‘বড় ভাই’ অনেক

ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে সন্দেহের মূলে রয়েছেন ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর এমএ কাইয়ুম। কাইয়ুম তার ভাই এমএ মতিনকে মাঠ পর্যায়ে বিদেশি নাগরিক হত্যার সমন্বয়কের দায়িত্ব দেন। খুনিদের সঙ্গে এমএ মতিন যোগাযোগ করে হত্যা মিশন সফল করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেন, বিএনপি নেতা কাইয়ুম কমিশনারের নির্দেশে বিদেশি নাগরিক হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ইতালির নাগরিক তাভেলা হত্যাকা ের নেপথ্যে যারা রয়েছেন, তারা রাজনীতিবিদ। তদন্তে রাজনৈতিক দলের নেতাদের খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন। দু’একদিনের মধ্যেই গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো হবে।

সূত্রগুলো বলছে, ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যা কোনো এক ‘বড় ভাইয়ের’ কাজ নয়। এর নেপথ্যে রয়েছেন অনেক ‘বড় ভাই’। তারা বড় বড় রুই-কাতলা। গোয়েন্দা তদন্তে ক্রমেই বেরিয়ে আসছে তাদের নাম। তাদের পরিকল্পনা ও অর্থায়নে বিদেশি নাগরিক হত্যা করা হয়। রাঘববোয়ালদের মধ্যে শুধু কয়েকজন বিএনপি নেতা নন, একজন জামায়াত নেতাও রয়েছেন। কয়েকটি স্তরে বিদেশি নাগরিক হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রত্যেক ধাপে ছিল ‘বড় ভাই’। তারা বলছেন, একাধিক ‘বড় ভাই’ পুরো পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মধ্যম সারির এক ব্যক্তির মাধ্যমে তারা মাঠ পর্যায়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। মাঠ পর্যায়ের যে তিনজন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন, তাদের মধ্যে দু’জনকে ভাড়া করেছিলেন মহানগর বিএনপি নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর এমএ কাইয়ুমের ছোট ভাই এমএ মতিন। ওই দু’জনের কাছে এমএ মতিন ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত। মতিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও ‘বড় ভাইয়ের’ নাম বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে তাভেলা হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন ৭-৮ জনের নাম উঠে এসেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনও তাভেলা হত্যায় রাঘববোয়ালদের নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তাভেলা হত্যার পর প্রথমে অনেকের ধারণা ছিল, উগ্রপন্থি কোনো গোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে, হত্যার মোটিভ ছিল রাজনৈতিক। বিএনপি-জামায়াতের কয়েক নেতা এই পরিকল্পনায় যুক্ত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন গোয়েন্দারা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল আরও বলেন, দুই বিদেশি হত্যাকা ের পরিকল্পনা একই জায়গা থেকে হয়েছে। সন্দেহভাজন যারা বিদেশে পালিয়েছেন, তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত আনা হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ইতালির নাগরিক হত্যায় যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি উদ্ধার ও নেপথ্য কুশীলবদের গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, তাভেলা হত্যার ঘটনাটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। দেশ-বিদেশে বসে অনেকে এর নেপথ্য কুশীলবের ভূমিকা রাখেন। হত্যার রাজনৈতিক মোটিভ লুকাতে কীভাবে কার মাধ্যমে ‘আইএস’ নাটক সাজিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে হবে_ এ পরিকল্পনায় ছিল পৃথক টিম। উগ্রপন্থিদের আদলে ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে হামলার ছক করা হয়। এক গ্রুপ যাতে অন্য গ্রুপ সম্পর্কে জানতে পারে, সে ব্যাপারে দেওয়া হয় নানা নির্দেশনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করাও ছিল এই হামলার অন্যতম লক্ষ্য।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তাভেলা হত্যার পরিকল্পনা ও সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার চারজনের মধ্যে রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল ও মিনহাজুল আরিফিন রাসেল ওরফে ভাগ্নে রাসেল ওরফে কালা রাসেলকে বিদেশি হত্যার পরিকল্পনাটি জানান এক ‘বড় ভাই’। চাক্কি রাসেল ও মিনহাজুল বিদেশিকে গুলি করতে ভাড়া করেন তামজিদ আহমেদ রুবেলকে। তবে আদালতে জবানবন্দিতে রুবেল দাবি করেছেন, কেন কী কারণে বিদেশিকে হত্যা করা হবে_ এটা তাকে জানানো হয়নি। তাকে শুধু বলা হয়, একজন বিদেশিকে হত্যা করে গুলশানে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে হবে। আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল ও মোটরসাইকেল সরবরাহকারী শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দারা। অস্ত্র সরবরাহকারী বাড্ডার ভাঙাড়ি সোহেলকে ধরতে একাধিক জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লন্ডন ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বেশ কয়েক ব্যক্তির ওপর নজর রাখছেন গোয়েন্দারা। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাইয়ুম কমিশনার ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারেও নিবিড় অনুসন্ধান চলছে। ঘটনার পর পরই হাবিব-উন-নবী খান সোহেল গা-ঢাকা দিয়েছেন। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। বিএনপি নেতা হাবিব বিদেশে পালিয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্র বলছে।
কাইয়ুম কমিশনারের বক্তব্য :গতকাল রাতে মালয়েশিয়ায় যোগাযোগ করা হলে কাইয়ুম কমিশনার টেলিফোনে বলেন, ৭-৮ মাস ধরে তিনি দেশের বাইরে। তাভেলা হত্যার ব্যাপারে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তার ভাই মতিনকে আটক করে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিদেশি হত্যায় অর্থদাতা হিসেবে তাকে জড়ানোর আশঙ্কা করছেন তিনি।

সুত্র-সমকাল