ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
আজ ১০ নভেম্বর। ১৯৮৭’র এই দিনে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আত্মদান করেন শহীদ নূর হোসেন। প্রতি বছর জাতীয় পার্টি (এরশাদ) বাদে প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গণতন্ত্রের জিকির তুলে দিবসটি পালন করে। আজকেও হয়তো এর কোনো ব্যত্যয় হবে না। ফুলে ফুলে ভরে যাবে শহীদ নূর হোসেন চত্বর। কিন্তু তাতে কি নূর হোসেনের আত্মা শান্তি পাবে, না আমাদের মতো বিশ্বাসঘাতকদের ফুলে আরো বেশি কষ্ট পাবে?
আজ এমন এক সময়ে শহীদ নূর হোসেন দিবস পালিত হচ্ছে যখন দেশ ও দেশের মানুষ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশ স্বাধীনের পর এমন পরিস্থিতি আর কখনও দেশবাসী মোকাবেলা করেছে বলে আমার জানা নেই। সবাই আজ এক অজানা আতঙ্কে, কেউ নিরাপদে নেই। এমন কি বিদেশীরাও নয়। শুধু তাই নয়, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার পথে!
সবচেয়ে উদ্বেগ, আজ যখন শহীদ নুর হোসেন দিবস পালিত হচ্ছে তখন আমরা ২৮ বছর আগেকার সেই স্বৈরাচারকে পাশে রেখে এক বিরল ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চ গড়েছি। করছি নূর হোসেনের রক্তের সাথে বেঈমানী। এমন জাতি পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যারা শহীদদের আত্মার সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। যারা শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে সব নীতি আদর্শকে বিসর্জন দিতে পারে। জানিনা, জাতির জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জাস্কর বিষয় আর কি হতে পারে? সেই জাতির একজন হতভাগা নাগরিক হিসেবে যে মর্মবেদনায় ভুগছি সেটা কিছুটা লাঘব এবং শহীদ নূর হোসেনের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই মূলত আজ আমার এই দু’কলম লেখা।
আজ যখন ৮৭’ কেও হার মানিয়ে সর্বত্রই জনগণের বাকরুদ্ধে নানা কৌশল চলছে তখন আমার এই লেখাটুকু প্রকাশ করতে কোনো পত্রিকা প্রকাশে সাহস দেখাবেন কিনা তাও জানিনা। এরপরও লিখছি। এইত ক’দিন আগে ‘দুলাভাই এখন হাসে, স্বপ্নও দেখে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে জাতির রাজনৈতিক দৈন্যতার কথা তুলে ধরেছিলাম। নূর হোসেন, যিনি স্বৈরাচার এরশাদের পতন আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মত্যাগে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। বাংলার এই সাহসী সন্তান সেদিন রাজপথে স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়েছিলেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ বুকে পিঠে এই স্লোগানে।
আজও স্মরণে আছে সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর, স্বৈরশাসক এরশাদের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ৫, ৭ ও ৮ দলীয় জোটের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী পালিত হয়। এদিন উত্তাল রাজপথে পুলিশের গুলিতে জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন নূর হোসেন, যুবলীগ নেতা নুরুল হুদা বাবুল ও বাজিতপুরের শ্রমিক আমিনুল হুদা টিটোও। তাদের এই আত্মত্যাগে সেদিন তিন জোটের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো অপ্রতিরোধ্য হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বর এরশাদের আট বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। সেই থেকে নূর হোসেন এবং তাঁর শ্লোগান সব গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক।
কিন্তু ২৮ বছর পর বাস্তবে আমরা কী দেখছি, যে স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য নূর হোসেন আত্মত্যাগ করলেন, আজ তার সাথেই ক্ষমতার আঁতাত রাজনৈতিক দলগুলোর। এক্ষেত্রে কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি, কী জামায়াত সবাই যেন এক। এছাড়া ২৮ বছর পর আজ সেই স্বৈরাচার এরশাদের মুখে যখন গণতন্ত্রের কথা শুনি তখন লজ্জায় মাথা নত হয়, কিন্তু রাজনীতিবিদদের যেন কোনো অনুভূতিই নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে বসে গণতন্ত্রের জিকির তুলছে সেই স্বৈরাচার এরশাদ। শুধু তাই নয়, এরশাদ এখন মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত তথা দেশের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম একজনও বটে। তার দল হয়েছে (পুতুল নাচের খেলা ঘরের ন্যায়)সংসদের প্রধান বিরোধীদল, তাঁর সহধর্মিনী হয়েছেন বিরোধী দলীয় নেত্রী। শুধু তাই নয়, সরকারের মন্ত্রীসভারও সদস্য হয়েছেন তার দলের কয়েকজন নেতা। কী সৌভাগ্য! সরকারের সাথে কী মধুর সম্পর্ক! কী অভিনব গণতন্ত্র!
ফলে শুধু স্বৈরশাসক হিসেবেই নয়, রাজনৈতিক দাবাড়ু, বহুবিবাহ, অসংখ্য সুন্দরী নারীর প্রেমিকাসহ নানা ঘটনায় দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এমন ‘সৌভাগ্যবান’ ব্যাক্তি খুজে পাওয়া দুষ্কর। কেননা, এদেশের কোনো নেতা বহুগামিতা নিয়ে রাজনীতিতে এমন সংযোজন-বিয়োগের দ্বিতীয় নজির তার মতো আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এ লজ্জা লুকাবো কোথায়? আমাদের প্রশ্ন- ক্ষমতাই যদি তোমাদের মূল লক্ষ্য হয়, তবে সেদিন নূর হোসেন, বাবুল ও আমিনুলকে কেনইবা জীবন দিতে হলো? আর কেনইবা তোমরা আজ নূর হোসেন দিবস পালন করো? এটা কী তাদের মৃত আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়? এভাবে আমরা শহীদদের সাথে আর কত প্রতারণা করবো?
নূর হোসেনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: পৈত্রিক বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ঝাতবুনিয়া গ্রামে। ১৯৭১’র পর পরিবার ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রামে চলে আসে। পিতা মুজিবুর রহমান পেশায় ছিলেন আটো-রিকশা চালক। মা মরিয়ম বিবি। অসচ্ছলতায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর নূর হোসেন বাসের সুপারভাইজর হিসেবে কাজ করেন। তারুণ্যে পা দিয়েই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ঢাকা মহানগর আ’লীগের বনগ্রাম ইউনিটের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তার বুকে ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে আ’লীগের নেতৃত্বাধীন ৫ দলীয় ঐক্যজোটের মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি রাজধানীর জিরো পয়েন্টে পৌঁছলে একটি বুলেট এসে নূর হোসেনের বুকে বিদ্ধ হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
পরে নূর হোসেনসহ অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের পথ বেয়ে স্বৈরাচারের পতনকে ত্বরানিত্ব করে দেশে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের শহীদী আত্মদান আন্দোলনকারীদের প্রাণে বিপুল শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল। শহীদ নূর হোসেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। এই আন্দোলনের জোয়ারে নব্বইয়ের শেষ দিকে ভেসে যায় স্বৈরাচার এরশাদের তক্তপোশ। এরপর থেকে প্রতিবছর ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এছাড়া যেখানে গুলিবিদ্ধ হন, সেই জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয় নূর হোসেন স্কয়ার। ১০ নভেম্বর তার মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তোলা তার গায়ে লেখাযুক্ত আন্দোলনরত অবস্থার ছবিটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এই দিনে আমরা তো কত কর্মসূচীই পালন করি। কিন্তু আমরা কী সেই শহীদ পরিবারের খোঁজ রাখি তারা কেমন আছেন?
আজ শহীদ নূর হোসেনের ২৮তম মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। সেই সাথে বাবুল ও আমিনুলের প্রতিও বিনীত শ্রদ্ধা। শহীদদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা। তাদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে একদিন এই এদেশে মুক্ত গণতন্ত্র আসবে এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এই প্রত্যাশায় রইলাম।
সবশেষে, হে নূর হোসেন, সেইদিন যারা তোমার রক্তের উপর ভর করে গণতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করেছিল, তোমাকে নিজেদের কর্মী হিসেবে দাবি করেছিল, আজ তোমার সেই নেত্রীর নেতৃত্বেই সহযোদ্ধারা তোমার ঘাতক স্বৈরাচারের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে দেশে গড়ে এক অভিনব শাসন। ক্ষমতা মসনদ টিকিয়ে রাখতে গণতান্ত্রিকামীদের উপর চলছে সীমাহীন অত্যাচার, নির্যাতন, মামলা-হামলা। দেশের জনগণ আজ দিশেহারা। দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব খুবই হুমকির মুখে। দেশের আজ জনগণ কী করবে?
হে আমার ভাই শহীদ নুর হোসেন; তোমার মত গণতন্ত্র ও মানুষের মুক্তির জন্য রক্ত দিয়েছেন শহীদ ডাঃ মিলন, উনসত্তরে জীবন দিয়েছেন ড. শামসুজ্জোহা আরো অনেকে। ভাষা আন্দোলনে রক্ত দিয়েছেন রফিক, সালাম, জব্বার ও বরকতসহ আরো অনেকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য শহীদ যারা জনগণের মুক্তি, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছেন। তোমার মত তারাও হয়তো আজ আর্তনাদ করে বলছে, এইজন্য কি আমরা জীবন উৎসর্গ করেছিলাম? প্রিয় ভাই নূর হোসেন, আমাদের ক্ষমা কর। তোমাদের প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে নেই। আমরা তোমাদের রক্তের সাথে বেঈমানি করেছি। কেননা, তোমাদের রক্তের চেয়ে ক্ষমতা আমাদের কাছে বেশি প্রিয়!
লেখক: গবেষক এবং কলাম লেখক।
ই-মেইল:sarderanis@gmail.com