জন্য সিবিআইয়ের হেফাজতে দেন। আরও বলেন, অনুপবাবু অসুস্থ। তাই প্রতিদিন তার ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। ভাল খাদ্য দিতে হবে।
অনুপ চেটিয়ার মুক্তির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ সাংবাদিকদের বলেন, ‘অন্যান্য আলোচনাপন্থী নেতার মতো আলোচনার স্বার্থে তাকেও ছাড় দেওয়া যেতে পারে। তবে এটি আদালতের বিচারাধীন বিষয়।’
সন্ধ্যায় পরেশ বরুয়া সংবাদমাধ্যমে ফোন করে বলেন, ‘অনুপ ঘরের মাটিতে  ফেরায় আমরাও খুশি। ওঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।’ কিন্তু উলফা সূত্রে খবর ছিল,  চেটিয়াকে ভারতে ফিরতে নিষেধ করেছিলেন পরেশ। চেটিয়া নিষেধ না শোনায় তিনি অসন্তুষ্ট। পরেশ বলেন, ‘উলফায় অনুপের অবদান পর্বতসম। আমরা সকলেই ওঁকে শ্রদ্ধা করি।’ চেটিয়া নিজে তাকে শান্তি আলোচনায় ডাকলে তিনি কি আসবেন? পরেশ বলেন, ‘আমরা কখনওই আলোচনা বা শান্তির বিপক্ষে নই। তবে আমাদের দাবি একটাই। স্বাধীন অসম। সেই দাবি মেনে নিয়ে ভারত যদি সসম্মানে আলোচনার আহ্বান জানায় তবে অবশ্যই ভেবে দেখব। এখন চেটিয়া শত্রু শিবিরে। আগে তিনি মুক্তি পান। সুস্থ হোন। এই সব বিষয় পরে ভাবা যাবে।’
সূত্র: আনন্দবাজার

৯ thoughts on “জনতার উচ্ছ্বাসে ভাসলেন অনুপ চেটিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *