রাজধানীর রমনা থানাধীন অজয় রায়ের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে কেউ সাক্ষাৎ করতে চাইলেই যে সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে এমন নয়। অবশ্যই কিছু নিয়ম-কানুন মেনে অজয় রায়ের অনুমতি পাওয়ার পর একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী তার সাক্ষাৎ পাবেন। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও উগ্রবাদীদের হাতে নিহত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, লেখক অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়ের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ইস্টার্ন হাউজিংয়ের প্রধান ফটকে দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষীদের এমনই দিকনির্দেশনা দিয়েছে। গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে ঢাবির এই অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তার কাছ থেকে এই তথ্য জানা যায়। ‘কেমন আছেন স্যার?’ এ প্রশ্নের উত্তরে স্যারের দ্রুত জবাব, ‘খুব একটা ভালো নেই। অনেক চাপ যাচ্ছে। আমার ছেলের হত্যাকারীরা আমাকেও রেহাই দিচ্ছে না। এর বাইরে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে নানাভাবে উৎপাত করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে নানা প্রশ্ন করে। তখন আমিও ওদের পাল্টা প্রশ্ন করে বলি, এসব তো আপনাদের জানার কথা!’ ‘আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু নানাবিধ চাপ সহ্য করার শক্তি আমার থাকলেও আমার পরিবারের সদস্যরা সে চাপ সহ্য করতে পারছেন না। আমার স্ত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ ছাড়া আমি নিজেও বয়সের কারণে এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ।’ “আমার স্বাধীনভাবে চলাচলের ওপরও সরকার ও পরিবার উভয় পক্ষ থেকে বাধা আছে। এরই মধ্য বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠন থেকে আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব হুমকি দিয়ে কেউ আমাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না। আমি আগে থেকেই ‘ডেসপারেট’। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি বন্দুক হাতে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, বলা যায়, এখন জীবনের বাড়তি সময় কাটাচ্ছি। এ জন্য আমি কারও হুমকিকে ভয় পাই না।”
অজয় রায় বলেন, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা আমার নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে কয়েকবার আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এ জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর তিন-চার জন কর্মকর্তা আমার সঙ্গে কথাও বলেছেন। তারা আমাকে জানিয়েছেন, দরকার হলে আমাকে পুলিশ ‘প্রকেটশন’ দেওয়া হবে। তারা আমার বাড়ির সামনের গেটে পুলিশি নিরাপত্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাদের না করেছি। আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিক পুলিশ চলাচল করবে এমনটি আমি পছন্দ করি না। এমনকি আমি বন্দুক চালাতে পারি কিনা তা জানতে চেয়েছেন। আমি চালাতে পারি এ কথা জানার পর তাদের সরবরাহকৃত বন্দুক রাখার জন্যও বলেছেন কিন্তু আমি না করে দিয়েছি। তবে আমার বাড়ির সামনে নিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী আমার নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ফলে এখন কেউ চাইলেই যে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন এমন নয়। আমার অনুমতি পাওয়ার পরই তারা আমার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন।”
অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিজিতের বাবা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাফিদা এখন আমেরিকার জর্জিয়ায় আছে। সেখানে একটি কম্পিউটার কোম্পানিতে চাকরি করত সে। এক বছরের জন্য সেই কোম্পানি থেকে ছুটি নিয়েছে। সে মানসিকভাবে এখনো বিপর্যস্ত।’ অজয় রায় বলেন, ‘রাফিদা আমাদের কাছে আসতে চায় কিন্তু আমি বারণ করেছি। কারণ আমি নিজের জীবন নিয়েই ঝুঁকিতে আছি। রাফিদা নিজেও হত্যাকারীদের হিটলিস্টে আছে। অভিজিতের ওপর যখন হামলা হয় তখন রাফিদাও গুরুতর আঘাত পায়। তবে এখন শারীরিকভাবে সে ভালো আছে। দেশে থাকাকালে স্কয়ার হাসপাতালে তার চিকিৎসা শেষে আমেরিকায়ও উন্নত চিকিৎসা করা হয়। তবে এখনো তার ক্ষতস্থানে মাঝে মাঝে ব্যথা করে।’ অজয় রায় বলেন, ‘রাফিদা এখন দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, মৌলবাদ, ব্লগার হত্যা ও জঙ্গি হামলা বিষয়ে আমেরিকায় গবেষণা করছে। আমাকে এ বিষয়ে জানালে আমি তাকে বলেছি, মানসিকভাবে তৈরি থাকলে সে এ গবেষণার কাজ করতে পারে।’ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অজয় রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সাত-আট মাস পার হয়েছে। আমি এ বিষয়ে জানতে গোয়েন্দা অফিসে গিয়েছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন, তারা অভিজিৎ হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত পাঁচজনকে চিহ্নিত করেছেন। এখানে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দুজন। এরা অভিজিৎকে কুপিয়েছে। আর একজন অভিজিতের চলাচলের খবর হত্যাকারীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন তাদের নাকি ধরাও হয়েছে। এ পাঁচজনের মধ্যে দু-তিন জন আবার নীলাদ্রি নিলয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত। কিন্তু আমি এ তদন্ত নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নই। আমি তাদের বলেছি, আপনারা যদি অপরাধীদের বিষয়ে নিশ্চিত হন তবে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করুন। দেখি কী হয়!’
এ হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক রায় বলেন, আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন নামের কতগুলো মৌলবাদী সংগঠন ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামের জিহাদি অংশকে ‘হাইলাইট’ করে এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে। তারা সব ব্লগারকেই নাস্তিক মনে করে তাদের হত্যা করতে চাচ্ছে। কিন্তু সব ব্লগার এক বিষয় নিয়ে লেখেন না। এদের সম্পর্কে জানতে হলে তাদের লেখা বই ও ব্লগগুলো পড়তে হবে। হত্যাকারীরা ব্লগারদের বইগুলো না পড়েই তাদের নাস্তিক ভেবে এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে কিন্তু আমরা অপরাধীদের ধরতে পারছি না। এতে এই অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে। সরকারও এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় ভ‚মিকা পালন করছে। এমনকি গ্রেফতারকৃতদের ডিএনএ-ও নাকি পরীক্ষা করা হয়েছে। তার প্রশ্ন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে কয়েকজনকে শাস্তি দিলে এ অপকাণ্ড কমে আসত বলে তিনি মনে করেন।
অজয় রায় বলেন, সরকার যে ব্লগার ও প্রকাশকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এটি দৃশ্যমান। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাও আছে। আর অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিচ্ছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, তালিকাভুক্ত ব্লগারদের নাকি রক্ষা করা যায় না। আমি ভাবতেই পারি না উচ্চপদে বসে এ লোকগুলো এ কথা কীভাবে বলতে পারেন! ধরে নেওয়া যাক যাদের হত্যার জন্য তালিকা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ঢাকায় এমন ব্যক্তি আছেন ২৫ থেকে ৩০ জন। তাদের নিরাপত্তা দেওয়া কি এতই কঠিন কাজ! টুটুল বহুদিন আগে থেকেই হত্যাকারীদের টার্গেট ছিল। সে নিজেও পুলিশের কাছে নিরাপত্তার জন্য গিয়েছিল। দীপনও তাদের টার্গেট ছিল। কিন্তু আমরা তাদের রক্ষা করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, সরকার ও পুলিশ তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো। আমি সরকারের কাছে আবেদন করব যে, এভাবে সরকার চালানো যায় না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে যাতে একটি লোকও বিচারবহির্ভ‚তভাবে মারা না যায়। আর যদি যায় তবে তাদের হত্যার দায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকদের নিতে হবে।
Moin Ahmed liked this on Facebook.
MG Azam liked this on Facebook.
Shah Nawaz liked this on Facebook.
Laltu Hossain liked this on Facebook.
Sohel Ahmed Likhon liked this on Facebook.
Md Azizul liked this on Facebook.
এক কাপ চা liked this on Facebook.
Ala Uddin liked this on Facebook.