সাকার যত ফাঁকা বুলি…

ঢাকা: অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যাসহ হত্যা-গণহত্যার দায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

একইসঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সাকা চৌধুরীর আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

এর আগে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এই নেতার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, দম্ভোক্তি ও বিদ্রূপাত্মক অঙ্গভঙ্গির কারণে বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন। বিচার চলাকালে অশালীন আচরণ করে বিতর্কিত হয়েছেন, যা বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। প্রচার হয়েছে টিভিতেও। গুগলে সার্চ দিলে যে কেউ পেতে পারেন সাকার রসালো উক্তি!

একবার তার একটি বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে আলোচিত-সমালোচিত হয়। চার সেকেন্ডের ওই ফুটেজে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সালাউদ্দিন কাদেরকে বলতে শোনা যায়, ‘এই যুদ্ধাপরাধ? কিচ্ছু করতে পারবে না, একটা রিটে পট করে চলে যাবে।’

বিভিন্ন সময় বিচারকক্ষে আদালতের পদ্ধতি নিয়ে নানা ধরনের অসম্মানজনক আচরণ করতে দেখা গেছে সাকাকে। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায়ের পর বিচারকদের প্রতি অশালীন মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হন সাকা চৌধুরী। ৩০ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে প্রথমবারের মতো সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এরপর থেকে পৌনে তিন বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে এবং রায়ের দিন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, প্রসিকিউটরদের হুমকি, আসামির কাঠগড়ায় বসে পড়া, সাক্ষী ও চলমান রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা, আইনজীবীকে বাদ দিয়ে নিজেই মামলা পরিচালনা করাসহ এজলাসে বহু নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।

ফেসবুকে এখনও তার ‘ধর্ষণ যখন নিশ্চিত তখন তা উপভোগ করাই শ্রেয়’ এই কথাটি খুব ব্যবহৃত হয়। অনেকে ব্যঙ্গ করে তাকেও এ কথা বলেন। একবার সংসদে তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, আমি তো চো… হয়ে গেলাম।’ স্পিকার অশ্লীল কথা বলতে নিষেধ করলে তিনি জবাব দেন, ‘আমি আবারও চো… হয়ে গেলাম।’

নেতা সম্পর্কে একবার তিনি বলেন, ‘আমরা নেতা হইছি বইলা এমন না যে নিজের পায়জামার ফিতা খুইল্লা জনগণের মশারি বাইন্ধা দিমু।’

২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ শুনানি চলাকালে এজলাস কক্ষেই প্রকাশ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলকে হুমকি দেন সাকা চৌধুরী। কখনও সিনেমার ভিলেনের মতো অট্টহাসিতে পুরো ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষ কাঁপিয়েছেন, কখনও প্রসিকিউটরদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছেন, কখনও খোদ বিচারপতিদেরও হুমকি-ধমকি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ঘরে-বাইরে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য কুখ্যাত সাকা চৌধুরী। বারবারই বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন তিনি।

বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে হুমকি দিয়ে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘চোখ রাঙাবেন না। আমি রাজাকার। আমার বাপ রাজাকার। এখন কে কী করতে পারেন করেন।’

২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না। অনেক আইন আমি করেছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন আমার করা। আপনি তো আমার করা এ আইন পড়েও দেখেননি।’

২০১৩ সালের ১৭ জুন নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমাকে ফাঁসি তো আপনারা দেবেনই, কিন্তু আমি পরোয়া করি না।’ ওইদিন, এমনকি সাক্ষ্য দেওয়া শুরুর আগে আইন অনুসারে শপথ নিতেও অস্বীকার করেন সাকা। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমি একজন সংসদ সদস্য। আমি কেন এখানে শপথ নেব?’ পরে শপথ ছাড়াই সাক্ষ্য দিতে শুরু করেন সাকা চৌধুরী।

ট্রাইব্যুনালে স্কাইপি কথোপকথন বিষয়ে চেয়ারম্যান, অপর দুই বিচারপতি এবং প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমকে নিয়ে অবমাননা ও মানহানিকর নানা আবেদন করেন সাকা চৌধুরী। বিভিন্ন সময়ে প্রসিকিউটরদের হেয় করে কথা বলেছেন তিনি। প্রসিকিউটরকে বলেছেন, ‘পার্সিকিউটর’।

