হাসিম উদ্দিন আহমেদ
জান্নাতুল ফেরদৌস। ময়মনসিংহ জেলায় তারাকান্দায় তার বাড়ি। বাবা সাইফুল ইসলাম ফকির একজন ব্যবসায়ী। দুই বোনের ছোট জান্নাত। পড়ালেখায় বরাবরই তুখোড়। এসএসসি ও এইচএসসি দুটোতেই জিপিএ-৫, স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার। সেভাবেই প্রস্তুতি ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌসের। বাবাও সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছেন মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাবারও ইচ্ছে, এই মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তারপর বিয়ে-শাদীর চিন্তা। সে লক্ষেই এগুচ্ছিল সব।
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। সকাল ১০টায় আরম্ভ হওয়ার কথা। জান্নাত আগেই আবেদন করেছিলো। তাই পরীক্ষায় অংশ নিতে গতকাল বাবার সাথে ঢাকায় রওয়ানা হয়। এর আগে সকালের প্রার্থনা শেষে সবকিছু গোছগাছ করে জান্নাত। মা-বাবার সঙ্গে খেয়ে মা’কে পা ছুঁয়ে সালাম করে মায়ের কাছ থেকে বিদায়।
কিন্তু কে জানতো সেটাই হবে শেষ বিদায়!
বড় বোন, স্বামী সংসার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। বোনের বাসায় উঠবে এটা আগেই ঠিক করা ছিল। পথে কোনো সমস্যা ছাড়াই ৪/৫ ঘন্টায় ঢাকায় পৌছে যায় জান্নাত ও তার বাবা। বাসে বসেও মেয়ের শেষ প্রস্তুতির তোড়জোড় দেখে বাবা মুচকি হাসেন আর সৃষ্টিকর্তার কাছে মেয়ের জন্য মনে মনে দোয়া করেন। বাসের সিটে বসে বাবা ঘুমিয়ে পড়েন। জান্নাত তখনও সাথে আনা বইয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে।
বাস থামলো। বাবা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে বড় মেয়ের বাসায়। ব্যাগ-পোটলা বড় মেয়ের হাতে দিয়ে বাবা ড্রয়িং রুমে বসলেন। পাশে এসে জান্নাতও বসল। “বাবা আমার শরীরটা কেমন করছে!”
“কেমন করছে, মা?” বাবার উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসা। বসা থেকে হেলে পড়ল মেয়েটি। বাবার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বড় বোনের চিৎকার আর বাবার আহাজারিতেও জান্নাত সাড়া দেয় না। পৃথিবীর সমস্ত নিস্তব্ধতা এসে ভর করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা জান্নাতকে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সব শেষ। জান্নাত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় পৃথিবীর সব সুখ-স্বপ্নকে পেছনে ফেলে জান্নাতুল ফেরদৌস এখন স্থায়ী জান্নাতের দিকে পাড়ি জমিয়েছে।
জানা গেলোল, জান্নাতুল ফেরদৌস হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করেন। ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন )
এক অবর্ণনীয় ভারি নিষ্ঠুর বাস্তবতা জান্নাতের পিতা সাইফুল ইসলামকে বাকরূদ্ধ করে দেয়। বাকরুদ্ধ পিতার প্রচণ্ডড ভারি নিঃশ্বাসগুলো পৃথিবী কিভাবে সহ্য করবে!
তবে সন্তানের লাশ নিয়ে যে রাতেই বাড়ি ফিরতে হবে পিতাকে, সেই কর্তব্যজ্ঞানটুকু তিনি হারাননি। পিতার কাঁধে যখন সন্তানের লাশ উঠে, এ বোঝা অবশ্যই বহনযোগ্য। তবে পৃথিবীতে এরচে’ ভারি বোঝা আর কিছু হতে পারে না, হয় না। এক নিঃষ্ঠুর বাস্তবতার সাক্ষী হয়ে অবশেষে পিতা তার কন্যার লাশ নিয়ে তারাকান্দার দিকে রওয়ানা দিলেন।
এমন দৃশ্যে আকাশের তারারাও নিশ্চয়ই কেঁদে উঠেছিলো। চাঁদের স্বর্ণালি আভা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। নদীর স্রোতও বিদ্রোহ করতে চায়। পুরো পৃথিবীকে এক অস্বাভাবিকতায় ভর করে। গতকাল রাতেই লাশবাহী গাড়ি চলে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দিকে।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের তারাকান্দার দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। কিলোমিটারের দূরত্বে এই পথযাত্রা হয়তো খুব বেশি নয়। কিন্তু এর প্রতিটি মাইল ‘লাশ বহনকারী একজন পিতা’র কাছে একেকটি কষ্টের মাইল ফলক। কষ্টের মাইলফলকগুলো একটা একটা করে অতিক্রম করে পিতা আর কন্যাকে নিয়ে নিজ বাড়িতে পৌঁছে।
এমন অবিশ্বাস্য একটি মৃত্যু পরবর্তি অবস্থা কেমন হয়, জান্নাতের বাড়িতে যেন তারচেয়েও বেশি ছিলো। এই মৃত্যুটিকে কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না। যে মেয়েটিকে নিজ হাতে রান্না করে সকাল বেলায় খাইয়ে দিয়েছেন, যার ভর্তির জন্য মা সৃষ্টিকর্তার দরবারে সারাদিনই প্রার্থনা করেছেন, সেই মাকে বোঝানোর কোনো ভাষা কিংবা সাধ্য কারো ছিলো না। মা বার বার মূর্ছা গিয়েছেন ।
আজ সকালে একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে। আর অন্যদিকে তারাকান্দায় হয়েছে জান্নাতের জানাজার নামাজ। পৃথিবীর সব হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস এখন জান্নাতের যাত্রী
Md Motalib liked this on Facebook.
Feardaous Hasan Roney liked this on Facebook.
Jahangir Alom liked this on Facebook.
Sohel Khalasi liked this on Facebook.
Saddam Hossain liked this on Facebook.
Shareef Rasal liked this on Facebook.
Jahidul Momin liked this on Facebook.
Rezina Akhter liked this on Facebook.