ট্রাইব্যুনালে নয় দিনের সাফাই সাক্ষ্যের পুরোটাই ইংরেজিতে দেন সাকা চৌধুরী। এর সপক্ষে নিজেকে বাঙালি নয়, চাটগাঁইয়া বলে দাবি করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘আপনি বাংলায় সাক্ষ্য দিলে এত সময় লাগত না। তার চেয়েও বেশি কথা বলতে পারতেন।’ জবাবে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমি বাংলায় সাক্ষ্য দিতে পারব না, ইংরেজিতেই দেব। কারণ, আমি বাঙালি না, চাটগাঁইয়া। বাংলায় তো আমি ভালো বলতে পারতাম না। টেকনিক্যাল প্রবলেম হতো।’ এ সময় ভাষার প্রতি চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলে ওঠেন, ‘আমার মাতৃভাষা বাংলা নয়, চাটগাঁইয়া।’

২০১৩ সালের ১ অক্টোবর রায়ের দিন সাকা বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে লাখ লাখ লোকের রায় দিলাম। এখন রায়ের জন্য এখানে বসে থাকতে হবে। নির্বাচন না করতে দেওয়ার জন্য এত কষ্ট।’ এরপর তার মন্তব্য, ‘আমার কবিরা গুনাহ হলো বিএনপিতে যোগ দেওয়া।’

রায়ের দিন সাকা আরও মন্তব্য করেন, ‘দিয়ে দাও ফাঁসি তাড়াতাড়ি। সাঈদী সাহেবের মতো লোককে ফাঁসি দিছো, আর আমি তো বড় গুনাহগার।’

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বিষয়ে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমি গ্রেনেড মারলে সেটা তো মিস হত না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ইঙ্গিত করেও তিনি নানা কটূক্তি করেন। বলেন, ‘আঙ্গুল দেখাবেন না, ওই আঙ্গুলে রিং পরানোর কথা ছিল।’

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘পঞ্চম সংশোধনীর কথা আর কী বলব? সোনা মিয়ারে বানাইসে লাল মিয়া আর লাল মিয়ারে বানাইসে সোনা মিয়া। মিয়া কিন্তু ঠিকই আছে। সোনাডা খালি লাল হইয়া গেছে।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি একবার বলেন, ‘ছাত্রজীবনে শেখ মুজিব আমার বাবার শিষ্য ছিলেন।’ এমনকি জাতির পিতাকে নিয়ে অশ্লীল কথা বলতেও পিছ পা হননি তিনি। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এত বেশি স্বপ্ন দেখতেন যে মনে হয় উনার স্বপ্নদোষ আছিল’।

দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তিনি কটূক্তি করেন, ‘সুশীল আবার কী। সু মানে সুন্দর আর শীল মানে নাপিত, তা হলে সুশীল মানে সুন্দর নাপিত’।

তার উক্তি নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশের সচেতন মহল ও সামাজিক মিডিয়াগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কিন্তু এসবের থোড়াই কেয়ার করতেন তিনি। সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেন, ‘আপনারা আমার সমালোচনা করেন তাতে তো আমি আপত্তি করি না। এটা হচ্ছে হাঁসের গায়ে পানি ছিটানোর মতো। ঝাঁকি দিলে এ পানি পড়ে যাবে।’

বুধবার রিভিউ পুনর্বিবেচনার রায়ের মধ্য দিয়ে শেষ হলো সাকা চৌধুরীর মামলার আইনি লড়াই। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকরের বিষয়টিও চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাল। সর্বশেষ ধাপে এখন কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন তিনি। প্রাণভিক্ষা না চাইলে বা চাওয়ার পর আবেদন নাকচ হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আর কোনো বাধা থাকবে না।

আইন অনুসারে তখন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে যেকোনো সময় তার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ।

৮ thoughts on “সাকার যত ফাঁকা বুলি…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *